Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

আবদুল মান্নান সৈয়দ : আত্মস্বীকারোক্তিই তার কবিতা

Icon

মামুন রশীদ

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:০৪

আবদুল মান্নান সৈয়দ : আত্মস্বীকারোক্তিই তার কবিতা

বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ শুরুতেই চমকে দিয়েছিলেন বাংলা কবিতার পাঠককে। কারণ তার পরাবাস্তব কবিতা। জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ, পার্ক স্ট্রিটে এক রাত্রি, কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড, সকল প্রশংসা তাঁর, আমার সনেট-এসব কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়ে বাংলা কবিতায় তিনি নিজের জন্য আলাদা আসন তৈরি করতে সক্ষম হন। বাংলা পরাবাস্তব কবিতার ধারায় আবদুল মান্নান সৈয়দের জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছই প্রথম সচেতন ধারা। আবদুল মান্নান সৈয়দ তার ভঙ্গিটি বাংলা কবিতার পাঠকদের চিনিয়েছেন পরাবাস্তব কবিতা দিয়ে। কবিতায় তিনি যে প্রতিভা এবং পরিশ্রম ঢেলে নিজেকে নির্মাণ করেছেন, সেখানে পাঠক-সমালোচক তাকে খুঁজে পেয়েছে পরাবাস্তবতার আয়নায়। উপমা, চিত্রকল্প, শব্দব্যবহার এবং পঙ্্ক্তি নির্মাণে তিনি নিঃসন্দেহে নতুনত্ব দিয়ে ভুলিয়েছেন, যা তাকে ‘সার্বভৌম কবি’ হিসেবেও চিহ্নিত করেছে। ষাটের দশকে বাংলাদেশের কবিতায় যে রাজনীতিমুখীনতা, তাৎকালীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে বেড়ে ওঠা কবিরা স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন কবিতায়। যার ফসল জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ। 

আবদুল মান্নান সৈয়দ বলতেই জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ বা পরাবাস্তব কবির তকমা আঁটা একটি অবয়ব ভেসে উঠলেও তিনি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেননি। প্রতিনিয়ত নদীর পাড় ভাঙার মতো করে ভেঙেছেন, নতুন করে নিজেকে নির্মাণ করেছেন। আর এই ভাঙা ও নির্মাণের মধ্য দিয়েই প্রতিভাষিত হয়েছে তার বহুমাত্রিকতা। তিনি প্রকাশিত হয়েছেন বর্ণিল রূপে। এই বর্ণিলতা তার প্রেমের কবিতার ক্ষেত্রেও। নির্দিষ্ট করে বললে, সচেতনভাবে তিনি যেমন পরাবাস্তব কবিতা লিখেছেন, তেমনি প্রেমের কবিতাও লিখেছেন। প্রেমকে তিনি জীবনের অপরিহার্য উপাদান হিসেবেই দেখেছেন। প্রেমের শাশ্বত রূপ তার কাছে ধরা দিয়েছে চিরন্তন ও সর্বজনীন হয়ে। কারণ প্রেম দেহহীন, কালহীন। ‘প্রেমেতে মজিলে মন কিবা হাড়ি কিবা ডোম’ এই বিশ্বাসে প্রেমের সর্বব্যপ্ত রূপ ধরা দিয়েছে আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রেমের কবিতায়। বিজয়া, আমি তো বলব : তুমি ফের হয়েছ আঠারো,/জাদুমন্ত্রবলে আমি পৌঁছে গেছি আমার একুশে।/ বিজয়া, তাহলে তুমি এইবার দয়া করতে পারো,/ অবিচ্ছিন্ন হবো না আর জীবনের অসংখ্য অঙ্কশে।/ আমরা আর কোনো দিন বিচ্ছিন্ন হবো না পরস্পর।/ কোনো দিন আমরা আর পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবো না।/ তুমি হাস্যময়ী। আমি লিখে যাব লক্ষ অক্ষর।/ তুমি ঘুরবে আশেপাশে। আমি করব তোমাকে রচনা।/  (আবার) আব্দুল মান্নান সৈয়দের কবিতা স্পর্শযোগ্য। মনকে আবেগে আপ্লুত করে। জীবনকে, বাস্তবকে তিনি শব্দে রূপ দেন। তাই তার পরাবাস্তব কবিতায়-বিশেষত জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছে যেমন নিজেকে আড়াল করে ফেলেন কবিতা থেকে, পাঠক সেখানে আমিত্ব থাকলেও ব্যক্তি আবদুল মান্নান সৈয়দকে খুঁজে পায় না। খুঁজে পায় রহস্যময়তা, খুঁজে পায় দুর্বোধ্য এক আবদুল মান্নান সৈয়দকে।

কিন্তু প্রেমের কবিতার ক্ষেত্রে তিনি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। এখানে অবলীলায় উন্মোচন করেন নিজেকে। কোনো কুয়াশা, কোনো আড়াল তাকে আচ্ছন্ন করে না। ফলে পাঠক প্রেমের কবিতায় পেয়ে যায় আলোর ঝিলিক। নারী-পুরুষের প্রচলিত সম্পর্ককেই সহজ ও সুন্দর করে উপস্থিত করেন তিনি। এ ক্ষেত্রে-‘এই আমি বুঝলাম চোখ-/ ঝরে পড়বে পলাশ- অশোক?/ এই আমি ঠোঁট খুললাম-/ পাব নাকি আশ্চর্য আকাশ?/ চোখ খুলে দেখি হাসছে একজন-/ মেয়েটি তো ভারী দুষ্টু, দুর্জন’ (চোখ) প্রেমের কবিতা রচনার ক্ষেত্রে আবদুল মান্নান সৈয়দের কাব্যভাষায় অলঙ্কারের আতিশয্য নেই, তিনি বরং এ ক্ষেত্রে সরল ও গতিশীল। তবে শব্দ প্রয়োগে তিনি যেমন বরাবরই সংযমী ও রুচিশীল, সে ভাব বজায় রাখেন আগাগোড়া। তার প্রেমের কবিতামাত্রই আবেগাক্রান্ত। তিনি নিঃসঙ্কোচে যেমন যৌনচেতনাগন্ধী শব্দ ব্যবহার করেছেন, তেমনি আত্মস্বীকারোক্তিতে প্রেম ও নারীকে বর্ণনা করেছেন। সেখানে অন্তর্মুখিতা নয়, বরং বিবৃতিমূলক ও আত্মস্বীকারোক্তিই হয়ে উঠেছে তার প্রেমের কবিতা।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫