
পেছনের দিকে খুব বেশি না এই ২০ বছর আগে ফিরে গেলে যমুনা পারের সংস্কৃতির ওই শৈশব ভেসে উঠবে রূপ কথার গল্পের মতো। সে সময় কেরোসিন তেলের গন্ধ ও কুপি বা হারিকেনের আলোতে শুরু হতো শিশু-কিশোরদের সন্ধ্যা। কখনো কখনো গ্রামে যাদের বাড়ির উঠান বড় তাদের বাড়িতে বায়োস্কোপ নিয়ে আসত মুক্তিযোদ্ধা তোতা মিঞা-দুই টাকা করে দিয়ে বাক্সের ভেতরে চোখ রাখলে অনেক ছবি দেখা যেত। তোতা মিঞা সুর করে করে বলত, তার পরেতে কি হইল শোনেন দিয়া মন, সুন্দর সুন্দর কাহিনি নিয়া আজকের আয়োজন। এই কাহিনি দেখতে ‘হোইলে উত্তর পাড়া আইসেন/আরাম কোইরা এইখানে একটু চোখটা রাইখেন।’
শীত পড়তেই আসত যাত্রাপালা। দুই ধরনের যাত্রা হতো। একটা এলাকার লোকেরা মিলে করত। অন্য জায়গা থেকে আসত দল। টিকিট কেটে যাত্রা শুনতে যেত সবাই। শশীবাবুর সংসার, মন্দির থেকে মসজিদ কত নাট্যপালা হতো। দিনে তার মাইকিং হতো, মাইকিংয়েও অভিনবত্ব ছিল। যাত্রার কনসার্ট শুনলেই মন অন্যরকম হয়ে যেত। যাত্রা শেষ হতে ভোর হতো। তারপর সবাই ফিরত ঘরে। কখনো আসত পুতুল নাচ, সার্কাস-এসব দেখার জন্য কিশোর-কিশোরীদের দৌড়ঝাঁপের অন্ত ছিল না। মুরব্বিদের কাছ থেকে টাকা এনে পুতুল নাচ দেখতে হতো। সুতোয় বাঁধা পুতুল দিয়ে কত কি করানো হতো। পুতুলের কথা যে পুতুল বলে না, তা বোঝাই যেত না। সার্কাস ছিল অভাবনীয় শরীর কসরতের কাজ। একটা দড়ির ওপর দিয়ে একটা মানুষ হাঁটা, এক দড়ি থেকে লাফ দিয়ে আরেক দড়ি ধরা কি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, ভয়ে গুটিশুটি হয়ে যেতে হতো। একটি গোলকের ভেতরে সাইকেল চালানো বা ভালুক -হাতির খেলা ছিল খুবই মনোহর। ধান ওঠার পরে লাঠি খেলার আয়োজন হতো। লাঠি নিয়ে গ্রাম বাংলার কি সুন্দর আয়োজন। কেউ কারো গায়ে মারত না। বাদ্যের তালে তালে চলত লাঠি খেলা। জারি গানের জল জারি গাইত। হিন্দু পাড়ায় কীর্তন চলত, আসত রামযাত্রা, সেসব কথা আজও ভোলার নয়। যমুনা পারের জনপদে আজও টিকে আছে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য ধারার
বেহুলা-লখিন্দরের লোকপালা। উজানে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে ভাটিতে পদ্মা-যমুনার সঙ্গমস্থল গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত জনমানসে টিকে আছে এই লোককথা। গানের নতুন সুরারোপে, ভিন্ন মাত্রার নৃত্য ও বাদ্যে, সুখপ্রিয় পয়ার বর্ণনায়, ব্যতিক্রম উপস্থাপনায় এবং শৈল্পিক আঙ্গিক সৌষ্ঠবে ডিজিটাইজেশনের ছোঁয়া পেয়েছে দলের উপস্থানায়। তাই নতুন প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ডিজিটাল বেহুলা। সিরাজগঞ্জ-টাঙ্গাইল ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা বেহুলা মঞ্চস্থ করেন।
বন্যার পানি কমে গেলে বিলের খালে জমে থাকা পানিতে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মাছ ধরার নাম বাউত উৎসব। সিরাজগঞ্জের চলনবিল অধ্যুষিত তাড়াশ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর, রায়গঞ্জসহ উপজেলা গুমানি, বড়াল, গোহালা, ফুলজোড়, ইছামতি নদীসহ চলনবিলের সগুনায় কাটাবাড়ি বিল ও গুমানী নদীর মোহনায়সহ পাবনার চাটমোহর ও নাটোরের সিংড়া গুরুদাসপুর তা ছাড়া কামারখন্দ, বেলকুচি উপজেলার বিভিন্ন নদ-নদী, খাল-বিল থেকে বর্ষার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী বাউত উৎসব শুরু হতো। প্রতি বছরে ঢাকঢোল পিটিয়ে উপজেলার বিভিন্ন বিলের পানিতে নেমে ঠেলাজাল, তৈরাজাল, পলো (স্থানীয় ভাষায়) দিয়ে শৌখিন মাছ শিকারিরা মাছ শিকারে মত্ত হয়ে উঠত। উল্লিখিত উপজেলা ছাড়াও বিভিন্ন স্থান থেকে বাউতরা আসছে মাছ শিকারে। এখন জলাশয় মাছশূন্য হয়ে গেছে, আবার মানুষজনও শহরে চলে গেছে। ফলে বাউত উৎসব এখন আগের মতো না হলেও টিকে আছে। বাড়ি ঘেঁষে যে যমুনা জ্যান্ত ছিল, গিলে নিত ভাঙনে বাড়িঘর, যেখানে বাইছের নৌকা অনুশীলন করত, সে যমুনাও এখন স্থির ক্লান্ত। সেখানে শুধু শৈশবের হাহাকার মাখা স্মৃতি। সংস্কৃতির এসব উপাচারগুলো টিকিয়ে রাখা আমাদের স্বার্থেই জরুরি।