
স্বামী বিবেকানন্দ তার শিষ্যদের বলতেন, ‘ওরে এসেছিস যদি, একটা দাগ রেখে যা।’ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সমসাময়িক রজনীকান্ত সেন তেমনই দাগ রেখেছেন বাংলা সাহিত্যে। বাঙালির হৃদয়ে গান, কবিতা আর চিন্তার স্বকীয়তায় তিনি স্মরণীয়। বাংলা সাহ্যিতে পঞ্চকবির মধ্যে তিনি ‘কান্তকবি’ নামে পরিচিত রজনীকান্তের খ্যাতি ছিল তাৎক্ষণিক সংগীত রচয়িতা হিসেবে। যেকোনো অনুষ্ঠানে বা সভায় বসে গান রচনা করে তাতে সুর দিয়ে গেয়ে শোনাতেন। এমনি তাৎক্ষণিকতার মাঝেই রচিত হয়েছিল স্বদেশি আন্দোলনের বিখ্যাত গান, ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই’। ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেনের লেখায় রয়েছে এ গান রচনার প্রেক্ষাপট। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের এক দুপুরে রাজশাহী থেকে কলকাতায় এলে অক্ষয়কুমার সরকারের মেসের ছেলেরা রজনীকান্ত সেনকে একটা গান লিখে দেওয়ার জন্য বলেন। তাদের অনুরোধেই লেখা গানটি সন্ধের মধ্যেই কলকাতার পথে মিছিলের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।
একটানা কয়েক ঘণ্টা গান গেয়েও তিনি ক্লান্ত হতেন না। গানে ঈশ্বরের আরাধনাকেই তিনি প্রধান উপজীব্য করেছিলেন। দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গানে অনুপ্রাণিত হয়ে হাসির গানও লিখেছেন। অনেকের কাছে ‘রাজশাহীর ডি এল রায়’ বলেও পরিচিত ছিলেন। নিজের গানে নিজেই সুর দিয়েছেন। লিখেছেন হাসির ও স্বদেশি গান। ভক্তিমূলক গানের জন্য আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন তাকে ‘দ্বিতীয় রামপ্রসাদ’ আখ্যা দিয়েছিলেন। আর আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছিলেন, ‘সাধক কবি রজনীকান্ত’। রজনীকান্ত সেন তার গানে রামপ্রসাদ থেকে কাঙাল হরিনাথ, প্রচলিত সবার সুরের সঙ্গে মিশিয়েছিলেন নিজের সারল্য।
কবিকন্যা শান্তিবালা দেবীর লেখায় জানা যায়, ‘রজনীকান্ত সেনের গানের সংখ্যা ২৯০টি।’ তবে সংরক্ষণের অভাবে তার অসংখ্য গান হারিয়ে গেছে। ফলে তার রচিত গানের প্রকৃত সংখ্যা অজানা।
১৮৬৫ সালের ২৬ জুলাই ব্রিটিশ শাসিত পূর্ববঙ্গের পাবনা জেলার [বর্তমানে সিরাজগঞ্জ] সেন ভাঙবাড়ি গ্রামে জন্ম হলেও তার জীবন কেটেছে রাজশাহীতে। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে ঘুরেছেন নানা স্থানে; যা পরবর্তী সময়ে তার জীবনকে প্রভাবিত করেছে। প্রাণচঞ্চল, উচ্ছ্বল ঈশ্বর অন্তপ্রাণ এই মানুষটির জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। মাত্র ৪১ বছর বয়সেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯০৯ সালে ধরা পড়ে কণ্ঠনালির ক্যানসার। গলায় ‘ট্র্যাকিওস্টমি’ অপারেশনের পর জীবন রক্ষা পেলেও চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় কথাবলার শক্তি। জীবনজুড়েই তিনি দেখেছেন একে একে প্রিয়জনদের মৃত্যু, আর বিপর্যয়। পুত্র ভূপেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরের দিন পুত্রশোক নিয়েই লিখেছিলেন-‘তোমারি দেওয়া প্রাণে, তোমারি দেওয়া দুখ,/ তোমারি দেওয়া বুকে, তোমারি অনুভব,/ তোমারি দু-নয়নে, তোমারি শোকবারি,/ তোমারি ব্যাকুলতা, তোমারি হা-হা রব।...’
হাসপাতালে শারীরিক কষ্টের দিনগুলোতেই রচনা করেন ‘আনন্দময়ী’ গ্রন্থের সব গান। এ ছাড়া ‘অমৃত’ নামে শিশুপাঠ্য বইটিও জড়িয়ে আছে হাসপাতাল জীবনের সঙ্গে। ‘বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই’, ‘নর কহে ধূলিকণা তোর জন্ম মিছে’ আট লাইনের এই নীতি শিক্ষামূলক কবিতাগুলো এই বইয়েরই। জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয় ‘বাণি’, ‘কল্যাণী’, ‘অমৃত’ এই তিনটি বই। আর মৃত্যুর পর ‘অভয়া’, ‘আনন্দময়ী’, ‘বিশ্রাম’, সদ্ভাবকুসুম ও শেষদান এই পাঁচটি বই।
যখন কথা বলার শক্তি ছিল না, তখন লিখেছেন দিনপঞ্জি। আত্মজীবনীও লিখতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু একটি অধ্যায় লেখার পর মৃত্যু এসে থামিয়ে দেওয়ায় সে লেখা আর এগোয়নি। রোজনামচায় লিখেছেন, ‘আমার শ্রাদ্ধে বেশি খরচ ক’র না। কিন্তু যেমন পিপাসা তেমনি খুব জল দিও। আম উৎসর্গ করিও। জল দিতে কৃপণতা ক’র না। বড় পিপাসায় ম’লাম, জল দিও।’
কথাবলার শক্তি হারালেও রজনীকান্তের ঈশ্বরে বিশ্বাস কখনোই টলেনি। বরং গানে গানে সৃষ্টিকর্তার পদতলে নিজেকে উৎসর্গ করেই গেয়েছেন-‘(আমি) অকৃতী অধম বলেও তো, কিছু/কম করে মোরে দাওনি!/যা দিয়েছ তারি অযোগ্য ভাবিয়া,/কেড়েও তো কিছু নাওনি।’ ১৯১০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর মৃত্যু এসে কেড়ে নেয় তাকে। তার দেহ ভাগীরথীর তীরে বহন করার সময় রোগশয্যায় শুয়ে রোজনামচায় লেখা তার ইচ্ছে অনুযায়ী অনুরাগীদের কণ্ঠে ছিল, তারই লেখা গান ‘কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইব / তোমারি রসাল নন্দনে’।
তার সংগীতের স্নিগ্ধ শান্ত কারুণ্য বাঙালি সংগীতপিপাসুর মনে অবিস্মরণীয়। প্রাঞ্জলতাই তার গানের মূল আকর্ষণ। নিজস্বতায় ভরা গান দিয়ে তিনি স্পর্শ করেছেন বাঙালির মনন। আর তার ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই; দীন দুঃখিনী মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই’, এই একটি রচনাই তার অমরত্বের জন্য যথেষ্ট। বাংলা গানের এই দিকপালকে স্বমহিমায় চির ভাস্বর করে রেখেছে।