
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
বাংলা সাহিত্যের জীবনঘনিষ্ঠ ও জীবনমুখী এক কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ । তার সাহিত্যকর্মে সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার, রাজনৈতিক টানাপড়েন, মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয়, মানসিক ও চারিত্রিক স্খলন, বাংলার লোকায়ত জীবনধারা প্রভৃতি বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন অত্যন্ত নিখুঁতভাবে যত্নের সহিত। উপন্যাস ও ছোট গল্পে সমান বিচরণের কারণে তিনি সর্বস্তরে প্রশংসিত। তার সমাজ বাস্তবতার দর্পণ, যার সাহিত্য পড়লে চোখের সামনে সমসাময়িক সমাজের বাস্তব চিত্র ভেসে ওঠে। তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘নয়নচারা’ প্রকাশিত হয় কর্মজীবন শুরুর তিন মাস আগে।
১৯৪৮ সালের জুলাই মাসে ঢাকা থেকে তার লালসালু উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। ১৯৬০ সালে উপন্যাসটি কলিমুল্লাহ কর্তৃক উর্দু ভাষায় অনুবাদিত হয়ে করাচি থেকে প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৬১ সালে ফরাসি ভাষায় ও ১৯৬৭ সালে ইংরেজি ভাষায় এবং পরবর্তী সময়ে জার্মান, চেকসহ বিভিন্ন ভাষায় উপন্যাসটি অনুবাদিত হয়। লালসালু উপন্যাস তৎকালীন গ্রামীণ মুসলমান সমাজের মানসিকতার প্রতিচ্ছবি। তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’তে তৎকালীন সমাজের ধর্মীয় গোঁড়ামির ওপর আঘাত করেছেন। তার এই উপন্যাসে তিনি একদিকে যেমন সমাজের মানুষের ভণ্ডামির চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন, অন্যদিকে গ্রাম বাংলার সহজ-সরল মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির চিত্রও ফুটিয়ে তুলেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় তার অনবদ্য আরেকটি উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবস্যা’। নিজের ভেতর লালন করা ন্যায়বোধের সঙ্গে নিজের যে লড়াই হয়, সে লড়াইয়ে সামাজিক প্রতিপত্তি কতটা প্রভাব বিস্তার করে, তার অসাধারণ এক আখ্যান ‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসটি। যার মধ্য দিয়ে সমাজের বাস্তব রূপটিই ফুটে ওঠে। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত তার ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসে সমাজের নির্মম বাস্তবতায় ব্যক্তির অস্তিত্ব সংকট কিভাবে প্রকট হয়ে ওঠে, সেটিকে তিনি দেখিয়েছেন।
তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ কথাসাহিত্যিক । বাংলা সাহিত্যে তার অতুলনীয় অবদান যুগ যুগ ধরে মানুষকে যেমনি অনুপ্রাণিত করেছে তেমনি বাংলা সাহিত্যকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায় । তার উপন্যাস ও গল্পগুলোতে বরাবরই উঠে এসেছে প্রান্তিক মানুষের ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার অপূর্ব নির্মম লড়াই। সমাজের অন্যায় অসংগতি, কুসংস্কার তার কলমকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। সব অন্যায় অসংগতির বাস্তব রূপায়ণ দেখতে পাওয়া তার কথাসাহিত্যে। তিনি উপন্যাস, ছোটগল্প ও নাটকের জন্য সমাদৃত। এর বাইরেও রয়েছে কবিসত্তা, সাহিত্য সমালোচক ও সাংবাদিক সত্তা। তার জীবনঘনিষ্ঠ লেখায় অত্যন্ত নিবিড়ভাবে তৎকালীন গ্রামীণ সমাজজীবনের চিত্র চিত্রায়ণ করেছেন দক্ষ কারিগরের মতো।
বাঙালি মুসলমানদের মানবিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে তিনি ছিলেন সচেষ্ট। ১৫ আগস্ট তার জন্মদিনে তার স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।