Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

হাওরের জিরাতি জীবন

Icon

আলমগীর খোরশেদ

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২৫, ১১:৪২

হাওরের জিরাতি জীবন

হাওরে বর্ষা মৌসুম এলেই পানি আর পানি। বর্ষায় অগাধ জলরাশি, দ্বীপের মতো ভেসে থাকে ছোট ছোট গ্রাম। শুকনা মৌসুমে হাওরে সবুজে মোড়ানো বিস্তৃত মাঠ, মাইলের পর মাইল ধানক্ষেত। শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে গিয়ে পরিণত হয় ফসলি জমিতে। শুকনো মৌসুমে অর্থাৎ বোরো ধান লাগানোর সময় চোখে পড়ে হাওরজুড়ে অস্থায়ী ছোট ছোট কুঁড়েঘর। এসব ঘরে বসবাস করেন এক শ্রেণির খেটে খাওয়া মানুষ, যারা মৌসুমি 

কৃষক। তাদের ‘জিরাতি’ বলা হয়। মোগল আমলে বাংলা ও বিহারে জিরাত প্রথা চালু ছিল। জিরাত জমি ছিল জমিদারদের ব্যক্তিগত। ফসল ফলানোর মৌসুমের শুরুতে আসতেন এবং ফসল উঠানোর পর নিজ বাড়িতে ফিরে যেতেন, মূলত তারাই হলেন ‘জিরাতি’। কেউ কেউ তাদের বাপ-দাদার আমল থেকে প্রাপ্ত এই পেশা ধরে রেখেছেন। জিরাতি কোনো জাত নয়, কোনো আলাদা সম্প্রদায়ও নয়। ওরা কৃষিজীবী। জমির সঙ্গে জিরাতিদের সম্পর্ক। জিরাতিরা মহাজনের কাছ থেকে মৌসুমভিত্তিক জমি লিজ নেয়। তাদের একটাই প্রধান ফসল, তা হলো বোরো ধান। বোরো ধানের ওপর ওদের সব স্বপ্ন, আশা ও ভরসা। বছরে সাত-আট মাস পরিবার-পরিজন ছেড়ে হাওরে পড়ে থাকেন জিরাতি লোকজন। বিস্তীর্ণ হাওরে নেই কোনো হাটবাজার, নেই সামাজিক অনুষঙ্গ, নিস্তব্ধতা আর নিঃসঙ্গতায় কাটে জিরাতিদের জীবন। জনমানবহীন, হাওর জনপদ, খোলা আকাশটাই যেন ভরসার সামিয়ানা জিরাতিদের। কাজের ভেতরেই এক ফাঁকে রান্না করতে হয় তাদের। বিরান হাওরে জীবিকার তাগিদে সব কষ্ট ভুলে পড়ে থাকে ওরা। একসঙ্গে অনেক ধান, সারা বছরের খোরাকি, ধান বিক্রি করে সংসার পরিচালনের খরচ নির্বাহকরণ, ভবিষ্যতের আশায় পরিবার-পরিজনহীন জিরাতিদের বেঁচে থাকা। রান্না, খাওয়া, 

থাকা সব একটা ঘরেই। কার্তিক মাসে আসে ওরা। ধান নিয়ে জ্যৈষ্ঠ মাসে বাড়ি ফিরে। হাওরে ঝড়, শিলাবৃষ্টি থামানোর জন্য মন্ত্রবলা তান্ত্রিক শ্রেণির লোক ছিল। তাদের বলা হতো ‘হিরালি’। তাদের কাজ ঝড়-তুফান শিলাবৃষ্টি থেকে কৃষকের ধান রক্ষা করা। চারপাশ আঁধার করে ঝড়-তুফানের আলামত দেখলেই  হিরালি লোকেরা মন্ত্র পড়া শুরু করতেন। হাতে ত্রিশুল, মাথায় বাঁধা লালসালু কাপড়, নৃত্য শুরু করতেন ওরা জমিতে। বৈশাখ মাসে হাওরের কৃষকরা ফসল ওঠার পর হিরালিকে ধান দিতেন। মানুষের কাছ থেকে প্রাপ্ত এই ধানেই চলত হিরালি সম্প্রদায়ের জীবন। সেই দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। দীর্ঘদিন জিরাতিরা জনমানবহীন হাওরে থাকেন। জিরাতি গিন্নীরা হাওরে হাঁস পালন করেন। হাওরের কয়েক মাইলের মধ্যে গাছপালা, ছায়া, পানীয় জলের ব্যবস্থা থাকে না। ফলে খাল-বিলের পানি পান করতে হয় জিরাতিদের। প্রায় আট মাস নির্জন হাওরে ঘর বেঁধে কাটিয়ে বোরো ধানের ফলন হলে ধান নিয়ে বাড়ি ফেরেন জিরাতিরা। তার পরও সারা দিন কাজ করার পর সন্ধ্যায় বসায় গানের আসর। ইদানীং বজ্রপাতে মারা যাচ্ছেন হাওরের অনেক জিরাতি কৃষক। তবুও জীবন থেমে থাকে না। এগিয়ে যায় হাওরের জিরাতি মানুষদের জয়যাত্রা। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫