আবু হেনা মোস্তফা কামালের সাহিত্যে স্বদেশ প্রেম

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭:২৯

কবি আবু হেনা মোস্তফা কামাল
পঞ্চাশের দশকের কবি আবু হেনা মোস্তফা কামাল বহুমুখী প্রতিভাধর একজন শিক্ষক ও গীতিকবি ছিলেন। তার প্রতিভার স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন অধ্যাপনায়, উপস্থাপনায়, বাগ্মিতায়, প্রবন্ধে ও গীতি কবিতায়। কর্মজীবনের মতো তার ব্যক্তিজীবনও ছিল বর্ণাঢ্য। চার দশকব্যাপী নিজেকে প্রতিনিয়ত ভেঙেছেন, পরিশীলিত ও সমৃদ্ধ করেছেন। কাব্যচর্চা করেছেন আশির দশকের প্রায় শেষ পর্যন্ত। আবু হেনা মোস্তফা কামাল ছিলেন আপাদমস্তক একজন সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব। শৈশব থেকেই লিখতেন। মূলত কবিতা এবং অন্যান্য রচনায়ও তাঁর পদচারণ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ‘সাহিত্য সম্পাদক’ পদে জয়ী হয়েছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আমার জীবনে মোটামুটি দুটি লক্ষ্য ছিল-এক. সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করা এবং আরেকটি অধ্যাপনা করা। দুই দিকেই আমি সাফল্যজনকভাবে এগিয়ে যেতে পেরেছি। আমার প্রথম রচনা ছিল একটি কবিতা, যা গোলাম মোস্তফার ‘নও বাহার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আমি ভবিষ্যতে কবিতা রচনাতেই মনোযোগী হব। তা ছাড়া কিছু সিরিয়াস সাহিত্যকর্ম করার পরিকল্পনাও আছে।’
তবে কবির জীবনকালে মাত্র তিনটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল। বইগুলো হলো ‘আপন যৌবন বৈরী’ (১৯৭৪), ‘যেহেতু জন্মান্ধ’ (১৯৮৪) এবং ‘আক্রান্ত গজল’ (১৯৮৮)। আবু হেনা মোস্তফা কামালের প্রবন্ধের সংখ্যাও খুব বেশি নয়-মাত্র দুটি। অন্যটি গবেষণাগ্রন্থ-‘শিল্পীর রূপান্তর’ (১৯৭৫), ‘কথা ও কবিতা’ (১৯৮১), ‘দ্য বেঙ্গলি প্রেস অ্যান্ড লিটারারি রাইটিং’ (১৯৭৭)। আবু হেনা মোস্তফা কামালের কবিতায় স্বদেশ প্রেম, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশপ্রেমের গভীর প্রকাশ ঘটেছে। যেমন তার ‘ছবি’ কবিতাটি এবং প্রথম কাব্যগ্রন্থে তিনি সদ্যঃস্বাধীন দেশের ছবি এঁকেছেন। পঞ্চাশের দশকের অস্থিরতা, ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধিকার চেতনার প্রেক্ষাপটে তার কবিতায় স্বদেশ প্রেম একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে ওঠে। যেখানে তিনি রোমান্টিকতার মধ্য দিয়ে প্রকৃতি ও দেশপ্রেমের অনুভূতিকে যুক্ত করেছেন। তার স্বদেশ চেতনার একটি বিখ্যাত কবিতা হলো ‘আমার সত্তা’। পঞ্চাশের দশকে ভাষা আন্দোলন, দেশভাগ ও স্বাধিকার চেতনার মতো বিষয়গুলো কবিদের প্রভাবিত করেছিল। আবু হেনা মোস্তফা কামালের কবিতায়ও এ জাতীয় দেশপ্রেমের চেতনা ফুটে উঠেছে। তিনি প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা ও দেশপ্রেমকে একই সূত্রে গেঁথেছেন কবিতায়।
আবু হেনা মোস্তফা কামালের কবিতায় স্বদেশ শুধু একটি ভৌগোলিক ধারণা নয়, বরং এটি তার গভীর অনুভূতি, মুক্তিযুদ্ধ এবং এক নতুন রাষ্ট্রের স্বপ্নের প্রতিচ্ছবি। স্বদেশ প্রেমে নিমজ্জিত কবি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থে সদ্যঃস্বাধীন দেশের ছবি আঁকেন অতুলনীয় এক শব্দতুলিতে। প্রদীপ্ত উচ্চারণে কবি যখন বলেন, ‘আপনাদের সবার জন্যে এই উদার আমন্ত্রণ/ ছবির মতো এই দেশে একবার বেড়িয়ে যান।/ রঙের এমন ব্যবহার, বিষয়ের এমন তীব্রতা/ আপনি কোনো শিল্পীর কাজে পাবেন না, বস্তুত শিল্প মানেই নকল নয় কি?/’
কবিতা ও প্রবন্ধের পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্রের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। যেসব চলচ্চিত্রের জন্য গান লিখেছেন, তা হলো-‘দর্পচূর্ণ’, ‘যোগবিয়োগ’, ‘অনির্বাণ’, ‘অসাধারণ’, ‘কলমীলতা’, ‘সমর্পণ’ ইত্যাদি। মুস্তফা আনোয়ার পরিচালিত ‘অসাধারণ’ ছবির চিত্রনাট্য তার লেখা। তিনি ১৯৬৯, ১৯৭০-এর উত্তাল দিনগুলোর আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলেন। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রামে ছিলেন। অর্ধশতকের সামান্য একটু বেশি সময় তিনি ইহজাগতিক পরিভ্রমণে এসেছিলেন। ক্ষুদ্র একজীবন সাহিত্যচর্চা করে তিনি ১৯৮৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। তার ৩৬তম প্রয়াণবার্ষিকীতে জানাই গভীর শ্রদ্ধা। আবু হেনা মোস্তফা কামালের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৩ মার্চ। শৈশব কেটেছে পাবনার উপকণ্ঠে গোবিন্দা গ্রামে ইছামতী নদীর তীরে। নানা আয়েনুদ্দিন বিশ্বাস ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাবনা জমিদারি এস্টেটের নায়েব। এমন প্রাকৃতিক পরিবেশে বড় হয়েছিলেন। তিনি বেড়ে ওঠেন শিক্ষিত মধ্যবিত্তের পরিমার্জিত, পারিবারিক আবহে। অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক চেতনার পরিবেশে।