Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

‘পদ্মপুরাণ’ পাঠের আসর বিরল হয়ে যাচ্ছে

Icon

সঞ্জয় সরকার

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২৫, ১৬:৩৭

‘পদ্মপুরাণ’ পাঠের আসর বিরল হয়ে যাচ্ছে

পদ্মপুরাণ পাঠের আসর

হাওরের গ্রাম। চারদিকে বর্ষার থইথই পানি। ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের গর্জন। কৃষিকাজের ব্যস্ততা নেই। নৌকা ছাড়া কোথাও যাবার উপায় নেই। আছে শুধু অখণ্ড অবসর। আর অবসর কাটানোর মোক্ষম উপায় হিসেবে আছে পুঁথিপাঠ, পদ্মপুরাণ পাঠ, বৈঠকী গান, ধামাইল গান ইত্যাদি নানা অনুষঙ্গ। বর্ষায় হাওর গ্রামে কান পাতলেই শোনা যায় নানান সুর। নিভৃত পল্লীর গহিন থেকে উৎসারিত সেই সব সুরের মহিমা যে কত মোহনীয়, কত মাধুর্যমণ্ডিত, তা সেই পল্লীর বাসিন্দারা ছাড়া আর কে জানেন? 

বর্ষার শ্রাবণে হাওরের হিন্দুপল্লীর বাড়িতে বাড়িতে পাঠ করা হয় পদ্মপুরাণ। পদ্মপুরাণ মূলত মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য, যাকে বলা হয় ‘মনসামঙ্গল’। ‘সর্পদেবী’, ‘বিষহরি’, ‘পদ্মা’ প্রভৃতি নামে পরিচিতি পৌরাণিক দেবী মনসাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছিল এই আখ্যানকাব্য। কাব্যের মূল কাহিনিটি এ রকমÑচম্পক নগরের অধীশ্বর চাঁদ সদাগর (চন্দ্র সদাগর)। শিবের বরে মহাজ্ঞান প্রাপ্ত। শিব ছাড়া আর কারো পূজা করেন না। কিন্তু দেবী মনসা তার পূজা চান। সদাগর তা প্রত্যাখ্যান করেন। পরিণামে মনসা কুপিত হন। বাণিজ্যতরী সপ্তডিঙা ডুবিয়ে তাঁকে সর্বস্বান্ত করেন। সর্পদংশনে ছয় পুত্রকে হত্যা করেন। চাঁদের সর্বশেষ পুত্র ছিল লখিন্দর (লখাই), বেহুলার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাদের জন্য বিশ্বকর্মাকে দিয়ে লোহার বাসরঘর বানানো হয়, যাতে সাপ ঢোকার মতো কেনো ছিদ্র না থাকে। কিন্তু গোপনে মনসার নির্দেশে ঠিকই একটি ছিদ্র রাখা হয়। ছিদ্রপথে কালনাগিনী ডুকে লখিন্দরকে দংশন করে। বেহুলা কলার মান্দাসে (ভেলায়) স্বামীর মরদেহ নিয়ে যাত্রা করেন মনসার উদ্দেশে। বহু বিপদ পেরিয়ে দেবীর কাছে পৌঁছে তাকে নৃত্যে তুষ্ট করেন। তখন দেবতাদের পরামর্শে লখিন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে দেন পদ্মা। এদিকে বেহুলার সতীত্বের মহিমায় মুগ্ধ দেবতারা চাঁদ সদাগর ও দেবী পদ্মা বা মনসার পূজা করেন। মর্ত্যবাস শেষে বেহুলা-লখিন্দর আবার ইন্দ্রসভায় চলে যান।

হাওর একটি সর্পসংকুল এলাকা। সেখানকার হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, সমস্ত সর্পকূল দেবী মনসার অনুসারী। মনসা বা পদ্মাকে তুষ্ট করলেই সাপসহ ভয়ংকর সব সরীসৃপের উপদ্রব থেকে মুক্ত থাকা যায়। তাই তারা প্রতিবছর শ্রাবণ মাসের শেষ দিনে মনসার পূজা করেন। তবে শুধু হাওরেই না, দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও এই পূজা হয়। বিশ্বাস ওই একটাই। কিন্তু হাওরাঞ্চলে এই পূজার প্রচলন ঘরে ঘরে। আর মনসা পূজার একটি অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ হচ্ছে ‘পদ্মপুরাণ’ বা ‘মনসামঙ্গল’ পাঠ। মনসামঙ্গলের আদি কবি কানাহরি দত্ত। হাওরের কোথাও কোথাও নারী-পুরুষ-শিশু-কিশোর সবাই একসঙ্গে আসরে বসে ঢোল-করতাল সহযোগে পদ্মপুরাণ পাঠ করেন। সাধারণত বিকেল বা সন্ধ্যার পর বসে পদ্মপুরাণের আসর।

আগে শ্রাবণের প্রথম দিন থেকেই পদ্মপুরাণ আগের মতো না পারলেও অন্তত দু-চারজন নারী বা পুরুষ মিলে ঐতিহ্যটি রক্ষার চেষ্টা করেন। তাই শ্রাবণের বিকেলে বা সন্ধ্যায় সেসব শহরের অলিগলিতে গেলেও হঠাৎ ভেসে আসে সেই মোহনীয় সুর, ‘নাম গো মনসা দেবী/ শঙ্কর দুহিতা/ জরুৎকারু মুনিপত্নী/ আস্তিকের মাতা।’ কিন্তু ভার্চুয়াল মিডিয়ার এ যুগে এসে আজ বলতেই হচ্ছে, পদ্মাপুরাণ পাঠের আগের জৌলুস আর নেই। পাঠক-গায়কও নেই তেমন। চিরায়ত লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যের এই ধারাটি বিলুপ্ত হতেও যেন বাকি নেই খুব বেশিদিন।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫