
কবি কাজী নজরুল ইসলাম
নজরুল কয়েকটি পরোক্ষ প্রেমপত্র লিখেছিলেন ফজিলতুননেসাকে সে কারণে তার নাম অনেকেই জানে। ফজিলতুননেসা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকের মেধাবী ছাত্রীদের অন্যতম । তার গ্রামের বাড়ি ছিল টাঙ্গাইল। বাবার নাম আবদুল ওয়াহেদ খান। তিনি টাঙ্গাইলের করটিয়ার জমিদারবাড়িতে চাকরি করতেন। ফজিলতুননেসা ও তার বোন শরীফুন্নেসাকে তিনি ঢাকায় রেখে পড়াশোনা করান। পড়াশোনায় ভালো ফলাফল করায় ফজিলতুননেসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে বৃত্তি পেয়েছিলেন। সে সময় অর্থাৎ ১৯২৮ সালের দিকে তিনি গণিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন। ওই বিভাগের শিক্ষক ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। তিনি থাকতেন যে বাসায় নজরুল ওই বাসায় রাত যাপন করেন। কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে নজরুলের বয়সের পার্থক্য সামান্য হওয়ায় এক ধরনের সহজ সম্পর্ক ছিল। কাজী মোতাহার হোসেনের মাধ্যমে বিভাগের ছাত্রী ফজিলতুননেসা জানতে পেরেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম হাতের রেখা দেখে ভাগ্য গণনা করতে পারেন। ফজিলতুননেসার জীবন সম্পর্কে উচ্চাভিলাষ ছিল তাই তিনি তার ভাগ্য গণনার জন্য নজরুলকে হাত দেখাতে চান। কাজী মোতাহার হোসেনই হাত দেখার ব্যবস্থা করে দেন। কাজী নজরুল ইসলামের কবি ও শিল্প প্রতিভার সঙ্গে বিন্দুমাত্র পরিচয় তার ছিল বলে কোনো গবেষকই উল্লেখ করতে পারেননি এমনকি কাজী মোতাহার হোসেনও না। নজরুলের সঙ্গে ফজিলতুননেসার সাক্ষাৎ পরিচয় এটুকুই। এরপর নজরুল কলকাতায় ফিরে যেতে যেতে এবং পৌঁছার মাস দুয়েকের মধ্যে মোট আটটি সাহিত্যিক প্রেমপত্র লিখেছেলেন কাজী মোতাহার হোসেনকে। চিঠির ভেতরের কথাবার্তায় আকারে ইঙ্গিতে ফজিলতুননেসার উল্লেখ রয়েছে। মাস দুয়েক পরে আর কোনো চিঠি লেখেননি। ঘটনা এখানেই সমাপ্ত। কেউ কেউ বলেছেন, ফজিলতুননেসাও নজরুলকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। ওই বলা অবধি। কেউ সেই চিঠি হাজির করতে পারেননি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নজরুলের সঙ্গে ফজিলতুননেসার প্রেম ও আরো নানা কেচ্ছাকাহিনি কেউ কেউ লিখেছেন। অনেকে রটিয়েছেন। এখনো রটানো চলছে। অনেকেই বিখ্যাত ব্যক্তিদের সম্পর্কে এ ধরনের রসাল কেচ্ছা পছন্দ করে।
ফজিলতুননেসা বিলেতে পড়তে যান কলকাতা হয়ে। বিলেত পড়াশোনার বৃত্তি জোগাড় করেছিলেন মোহামেডান এডুকেশনের এ ডি পি ই খান বাহাদুর আহসানউল্লাহর সহায়তায়। তার পুত্র শামসুদ্দোহাও ফজিলতুননেসার সঙ্গে বিলেত যান এবং পরবর্তী সময়ে শামসুদ্দোহার সঙ্গে ফজিলতুননেসা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ফজিলতুননেসার বিলেতযাত্রার সংবর্ধনার জন্য ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন যে আয়োজন করেছিলেন তার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী ছিলেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন। তিনি সদ্য স্ত্রীবিয়োগের পর কলকাতায় গিয়ে চাকরি নিয়েছেন ‘সওগাত পত্রিকায়’। নিজের কথার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেই ঘটনারও যৎকিঞ্চিত বিবরণ তুলে ধরেছেন তার আত্মস্মৃতিমূলক গ্রন্থে-
“আমি সওগাতে গিয়ে নাসিরুদ্দীন সাহেবের সাথে দেখা করলাম। দেখলাম, সাপ্তাহিক সওগাত প্রকাশের তোড়জোড় চলছে। তিনি আমাকে মাসিকের সাথে সাথে সাপ্তাহিকেও কাজ করতে বললেন। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে ওয়াজেদ মিয়ার উদ্যোগে সাপ্তাহিক সওগাত বেরোল। আমিও সম্পাদকীয় বিভাগে যোগ দিলাম। আরো একজনকে সম্পাদকীয় বিভাগে নেওয়া হলো। তিনি কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র। আমি ও প্রেমেন সম্পাদকীয় নোট লিখতাম। ওয়াজেদ মিয়া সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখতেন। তিনজনে মিলে কাটিং করে সংবাদ চয়ন করতাম। শুধু আমরা নই, নজরুল ইসলামের ওপরও সাপ্তাহিকের একটা বিভাগের ভার ছিল। তিনি লিখতেন অমøমধুর চানাচুর। সাপ্তাহিক সওগাত অল্পদিনের মধ্যেই জনপ্রিয় কাগজ হয়ে উঠল। একদিন নাসিরুদ্দীন সাহেব বললেন, মিস ফজিলতুননেসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে অঙ্কে এমএসসি পাস করে বিলেত যাচ্ছেন। তিনি কলকাতা এসে ‘সওগাত’ অফিসে উঠবেন। আমার মনে হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিলাতযাত্রী প্রথম মুসলিম মহিলা শিক্ষার্থী হিসেবে তাকে আমাদের তরফ থেকে অভিন্দন দেওয়া উচিত। আপনারা কি বলেন? নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী তখন সওগাত অফিসেই ছিলেন। আমিও ছিলাম। আমরা সবাই একযোগে নাসিরুদ্দীন সাহেবের প্রস্তাবে সমর্থন জানালাম। স্থির হলো, এই উপলক্ষে নজরুল ইসলাম একটি গান রচনা করবেন এবং সংবর্ধনাসভায় সে গান স্বয়ং কবিই গাইবেন। আরো স্থির হলো, সংবর্ধনাসভায় কয়েকজন সাহিত্যিক ও কিছুসংখ্যক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে দাওয়াত করা হবে এবং মধুরেণ সমাপয়েতের জন্য তাতে কিছু জলযোগের ব্যবস্থাও থাকবে।...পরদিন বিকেলের দিকে সওগাত অফিসেই সংবর্ধনা-বৈঠক বসল। আগের দিন রাতেই মিস ফজিলতুননেসা সওগাত অফিসে পৌঁছেছিলেন। সভায় কয়েকজন বক্তা মিস ফজিলতুননেসার কৃতিত্বের প্রশংসা করলেন এবং বিলাতযাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম মহিলা-শিক্ষাার্থিনীর সাফল্য কামনা করলেন। মিস ফজিলতুননেসা তাকে এই সংবর্ধনা জ্ঞাপনের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানালেন। নজরুল ইসলাম এই উপলক্ষে স্বরচিত সংগীত গাইলেন।...নজরুলের এ সময়োপযোগী গান ও দরাজ কণ্ঠ উপস্থিত সবাইকে কিছুক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখল। তারপর চা-মিষ্টিতে অনুষ্ঠানের মধুর সমাপ্তি হলো।’ নজরুলের জীবনে সে সময় প্রচণ্ড আর্থিকসংকট নেমে আসে । এর অল্প কিছুকাল আগে তিনি প্রাদেশিক নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। তার কোনো আয়ই তখন ছিল না। সে কারণে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিদারুণ কষ্টের মাঝে নাসিরুদ্দীনের সওগাত পত্রিকায় পাঁচ-ছয়টি শর্তে চাকরিতে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। যে শর্তেই হোক তার কিছু উপার্জন করা তখন অনিবার্য ছিল। আবুল কালাম শামসুদ্দীনের বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে, চাকরির কাজ হিসেবেই সবাই এই সংবর্ধনায় যোগদান করেছিলেন।”
পরোক্ষ এই প্রেমপত্রগুলোর কয়েকটি সৈয়দ আলী আশরাফ ১৯৪৯ সালের এপ্রিলে ‘দিলরুবা’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। পরবর্তী সময়ে পুস্তকাকারে বের করেন ‘নজরুল জীবনে প্রেমের এক অধ্যায়’ নামে আটটি চিঠি। তারপর স্মৃতিপটে নজরুল নামক এক প্রবন্ধে কাজী মোতাহার হোসেন ফজিলতুননেসার সঙ্গে নজরুলের দেখা হওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে কিছু কথা লিখে বিষয়টিকে ধোঁয়াশা করে তোলেন। সেই থেকে এ বিষয়টি নজরুল জীবনের সঙ্গে কালিমালিপ্ত হয়ে থাকে। তিনি লেখেন, নজরুল ইসলাম কিছু কিছু জ্যোতিষী জানেন এবং হস্তরেখা দেখে ভাগ্য গণনা করতে পারেন, আমার কাছ থেকে এ-কথা শুনে ফজিলতুননেসা নজরুলের কাছে হাত দেখাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।...বর্ধমান হাউসে আমার ভাই-বোনসহ অনেক লোক থাকায় আমিও বাইরের ছোট ঘরটায় নজরুলের সঙ্গেই এক বিছানায় শুয়ে রাত কাটাতাম। একদিন প্রাতে উঠে দেখি নজরুল বিছানায় নেই। ব্যাপার কী? পরে অনেক বেলাতে জানা গেল কখন যেন তিনি আলগোছে উঠে চলে গিয়েছিলেন দেওয়ান বাজার রাস্তার ওপর অবস্থিত ফজিলতুননেসার গৃহে। এরপর আরো যেসব কথা তিনি লিখেছেন সেগুলো নজরুলকে মহিমান্বিত করেনি এবং ফজিলতুননেসা যে তার স্নেহভাজন ছাত্রী ছিলেন, সেটা ভাবতেও মনে খটকা লাগে। নজরুল চিরতরে নির্বাক ও চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলার পর ফজিলতুননেসাকে উদ্দেশ করে কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখা নজরুলের পরোক্ষ প্রেমপত্রের বিষয়টি দূষিতভাবে উপরোক্ত দুজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির মাধ্যমে প্রচারিত হয়। চিঠিগুলো রচনাবলিতে আছে, আগ্রহীরা পড়ে দেখলেও বুঝতে পারবেন এই প্রেমের কেচ্ছার মাঝে আসলে কী ছিল।