Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

মেঘনাদ সাহা

যিনি নক্ষত্রের পথে হেঁটেছিলেন

Icon

আসিফ

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৫, ১৪:২২

যিনি নক্ষত্রের পথে হেঁটেছিলেন

মেঘনাদ সাহা

যখন আমরা আকাশের দিকে তাকাই, অসংখ্য নক্ষত্রের ঝলকানি আমাদের মুগ্ধ করে। কিন্তু সেই আলো শুধু সৌন্দর্য নয়, তা প্রকৃতির এক জটিল ভাষা-তাপ, আয়ন, মৌল ও বিক্রিয়ার। এই ভাষার অনুবাদক একজন বাঙালি বিজ্ঞানী, যিনি দারিদ্র্যের অন্ধকার থেকে উঠে এসে নক্ষত্রের রহস্য উন্মোচনে হেঁটেছিলেন। তিনি মেঘনাদ সাহা-জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানের এক অগ্রপথিক। যিনি সাহা আয়নীভবন সমীকরণ আবিষ্কার করে নক্ষত্রের গঠন ও বৈশিষ্ট্য বোঝার পথ খুলে দেন।

ঢাকার বংশাই নদীর ধারে কালিয়াকৈরের শেওড়াতলী গ্রাম। এখানেই জন্ম বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার এবং এখান থেকেই ১৯০৫ সালে বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। একই বছর বাংলা প্রদেশ বিভাগের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন শুরু হয়, যার প্রভাব এই স্কুলেও পড়ে। বাংলার গভর্নর এই স্কুল পরিদর্শনকালে শিক্ষার্থীরা ধর্মঘট পালন করে। পরিণামে মেঘনাদ সাহা তার সরকারি বৃত্তি হারান এবং স্কুল থেকে বিতাড়িত হন। 

ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে শুরু করে ঢাকা কলেজ, তারপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেন। ১৯১১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইএসসি পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেন।  সেখানে তার সতীর্থ ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নিখিলরঞ্জন সেন, জ্ঞান মুখার্জি, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ এবং তার শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন রসায়নে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, পদার্থবিজ্ঞানে জগদীশচন্দ্র বসু, গণিতে ডি এন মল্লিক ও সি ই ক্যালিস। 

১৯১৭ সালে মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু দুজনেই কলকাতা বিশ্ববিদালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে চলে আসেন। পরবর্তীকালে সি ভি রমনও এই বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। এরও পরে ডি এম বসুও যোগ দেন এখানে। ডি এম বসুই তৎকালীন প্ল্যাংক, আইনস্টাইন, ম্যাক্স বর্ণ, ওয়াল্টার নার্নস্টরের মতো বিজ্ঞানীদের প্রদত্ত কোয়ান্টাম এবং আপেক্ষিক তত্ত্বের তাত্ত্বিক অগ্রগতি ও পরীক্ষণ সম্পর্কে সাহা ও বসু এই দুজনকে অবহিত করেন। ১৯১৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় মেঘনাদ সাহাকে তার বিদ্যুৎ চৌম্বক তত্ত্ব এবং বিকিরণ চাপের ওপর গবেষণার জন্য ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে। এ সময়ই তিনি প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তিও লাভ করেন এবং ১৯২০ সালে এক বছরের জন্য ইংল্যান্ড ও জার্মানি যাওয়ার সুযোগ পান। ১৯২০ সালেই ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিন ‘ঙহ রড়হরুধঃরড়হ রহ ঃযব ঝড়ষধৎ ঈযৎড়সড়ংঢ়যবৎব’ (সূর্যের বর্ণ গোলার্ধে আয়নকরণ) শিরোনামে তার তাপ আয়নকরণ তত্ত্ব প্রকাশিত হয়। 

নক্ষত্রের ভাষা অনুবাদ

মেঘনাদ সাহার সবচেয়ে বিখ্যাত অবদান হলো সাহা আয়নি ভবন সমীকরণ। এই সমীকরণ নক্ষত্রের বর্ণালির বিশ্লেষণে বিপ্লব ঘটায়। বিজ্ঞানীরা এই সূত্র ব্যবহার করে নক্ষত্রের তাপমাত্রা, মৌলিক গঠন ও বিক্রিয়ার প্রকৃতি নির্ধারণ করতে পারেন। মেঘনাদ সাহা দেখালেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসের আয়নি ভবন কিভাবে ঘটে, এটি ছিল জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। এই তত্ত্ব তিনি বার্লিনে উপস্থাপন করেন এবং Zeitschrift für Physik-এ প্রকাশিত হয়, যা তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। ১৯২৭ সালে তিনি Fellow of the Royal Society (FRS)  নির্বাচিত হন একজন ভারতীয় হিসেবে এটি ছিল বিরল সম্মান। 

তার প্রচেষ্টার মধ্যে অন্যতম ছিল : ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স, ইন্ডিয়া (১৯৩১) : ভারতের বিজ্ঞানচর্চাকে সংগঠিত করার প্রয়াস। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস (১৯৩৪)-এর সভাপতির আসনে বসে বিজ্ঞান ও সমাজের সংযোগ স্থাপন। সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স (১৯৫০) : নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানকে গবেষণার কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা।

রাজনীতিতে বিজ্ঞানচিন্তা                                                            

তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত থেকেছেন। সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং বিজ্ঞানকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। উল্লেখ্য, ঢাকায় থাকাকালে তিনি বাঘা যতীন, পুলিন দাস প্রমুখ খ্যাতিমান বিপ্লবীর সংস্পর্শে এসেছিলেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজের মৌলিক পরিবর্তনে আস্থা রাখতেন তিনি। বিজ্ঞানকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য  তিনি সেই ১৯২০ সালেই সত্যেন বোসের সঙ্গে যৌথভাবে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ববিষয়ক একটি বই অনুবাদ করেন।  মেঘনাদ সাহা দেখিয়েছেন, আলো শুধু নক্ষত্রে নয়, মানুষের মনেও জ্বলে, যদি সে জ্ঞানকে আপন করে নেয়। তার স্মৃতিকে ঘিরে তেমন কোনো সংরক্ষিত স্মারক বা জাদুঘর গড়ে ওঠেনি। জাতীয় পর্যায়ে তার জন্মস্থানকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয়নি। এই অবহেলা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বিজ্ঞানীর অবদান শুধু বইয়ে নয়, বাস্তবেও সংরক্ষিত হওয়া উচিত। উল্লেখ্য, খ্যাতিমান বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার জন্ম বাংলাদেশের গাজীপুরের কালিয়াকৈরে এক দরিদ্র পরিবারে। ৬ অক্টোবর এই জীবনবাদী মানুষটির জন্মদিবস ছিল। তার স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫