Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

সাহিত্যে শরৎ

Icon

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৩:১৩

সাহিত্যে শরৎ

ঋতু পরিক্রমায় শরৎকাল আপন মহিমায় হাজির হয় আমাদের সামনে। নানাবিধ রূপের ছটায় থমকে দাঁড়ায় পথিকবর। আটষট্টি হাজার গ্রামবাংলার সবুজ-শ্যামল রূপ কবিদের মনেও আনন্দের হিল্লোল বয়ে আনে। শিল্পীর কণ্ঠে আনে গান। চিত্রকরের তুলিতে আনে বর্ণিল আবহ। কৃষকের মনে আনে প্রশান্তি।

প্রকৃতিতে শরৎ ঋতুর আলাদা বৈশিষ্ট্য হাজির হয়। শরৎকাল যেন ঋতুবৈচিত্র্যের অপার বিস্ময়। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে ভাদ্র ও আশ্বিন মাস শরৎকাল। ছয়টি ঋতুর মধ্যে তৃতীয় ঋতু। শরৎ তার আপন মহিমায় সবার অন্তরে জায়গা করে নেয়। জায়গা করে নেয় কবি-লেখকদের অন্তরে। মহাকবি কালিদাস শরতের রূপ-সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘প্রিয়তম আমার, ঐ চেয়ে দেখ,/ নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত।’ কালিদাসই নন; বাংলা সাহিত্যের আদি মধ্যযুগের কবি চণ্ডীদাসের কবিতায়ও শরৎকে তুলে ধরা হয়েছে। কবি শরতের প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন এভাবে-‘ভাদর মাসে অহোনিশি অন্ধকারে।/ শিখি ভেক ডাহুক করে কোলাহলে/ তাওনা দেখিব যবে কাঞ্চির মুখ/ চিন্তিতে চিন্তিতে মোর ফুটি জায়ির বুক।’ মহাকাব্য পদ্মাবতীর কবি আলাওল তার কাব্যের ‘ষট ঋতু বর্ণন খণ্ডে’ শরতের রাতযাপনের এক মিলনমধুর দৃশ্যের অবতারণা করেছেন। কবি বলেছেন, ‘আইল শরৎ ঋতু নির্মল আকাশ।/ দোলায় চামর কাশ কুসুম বিকাশ।’

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি,/ ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি।/ শরৎ, তোমার শিশির-ধোয়া কুন্তলে/ বনের-পথে-লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে/ আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।’ এভাবেই বাঙালির সামনে শরতের সৌন্দর্য উপস্থাপন করেছেন কবিগুরু। অন্যত্র শরতের বর্ণনা দিয়ে কবিগুরু পঙ্‌ক্তিমালা সাজিয়েছেন এভাবে-‘আজিকে তোমার মধুর মুরতী/ হেরিণু শরৎ প্রভাতে/ হে মাত বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ/ ঝরিছে অনল শোভাতে।’ এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাচীন গ্রন্থ ‘কুশজাতক’ কাহিনি অবলম্বন করে ‘শাপমোচন’ নৃত্যনাট্যও রচনা করেছেন।

শরতের সৌন্দর্য বর্ণনায় পিছিয়ে নেই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও। তিনি বলেছেন, ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলী বিছানো পথে/ এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ কিরণ রথে-’। জাতীয় কবির এমন কথামালা শরতের সৌন্দর্যেরই মূর্তিমান বহিঃপ্রকাশ। তিনি শরতের শিউলি ফুল নিয়ে গেয়েছেন, ‘শিউলী ফুলের মালা দোলে/ শারদ রাতের বুকে ঐ।’ 

জীবনানন্দ দাশ এ ঋতুর চরিত্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন প্রিয়তমাকে। তিনি তার ‘এখানে আকাশ নীল’ কবিতায় লিখেছেন, ‘এখানে আকাশ নীল/ নীলাভ আকাশজুড়ে শজিনার ফুল/ ফুটে থাকে হিম শাদা/ রং তার আশ্বিনের আলোর মতন।’ এ ছাড়া জনপ্রিয় বাংলা গানও রয়েছে শরৎ বন্দনার। উৎপল সেন লিখেছেন, ‘আজি শরতের আকাশে মেঘে মেঘে স্বপ্ন ভাসে।’

কবি-সাহিত্যিকরা শরৎকে বলেছেন শুভ্রতার প্রতীক! শরতের স্নিগ্ধতা এককথায় অসাধারণ! তন্বী মজুমদার বলেছেন, “অনুপম রূপ সৌন্দর্যময়-স্ফীত শরৎ ঋতু ‘শারদ লক্ষ্মী’ নামে পরিচিত। বর্ষণবিধৌত, মেঘমুক্ত আকাশের সুনীল রূপ-কান্তি, লঘুভার মেঘের অলস-মন্থর নিরুদ্দেশ যাত্রা, আলো-ছায়ার লুকোচুরি, শিউলি ফুলের মন উদাস করা গন্ধ, প্রভাতের তৃণ-পল্লবে নবো শিশিরের আল্পনা, তাতে প্রভাত-সূর্যের রশ্মিপাত ও শুভ্র জোছনা পুলকিত রাত্রি-এই অনুপম রূপ নিয়ে বাংলার বুকে ঘটে শারদ লক্ষ্মীর আনন্দময় আবির্ভাব।”

কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘শরৎ যে এত সুন্দর আগে হয়তো বাঙালি জানতোও না। রবীন্দ্রনাথই তার গান, কবিতার মাধ্যমে সবাইকে শরৎকাল উপভোগ করতে শিখিয়েছেন। তাঁর গানগুলো শুনলেই শরতের সব সৌন্দর্য ধরা পড়ে।’ তিনি আরো বলেন, ‘গ্রামের বধূ যেমন মাটি লেপন করে নিজ গৃহকে নিপুণ করে তোলে, তেমনি শরৎকাল প্রকৃতিকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়। বর্ষার পরে গাছগুলো সজীব হয়ে ওঠে। আকাশে হালকা মেঘগুলো উড়ে উড়ে যায়।’ শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে শরৎ বিশাল প্রভাব ফেলে। তাই তো শরতের সৌন্দর্য বর্ণনায় কবি ভবানী প্রসাদ মজুমদার লিখেছেন, ‘শরৎ এলো কী উল্লাসে কাঁপছে নদীর জল/ পাখনা মেলে বেড়ায় খেলে প্রজাপতির দল,/ বাজলো কাঁসর সাজলো আসর চলরে সবাই চল/ মন-গালিচায় বন গালিচায় নামলো খুশির ঢল।’ সুতরাং কাশবন, নীল আকাশ, সাদা মেঘ, সবুজ মাঠ, ফুলের সৌরভ-সবই তো শরতের উপাদান। অন্য সব ঋতুর মাঝেও শরতের আবেদন অস্বীকার করার উপায় নেই।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫