Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

সাহিত্যের রাজনন্দন হুমায়ূন আহমেদ

Icon

প্রণব চক্রবর্তী

প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২৫, ১৫:৩০

সাহিত্যের রাজনন্দন হুমায়ূন আহমেদ

আশির দশকে বাংলা সাহিত্যে যে নতুন বাঁক সৃষ্টি হয় তার অন্যতম কারিগর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক হুমায়ূন আহমেদ। সামাজিক দূরত্বের কারণে বেশির ভাগ বাঙালি পুরুষ নারী সম্পর্কে বিয়ের আগে ভালোভাবে অবহিত হওয়ার সুযোগ পেতেন না। অতএব, এ ক্ষেত্রে স্বপ্ন বা ধারণায় আচ্ছন্ন থাকত তাদের মন। হুমায়ূন নারীকে অসম্ভব রূপবতী, মমতাময়ী, সেবাপরায়ণ ইত্যাদি অভিধায় তুলে আনতে চেয়েছেন তার লেখা চরিত্রগুলোর মাঝে। ফলে নারী পরিবারের অনিন্দ্যসুন্দর জীবন্ত পুতুল হিসেবে ধরা দিয়েছে। এটিই বাঙালি পরিবারের নারীর শাশ্বত চরিত্র। নারীর প্রতিবাদী বা অ্যাস্টাব্লিশমেন্ট বিরোধী শক্তিকে উন্মোচনে তিনি খুব আগ্রহী ছিলেন এমন প্রমাণ মেলে না।

হুমায়ূন একান্নবর্তী পরিবারের বিধায় এ ধরনের পরিবার তার লেখায় চিত্রিত হয়েছে সফলভাবে। অভিযোগ রয়েছে যে তিনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বড় সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক।

লেখক কথায় কথায় পরিবর্তনের বুলি কপচাবেন এটি যেমন কাক্সিক্ষত নয়, আবার তিনি সমাজে অগ্রসরের চিন্তামুক্ত তৃপ্তি নিয়ে শুধু টাকা কামাই করবেন, এটিও গ্রহণযোগ্য নয়। লেখক নিজে তার জনপ্রিয়তা সৃষ্টি করেন, পাঠককুল তৈরি করেন এবং এর প্রেক্ষিতে তার আয় হয়। তার মানে তার দায় রয়েছে পাঠককুলের প্রতি। বিশেষ করে হুমায়ূনের মতো লেখক যিনি শুধু নিজের লেখালেখির ওপর পূর্ণ মাত্রায় নির্ভর করতেন জীবিকার জন্য। কিন্তু তাই বলে তিনি সামাজিক প্রত্যাশা এড়িয়ে যেতে পারবেন কি?

না। এটি লেখকের নৈতিক বা ভিন্নভাবে বললে বেঁচে থাকার দায়। যে দায় আছে বলে তার জীবনাবসানের পরও তাকে আমরা স্মরণ করছি। 

এ কথা অস্বীকার করার জো নেই, হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যে এক নব তরঙ্গের সূচনা করেছেন। প্রায় ২৪২টি বই তিনি লিখেছেন বলে জানা যায়। নাটক, সিনেমা বা বিজ্ঞাপন তৈরির মাধ্যমেও তিনি তার স্বতন্ত্র উপস্থিতির উজ্জ্বল প্রমাণ রেখে গেছেন। কিন্তু তার গল্প ও উপন্যাস মূলত পুরুষ চরিত্রকেন্দ্রিক। হয়তো বই ক্রেতা পাঠকদের বেশির ভাগ পুরুষ বিধায় বাণিজ্য বিষয়টিকে তিনি গুরুত্ব দেওয়া যথাযথ মনে করেছেন। এ জন্য নারীর লাস্যময়ী চরিত্র যতটা পুরুষ পাঠককে প্রভাবিত করেছে, ততটা বিমর্ষ করেছে নারী পাঠককে। 

নারী উন্নয়নে হুমায়ূন উচ্চকণ্ঠ হবেন এবং তার জনপ্রিয়তা ব্যবহৃত হলে নতুন ধারণা বলয় সৃষ্টি হবে-এই প্রত্যাশাও অনেক পাঠকের ছিল। তবে এই ফাঁকে আরেকবার বলে রাখা ভালো, হুমায়ূন মধ্যবিত্ত সেমি তৃপ্ত গৃহী মানুষের জন্য স্বস্তির স্পেস তৈরি করেছিলেন, যা বড় মাত্রায় পাঠকনন্দিত হয়েছে এবং ক্রেজ সৃষ্টিতে সমর্থ হয়েছে।

হুমায়ূনের লেখায় সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী অনুকল্পের তেমন দেখা মেলে না। কিন্তু হুমায়ূন যে সমাজে বড় হয়েছেন, সেই সমাজেই এটি বিষ কাঁটা হিসেবে অবস্থান করছে। হুমায়ূন শ্রেণি চেতনাকে ব্যবচ্ছেদ করেননি হয়তো সচেতনভাবেই। ফলে তার চরিত্রগুলোর প্রত্যাশা নিজেদের বিদ্যমান গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকে। কাজের মেয়ের সঙ্গে ড্রাইভার বা সমগোত্রীয় কারো প্রেম বা বিয়ের ঘটনাকে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এঁকেছেন। মোদ্দা কথা হলো তিনি মধ্যবিত্তের বিশ্বাসে চিড় ধরে এমন কিছুতে হাত দেওয়ার আগে দ্বিতীয়বার চিন্তা করেছেন সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে। এটিও ঠিক যে শ্রেণিভিত্তিক আস্থা তৈরির একটি জুতসই প্ল্যাটফর্ম না গড়ে উঠলে সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সহজসাধ্য হয় না। হুমায়ূন দীর্ঘায়ু হলে হয়তো তার প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর আমরা পেতাম।

হুমায়ূন হিউমারের জগতে বড় পরিবর্তন এনেছেন তার লেখালিখিতে। ফলে হাস্যরসের ক্ষেত্রে সহনীয় মাত্রা যোগ হয়েছে মধ্যবিত্তের কাছে। শুধু সংলাপ প্রক্ষেপণ বা সংলাপবিহীন ভঙ্গীতেও যে মানুষ হাসিতে ভেঙে পড়তে পারে, তার সার্থক ব্যবহার অত্যন্ত মুনশিয়ানার সঙ্গে চিত্রিত করতে সমর্থ হয়েছেন।

হুমায়ূনের বিরুদ্ধে আর একটি অভিযোগ হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরো সময় বরাদ্দ তিনি করেননি। যদিও বেশ কয়েকটি উপন্যাস ও চলচ্চিত্র পাখির মুখে ‘তুই রাজাকার’ ধ্বনি একসময় সবার কাছে আদৃত হয়েছিল।

প্রত্যাশার তালিকা দীর্ঘ হলেও এটি সত্য বাংলাদেশের সাহিত্যে নিজের রাজকীয় স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। সহজ ভাষায় রোমান্টিক গল্প বলা এর অন্যতম। এই নব ধারার প্রবর্তক হুমায়ূন আহমেদকে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫