Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

ভাটিয়ালি গানের খোঁজে

Icon

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:০৪

ভাটিয়ালি গানের খোঁজে

‘ভাটিয়ালি’ শব্দের মধ্যে ভাটি আর আলি দুটি শব্দের মেলবন্ধন আছে। লোকবিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভাটি অঞ্চলের ভাটি আর আলি মানে জোয়ার-ভাটির ঢেউ ভাঙা জওয়ান। আলি আলি বলে যে মাঝি নদীতে নৌকা ভাসান-শ্রেণিবিচারে তিনি মাঝি বা মাল্লা। তিনি একা নৌকা চালালে সে নৌকাকেও বলে এক মাল্লাই। নৌকা যাত্রী তুলে পারাপার, মালামাল পার করা তার কাজ। তিনি কখনো পাটনি, কখনো পাড়ানি। এই মাঝি-মাল্লাদের গান থেকে ভাটিয়ালি সুরের উৎপত্তি। অতীতে নদীবিধৌত বাংলাদেশে সাধারণত নদীর ভাটির স্রোতে নৌকা বাইতে মাঝিদের অনেক বেগ পেতে হতো । তাই সেই সময় দুস্তর পারাবারে সে লম্বা টানে গলা ছেড়ে গান গাইত। আবার ভাটির টানে নৌকা সোজা করে ধরে স্রোতের অনুকূলে যেতে যেতেও তিনি গান ধরতেন। কালক্রমে এই গানই ভাটিয়ালি গান নামে পরিচিতি লাভ করে। বাংলা লোকগানের মধ্যে জনপ্রিয়তম গানের একটি ভাটিয়ালি। ভাব, বিষয় ও সুরের বৈচিত্র্য বিবেচনা করে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ভাটি অঞ্চলের যে মানুষেরা নৌকাযোগে ব্যবসা-বাণিজ্য তথা দূর যাত্রাপথের কর্মে নিয়োজিত ছিলেন তারাই ভাটিয়ালি গানের প্রকৃত উদ্ভাবক।

বাংলা লোকসাহিত্য বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন আশুতোষ ভট্টাচার্য। তিনি তার ‘বাংলার লোকসাহিত্য’ গ্রন্থে লিখেছেন-‘ভাটি অঞ্চলের সংগীত বলিয়া ইহার নাম ভাটিয়ালি, ইহাই সাধারণের বিশ্বাস। ...একদিকে নদী কিংবা জলাভূমির বিস্তৃতি আর একদিক দিয়া উহার অলস মন্থর গতি, এই উভয়ের সহযোগেই ভাটিয়ালির উদ্ভব হইয়া থাকে; এই অবস্থার মধ্য দিয়াই মাঝি কর্মে যথার্থ অবসর লাভ করিতে পারে, এই অবসরের মুহূর্তই ভাটিয়ালির পক্ষে অনুকূল মুহূর্ত। সেই জন্য নদীর ভাটিতে নৌকা ছাড়িয়া দিয়া অলস বৈঠাটি এক হাতে স্থির ধরিয়া রাখিয়া মাঝি এই গান গাহে বলিয়াই ইহা ভাটিয়ালি গান।’ 

অন্যদিকে ‘বাংলাদেশের লোকসংগীত পরিচিতি’ গ্রন্থে সিরাজুদ্দিন কাশিমপুরী বলেন, ‘ভাটিয়ালি একটি সুর; কথার বাঁধনে কোনো বিশেষ গান নহে বলিয়াই আমার ধারণা’। প্রসঙ্গত, ‘ভাটিয়ালি’ সংগীত শাস্ত্রের একটি রাগিনীরও নাম। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য এবং বৈষ্ণব ও সুফি পদেও ‘ভাটিয়ালি’ রাগের ব্যবহার আছে। অনেকের মতে, ভাটিয়ালি গান হলো প্রকৃতিতত্ত্ব ভাগের গান। ভাটিয়ালি গানের মূল বৈশিষ্ট্য হলো এ গানগুলো রচিত হয় মূলত মাঝি, নৌকা, দাঁড়, গুন ইত্যাদি বিষয় অবলম্বনে। 

ভাটিয়ালি বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের জনপ্রিয় গান। বিশেষ করে নদ-নদী পূর্ণ ময়মনসিংহ অঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর-পূর্ব দিকের অঞ্চলগুলোতেই ভাটিয়ালি গানের মূল সৃষ্টি, চর্চা স্থল এবং সেখানে এ গানের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। বাউলদের মতে, ভাটিয়ালি গান হলো তাদের প্রকৃতিতত্ত্ব ভাগের গান। ভাটিয়ালি গানের মূল বৈশিষ্ট্য হলো এ গানগুলো রচিত হয় মূলত মাঝি, নৌকা, দাড়, গুন ইত্যাদি বিষয়ে। সঙ্গে থাকে গ্রামীণ জীবন, গ্রামীণ নারীর প্রেমপ্রীতি, ভালোবাসা, বিরহ, আকুলতা ইত্যাদির সম্মিলন। 

পুরো ভাটি অঞ্চলের লোকসমাজের স্তরে স্তরে ভাটিয়ালি গানের নানা ধারা খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমানে যান্ত্রিকতা গ্রাস করেছে গ্রামের শান্ত-সুনিবিড় নদ-নদীর রূপ-বৈচিত্র্যকেও। পাল তোলা নৌকার হাল ধরে গান গাওয়ার সময় কোথায় আজ, ভট ভট শব্দের ইঞ্জিনচালিত নৌকা অনেক আগেই পৌঁছে দেয় গন্তব্যে। 

কিন্তু তাই বলে ভাটিয়ালি সুরের গান ভাটি অঞ্চল থেকে পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যায়নি আজও। পুঁজিবাদী লুটেরা অর্থনীতি কেড়ে নিচ্ছে আমাদের ধান-নদী-খাল, আমাদের জারিসারি ভাটিয়ালি। আমাদের জীবন সংস্কৃতির মূল বিষয়গুলো চলে যাচ্ছে পণ্য দস্যুতার টানে। দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির অবকাঠামো ভেঙে পড়ার জন্য কৃষক, শ্রমিক, জেলে, ক্ষেতের মজুর এখন ঢাকার বস্তিতে থাকে, রিকশা চালায় বা গার্মেন্টসে শ্রম বিকায়। সেই সব মৌলিক মানুষ আমাদের শিকড় সংস্কৃতির প্রাণ। তাদের গান শুনতে রাতের আয়োজনে হাজির হতো শত শত মেহনতী মানুষ। গরিবের বিনোদনই আমাদের সংস্কৃতি। এসব সংস্কৃতির প্রশাখাগুলো নাগরিক হয়েও বাঁচতে পারছে না। তাই এ সংস্কৃতি রক্ষা করা দরকার। নইলে জাতীয় সংস্কৃতি বলতে কিছুই থাকবে না।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫