
প্রতীকী ছবি
ভারতীয় উপমহাদেশে উনিশ-বিশ শতকের প্রায় দুইশ বছরের ব্রিটিশ যুগের শুরুতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতা দখলের পর সব বাংলায় ভয়াবহ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয় নেমে আসে। এ সময় যেসব আন্দোলন-সংগ্রাম ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারমূলক ভাবনা নিয়ে এগিয়ে আসে, ফরায়েজি আন্দোলন তাদের মধ্যে অন্যতম। ফরায়েজি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হাজী শরিয়ত উল্লাহ (১৭৮২-১৮৪০)। তার মৃত্যুর পর নেতৃত্ব হাতে তুলে নেন দুদু মিয়া। ফরায়েজি আন্দোলন মূলত একটি মতবাদ। আরবি শব্দ ফরজ থেকে যার উৎপত্তি। ফরজ পালনকারী সবাই ফরায়েজি। তবে বাংলায় শুধু হাজী শরিয়ত উল্লাহর অনুসারীদেরই ফরায়েজি বলা হতো। ধর্মীয় সংস্কারের পাশাপাশি জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মূল লক্ষ্য হয়ে উঠে।
ফরায়েজি আন্দোলনের সূত্রপাত ফরিদপুর থেকে হলেও ধীরে ধীরে আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্দোলনটি দ্রুতই ঢাকা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, বাকেরগঞ্জ, ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও আসাম অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে হিন্দু জমিদার ও ইউরোপীয় নীলকরদের দ্বারা নিপীড়িত এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ফরায়েজি আন্দোলন।
কৃষিনির্ভর দুর্বল মুসলমানদের ওপর অমানবিকভাবে চাপানো অতিরিক্ত কৃষিকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন হাজী শরিয়ত উল্লাহ। তিনি কৃষকদের এই বাড়তি অবৈধ কর দিতে নিষেধ করেন। ১৮৩৭ সালে জমিদাররা তার বিরুদ্ধে তিতুমীরের মতো আলাদা রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। এমনকি কয়েকবার তাকে পুলিশি হেফাজতেও রাখা হয়। ১৮৪০ সালে তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর ফরায়েজি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তার পুত্র দুদু মিয়া (১৮৪০-১৮৬২)। পিতা হাজী শরীয়ত উল্লাহর মৃত্যুর পর ফরায়েজি আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন দুদু মিয়া। তার অধীনে বাংলা ও আসামের নিপীড়িত জনগণ শক্তিশালী ভ্রাতৃত্ববোধে একতাবদ্ধ হয় ব্রিটিশদের বশংবদ অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য। তখনকার জমিদাররা তাদের প্রভু ইংরেজদের তুষ্ট করে প্রজাদের ওপর নানা নিপীড়নমূলক কর আরোপ করে।
দুদু মিয়ার নেতৃত্বে জনগণ এসব নিপীড়নমূলক কর দিতে অস্বীকার করে। দুদু মিয়া ফরায়েজি আন্দোলনের বিরোধিতাকারী ইংরেজ নীল চাষি ও জমিদারদের মোকাবিলা করার জন্য পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করার ওপর জোর দিয়েছিলেন। এটাকে সফল করার জন্য তিনি কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে একটি লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করেন, যার সাহায্যে বিদেশি সৈনিক, জমিদার ও নীলকরদের ভাড়াটে লোকদের সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত করতে সক্ষম হন। ফলে প্রায় দুই দশক অর্থাৎ ১৮৩৮ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত ফরায়েজি আন্দোলন কৃষক শ্রেণির শোষণ মুক্তির সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত হয়। ইংরেজ শাসকদের শোষণে অতিষ্ঠ ও বিপর্যস্ত বাংলার কৃষক স্বেচ্ছায় এই আন্দোলনে যোগ দেন। ১৮৫৭ সালে ইংরেজরা তাকে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে কারাগারে আটক রাখে। ১৮৬০ সালে তাকে মুক্তি দিলেও তিনি অসুস্থ হয়ে যান। ১৮৬২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
১৮৬২ সালে দুদু মিয়ার মৃত্যু হলে ফরায়েজি আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে তার উত্তরসূরিরা পরপর ধারাবাহিকভাবে আন্দোলনকে কোনো রকম ধরে রাখে। পৃথিবীর সব আন্দোলনই কোনো না কোনো পরিবর্তন দিয়ে যায়। হতে পারে সাময়িক বা দীর্ঘমেয়াদি। আন্দোলনের নেতাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফলতায় না পৌঁছাতে পারলেও সময়ের প্রয়োজনকে বিনা দ্বিধায় সংকোচহীনভাবে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন দুদু মিয়া। যে কারণে আন্দোলন ভিন্নমুখী রূপ নিয়ে কৃষক আন্দোলন ও নীল বিদ্রোহের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ইংরেজ ও জমিদার বিরোধী সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। এককভাবে না হলেও ভারতে ইংরেজদের দীর্ঘ উপনিবেশ পতনে এই রকম সংগঠনগুলোর ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যার জন্য ফরায়েজি আন্দোলনের ঐতিহাসিক মূল্য যথেষ্ট।