
এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বই ‘মেধাজীবীর দায়’ (The Responsibility of Intellectuals) এই প্রবন্ধে তিনি বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ও দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি মনে করেন, ক্ষমতাশালীদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের সোচ্চার হওয়া উচিত এবং সমাজের দুর্বল ও নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো তাদের নৈতিক দায়িত্ব। এই গ্রন্থে সাঈদ মূলত তিনটি মূল ধারণার ওপর জোর দিয়েছেন। প্রথমত, ক্ষমতার বিরোধিতা। তিনি বলেন, ‘বুদ্ধিজীবীদের উচিত ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার হওয়া। দ্বিতীয়ত, সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর হওয়া।
লেবাননের ভূমি ইসরায়েলি সেনা মুক্ত হওয়ার পর সাঈদ মুক্তভূমিতে দাঁড়িয়ে একটি পাথর ছুড়ে দিয়েছিলেন ইসরায়েলি সেনাদের দিকে। এই ঢিলটি শুধু একটি পাথরের টুকরো নয়; একটি বার্তা। সনজিদা আনোয়ার চৌধুরী নামের এক অসীম সাহসী ছাত্রী যখন মুহুর্মুহু গুলির মধ্যে বলেন, ‘পিছনে পুলিশ, সামনে স্বাধীনতা’ তখন এটি মাত্র একটি বার্তা নয়, একটি অস্ত্র; যা উদ্দীপ্ত করেছিল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের। একটি খুনি শাসকগোষ্ঠীর বন্দুকের নলের সামনে তো দূরের কথা, বুদ্ধিজীবী শ্রেণি একটি বিবৃতি দিয়েও এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে বলেনি। বরং বিএনপি-জামায়াত-শিবির ট্যাগ লাগিয়ে গণহত্যাকে উৎসাহিত করেছে।
ম্যাকডোনাল্ড বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্বকে ‘মানুষের দায়িত্ব’-এর চাইতে আরো গভীর হিসেবে বিবেচনা করেছেন। কারণ বুদ্ধিজীবীরা যে অনন্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন সাধারণ মানুষ তা ভোগ করে না। স্বাধীনতার পর থেকেই বুদ্ধিজীবী শ্রেণি রাজকোষের এই সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আসছে। আর গত ষোলো বছর তা শিমুল তুলার মতো এতটাই ফুলেফেঁপে উঠেছে যে একজন সাংবাদিকও হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য থেকে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী থেকে আমলা হাজার কোটি টাকার মালিক বিদেশে শত শত বাড়ি কেনা আর অর্থ পাচারে একেকজন হয়ে উঠেছিলেন বিশ্ব খেলোয়াড়। যেন লুটেরার অলিম্পিকে নাম লেখাবেন একেকজন। প্রজাতন্ত্রের খাজাঞ্চিখানার পাহারাদার ব্যাংক লুটেরা হিসেবে আবির্ভূত। আরেকটা অংশ নীরব বা উদাসীন ছিলেন। প্রতিবাদী পক্ষটির মুখ ছিল সেলাই করা। তার ভেতর থেকে একটি গোঙানির আওয়াজ মাত্র ছিল। আয়নাঘরের মতো সেই আওয়াজ প্রকাশ্যে শোনা সম্ভব ছিল না। নীরবতা আর উদাসীনতা এক নয়। ২৪-এর ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে এই রাজকোষের ভাগ পাওয়া বুদ্ধিজীবী শ্রেণি শুধু নীরবই ছিলেন না; ছিলেন উদাসীনও। তাই তারা মানুষকে যখন হত্যা করা হয় তারা ছিলেন নীরব। দীর্ঘ ষোলো বছর যে সুযোগ-সুবিধা তারা গ্রহণ করেছিলেন তার প্রতিদান, বরং তারা দিয়েছিলেন গণহত্যার সাফাই গেয়ে।
রাজনীতির চাষাবাদ বেড়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। যার ফলে জুলাই বিপ্লবে তারা ছাত্রদের পাশে না থেকে চলে গেছেন জালিম সরকারের পক্ষে। যে রাজ্যশাসক সরাসরি তার নাগরিকদের প্রাণঘাতী গুলি করে হত্যার হুকুম দেয়। পুলিশ ও সরকারদলীয় ক্যাডাররা যখন কুপিয়ে ছাত্রদের জখম করছে কিংবা বোমার আঘাতে বা গুলি করে হত্যা করছে, তখন ছাত্ররা আশ্রয় পায়নি শিক্ষকদের কাছে।
কোটার বিরুদ্ধে ২ জুলাই ২০২৪-এ যে শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার সমাপ্তি হয় ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। সরকার আন্দোলন নিয়ে কুম্ভকর্ণের ভূমিকা পালন করে। ১০-১২ জুলাই পালন করা হয় ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি। ১৪ জুলাই সরকারি চাকরির ৩০ শতাংশ নিয়োগের ক্ষেত্রে (মুক্তিযোদ্ধাদের) সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য সংরক্ষিত আসন রাখার বিষয়ে ছাত্রদের বিরোধিতা নিয়ে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্দোলন নিয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে জবাবে বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর তাদের এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে, নাকি রাজাকারদের নাতি-নাতনিরা পাবে? প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। স্লোগানের ভাষা পাল্টে যায় মুহূর্তেই, ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার!/ কে বলেছে, কে বলেছে/ স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।’ ১৬ জুলাই আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। শেখ হাসিনা সরকারের বিদায় ঘণ্টা তখনই বেজে যায়। ১৮ জুলাই ‘সম্পূর্ণ শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করা হয়। ৫ আগস্ট কারফিউ উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন দিক থেকে শহরে ঢুকতে থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে সেনাবাহিনী জনস্রোতকে থামানোর চেষ্টা করলেও পরে তারা সরে যায়। দুপুর নাগাদ লাখ লাখ ছাত্র-জনতা নেমে যায় গণভবন ঘেরাও কর্মসূচিতে। শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে একটি সামরিক হেলিকপ্টারে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে যান। গণভবন দখল করে
ছাত্র-জনতা। সারা দেশে উৎফুল্ল জনতা বের করে বিজয় মিছিল। সমাপ্তি হয় স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের দেড় দশকের জুলুম ও দুঃশাসনের যুগ। ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত লড়াইয়ের মাধ্যমে অর্জিত আরেকটি মুক্তি-সংগ্রাম। বিশ্বের ইতিহাসে প্রলম্বিত জুলাই। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা এর নাম দিয়েছে ৩৬ শে জুলাই। জুলাই
ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে প্রায় দেড় হাজার শহীদ ও ২০ হাজার আহত যোদ্ধার
হাত-পা-চক্ষুর বিনিময়ে আমরা পেয়েছি নতুন এক বাংলাদেশ। ৩৬ দিনের এই রোমহর্ষক ঘটনাবহুল রাত-দিনের যুদ্ধ কোনো দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে হয়নি। কোনো শত্রু দেশের বিরুদ্ধে হয়নিÑএই যুদ্ধ হয়েছে শোষক ও শোষিতের। জালিম ও মজলুমের।
আন্দোলনের শুরু থেকেই কবি, লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক তথা বুদ্ধিজীবী শ্রেণির একটা অংশ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাহস জুগিয়েছেন। আন্দোলনের সময় সশরীরে মাঠে থেকেছেন। কবিতা, গানে আন্দোলনকে উজ্জীবিত করেছেন। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো, জুলাই বিপ্লবের এক বছর হয়ে গেলেও কবি-লেখকদের একটি বিরাট অংশ এখনো জুলাই বিপ্লবের বিরোধিতা করছেন। অনেক দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় জুলাই নিয়ে তেমন একটা লেখা চোখে পড়ে না।
বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থাগার, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, নজরুল ইনস্টিটিউট, প্রেস ইনস্টিটিউট, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, সাময়িকী, সংকলন প্রকাশের ক্ষেত্রে জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কবি-লেখকদের উপেক্ষা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোতে জুলাই বিপ্লবের স্পিরিটকে ধারণ করে এমন জনবল পদায়ন করা জরুরি। একটি বৈষম্যহীন, সাম্য ও মৈত্রীর সমাজ গঠনের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন ও সংস্কৃতিবান জাতি গঠন জরুরি। তাদের মন ও মনন গঠনের জন্য বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি-কালচার আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলো অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসূচি হাতে নিতে পারে। জুলাই বিপ্লব তখনই সার্থক হবে যখন লেখক ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় নিজেদের মেধা, যোগ্যতায় জাতির বিবেক হিসেবে ভূমিকা রাখবেন।