Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ : বিশ্ববরেণ্য সংগীতজ্ঞ

Icon

এস ডি সুব্রত

প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭:১৫

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ : বিশ্ববরেণ্য সংগীতজ্ঞ

বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল এক সংগীত সাধকের নাম ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। ভারতীয়  উপমহাদেশের ধ্রুপদি সংগীত জগতের অমর শিল্পী। ভারতীয় উপমহাদেশের রাগসংগীতকে পাশ্চাত্যের শ্রোতাদের কাছে পরিচিত করানোর জন্য তিনি  অসামান্য অবদান রেখেছেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সেতার, সানাই ও রাগসংগীতের ওস্তাদ হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত একটি নাম। তিনি ১৮৬২ সালের ৮ অক্টোবর তৎকালীন ত্রিপুরা প্রদেশের শিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, যা বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলায় অবস্থিত।  পিতা সবদর হোসেন খাঁ ওরফে সদু খাঁও ছিলেন একজন নামকরা সংগীতজ্ঞ। মায়ের  নাম সুন্দরী বেগম। তার সংগীতগুরু ছিলেন আগরতলা রাজদরবারের সভাসংগীতজ্ঞ তানসেনের কন্যাবংশীয় ওস্তাদ কাশিম আলী খাঁ। তার ডাকনাম ছিল ‘আলম’।  শৈশবে প্রকৃতির মাঝেই তিনি খুঁজে বেড়াতেন সুর। সংগীতের সেই অন্বেষণ থেকেই একটা সময় হয়ে উঠেছিলেন সুরসম্রাট।

বাল্যকালে অগ্রজ ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁর কাছে সংগীতে তার হাতেখড়ি। একসময়  কলকাতা গিয়ে তিনি প্রখ্যাত সংগীত সাধক গোপাল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য ওরফে নুলো গোপালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তবে গোপাল কৃষ্ণ একটি শর্তারোপ করলেন আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণের সময় যে, কমপক্ষে ১২ বছর একনাগাড়ে সংগীত সাধনা করতে হবে সেখানে থেকে। আলাউদ্দিন খাঁ রাজি হয়ে গেলেন আরোপিত শর্তে। কিন্তু সাত বছরের শেষ দিকে হঠাৎ প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন সংগীত সাধক গোপাল কৃষ্ণ।

সেই শোকে স্তব্ধ হয়ে আলাউদ্দিন খাঁ হঠাৎ করেই কণ্ঠ সংগীত সাধনা ছেড়ে দেন এবং যন্ত্রসংগীত সাধনায় নিজেকে নিমগ্ন করেন। স্টার থিয়েটারের সংগীত পরিচালক অমৃত লাল দত্ত ওরফে হাবু দত্তের কাছে তিনি বাঁশি, পিকলু, সেতার, ম্যাডোলিন, ব্যাঞ্জু ইত্যাদি দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখেন। সেই সঙ্গে তিনি লবো সাহেব নামের এক গোয়ানিজ ব্যান্ড মাস্টারের কাছে পাশ্চাত্য রীতিতে এবং বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ অমর দাসের কাছে দেশীয় পদ্ধতিতে বেহালা শেখেন। এ ছাড়া হাজারী ওস্তাদের নিকট মৃদঙ্গ ও তবলা শেখেন। এভাবে তিনি সর্ববাদ্য বিশারদ হয়ে ওঠেন। ১০ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে এক যাত্রা দলের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। এক সময় ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদার জগকিশোর আচার্যের আমন্ত্রণে তার দরবারে সংগীত পরিবেশন করতে গিয়েছিলেন। সেখানে ভারতের বিখ্যাত সরোদবাদক ওস্তাদ আহমেদ আলী খাঁর বাদন শুনে সরোদের প্রতি আকৃষ্ট হন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। তার কাছে পাঁচ বছর সরোদে তালিম নেন।  পরে ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর কাছে সরোদ শেখার জন্য তিনি ভারতের রামপুরে যান।

আলাউদ্দিন তার কাছে ৩০ বছর ‘সেনী ঘরানা’ সংগীতের অত্যন্ত দুরূহ ও সূক্ষ্ম কলাকৌশল আয়ত্ত করেন। ১৯১৮ সালে তিনি মধ্য প্রদেশের মাইহার রাজ্যে যান। সেখানকার রাজা ব্রিজনারায়ণ আলাউদ্দিন খাঁকে নিজের সংগীত গুরুর আসনে অধিষ্ঠিত করেন। তখন  তিনি মাইহারে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯৩৫ সালে তিনি নৃত্যাচার্য উদয়শঙ্করের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। উদয়শঙ্কর পরিচালিত নৃত্যভিত্তিক ‘কল্পনা’ শীর্ষক একটি ক্ল্যাসিকধর্মী সিনেমায় আবহসংগীতে সরোদ পরিবেশন করেন আলাউদ্দিন খাঁ। পরে দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে অর্কেস্ট্রার স্টাইলে একটি বাদকদল গঠন করেন, যার  নাম ‘রামপুর স্ট্রিং ব্যান্ড’।

ভারত সরকার ‘সংগীত নাটক আকাদেমি সম্মান’, ‘পদ্মভূষণ’ ও ‘পদ্মবিভূষণ’ পদকে ভূষিত করে এই গুণী সংগীতজ্ঞকে। মাইহার রাজ্যে, ‘মাইহার কলেজ অব মিউজিক’ প্রতিষ্ঠা তার সংগীতজীবনের এক শ্রেষ্ঠ অধ্যায়। বহুমাত্রিক সংগীতযন্ত্রে পারদর্শী আলাউদ্দিন খাঁ সরোদে বিশেষভাবে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। সহজাত প্রতিভা গুণে তিনি সরোদ বাদনে ‘দিরি দিরি’ সুরক্ষেপণের পরিবর্তে ‘দারা দারা’ সুরক্ষেপণ-পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। সেতারে সরোদের বাদন প্রণালি প্রয়োগ করে সেতার বাদনেও তিনি আমূল পরিবর্তন আনেন। এভাবে তিনি সংগীত জগতে এক নতুন ঘরানার প্রবর্তন করেন, যা ‘আলাউদ্দিন ঘরানা’ বা ‘মাইহার ঘরানা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৭২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ১১০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫