Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

শ্রদ্ধাঞ্জলি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও ছোটগল্পে তার ভূমিকা

Icon

হামীম কামরুল হক

প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৫৭

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও ছোটগল্পে তার ভূমিকা

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

গত শতকের নয়ের বা নব্বই দশকের শেষ দিক থেকে শূন্য দশকের প্রথম ভাগে সৈয়দ মনজুুরুল ইসলাম তৈরি করতে থাকেন বাংলা ছোটগল্পের এক বিস্ময়-জাগানিয়া জগৎ। এমন একজন লেখকের চলে যাওয়া আমাদের সাহিত্যের জন্য বিরাট এক ক্ষতি। ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তার অসীমের পথে যাত্রা শুরু হলো। আর আমাদের জন্য তিনি রেখে গেলেন তার অনেক না বলা কথার কথকতা। এখানে তার ছোটগল্প নিয়েই কিছু কথা বলব আজ। 

এক.

১৮ জানুয়ারি ১৯৫১ সালে সিলেটে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের জন্ম। পড়ালেখা ও পরে শিক্ষকতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। ১৯৬১ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় একটি স্মরণিকায় প্রথম গল্প মুদ্রিত হয়, পরে নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় ‘রংধনু’ নামের পত্রিকায় কিছু লেখা। সেসব মূলত হাত মকশোই বলা চলে। তার ছোটগল্পের যাত্রা শুরু হয় গত শতকের সাতের দশকের গোড়ার দিকে। ১৯৭৩ সালে তার প্রথম গল্প ‘বিশাল মৃত্যু’ প্রকাশের দীর্ঘ প্রায় বাইশ বছর পর ১৯৯৫ সালে কলকাতার প্রমা থেকে ‘স্বনির্বাচিত গল্প’ এবং ১৯৯৬ সালে ঢাকার প্রগতি প্রকাশনী থেকে ‘থাকা না-থাকার গল্প’ বই দুটির মাধ্যমে তিনি প্রত্যাবর্তন করেন বাংলাদেশের ছোটগল্পের জগতে এবং ২০০৫ সালে অন্যপ্রকাশ থেকে ‘প্রেম ও প্রার্থনার গল্প’ তাকে বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষাভাষী বিদগ্ধ পাঠকের কাছে বিপুল পরিচিতি এনে দেয়। বলে রাখা ভালো, তার এই জগতের প্রায় সমান্তরালে চলেছিলেন আরেক বিস্ময়-জাগানিয়া গল্পকার শহীদুল জহির। 

আমরা দেখি বাংলাদেশে ছোটগল্পের ধারা তৈরিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শওকত আলী, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, মাহমুদুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কায়েস আহমেদ থেকে শহীদুল জহির এর আগে-পরে-মাঝে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় সরদার জয়েনউদ্দীন, সায়ীদ আতিকুল্লাহ, শওকত ওসমান, রশীদ করীম, জহির রায়হান, শহীদুল্লা কায়সার, আবু রুশদ থেকে হুমায়ূন আহমেদ, মঈনুল আহসান সাবের, ইমদাদুল হক মিলন, আতা সরকার, মঞ্জু সরকার, সুশান্ত মজুমদার, জুনাইদুল হক থেকে মামুন হুসাইন, শাহাদুজ্জামান, সেলিম মোরশেদ, পারভেজ হোসেন, নাসরীন জাহান, জাকির তালুকদার, হামিদ কায়সার, মশিউল আলম, ফয়জুল ইসলাম, আহমাদ মোস্তফা কামাল থেকে প্রশান্ত মৃধা অব্দি আরো অনেকের নাম। (যাদের নাম এখানে নেওয়া হলো না তারা নিজে থেকে সেখানে নিজেকে অনুভব করে নিতে পারেন, তিনি যদি বাংলা ছোটগল্পের সেবা করে থাকেন তো বর্তমান রচয়িতার নাম নেওয়া ও না-নেওয়ায় তার কোনো ক্ষতি হবে না। যেমন হারিয়ে যাওয়া ষাটের উজ্জ্বল গল্পকার শহীদুর রহমানের পাশাপাশি বারেক আবদুল্লাহ বা সত্তরের শেখর ইমতিয়াজের কথাও স্মরণে আসবে কারো কারো।) কিন্তু একেবারে ছোটগল্পকেই নিজের লেখালেখির প্রধান ক্ষেত্র করে তুলেছেন এবং ছোটগল্পকার হয়েই কোনো ভাষার প্রধান লেখক হয়েছেন, এমন লেখক সব ভাষায়ই বিরল। সেটি অ্যাডগার অ্যালেন পো হোন কি আন্তন চেখভ বা হোর্হে লুই বোর্হেস, বাংলাদেশের সাহিত্যে প্রধানত হাসান আজিজুল হক তেমন একজন লেখক এবং এর পরই সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে দেখি, যিনি মূলত ছোটগল্পচর্চার ভেতর দিয়ে তৈরি করেছেন তার বিশিষ্ট পরিচয়। 

মামুন হুসাইন এবং অতিসম্প্রতি দেখতে পাই ফয়জুল ইসলাম বাংলাদেশে ছোটগল্পের ধারায় বিশিষ্ট দুই নাম হিসেবে ভাস্বর হয়ে উঠেছেন। বলাবাহুল্য, এই তাদের ছোটগল্প গ্রন্থের সংখ্যার তুলনায় উপন্যাস একেবারেই হাতে গোনা। এদের কোনো কোনো গল্প আয়তনে প্রায় উপন্যাসিকা বা নভেলেটের সমান। ছোটগল্পের কারিগর হিসেবে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্পগ্রন্থ  ও গল্পসংখ্যা বোধ করি বর্তমানকালে সবাইকে ছাপিয়ে গেছে। স্বনির্বাচিত গল্প (১৯৯৫), থাকা না-থাকার গল্প (১৯৯৬), কাচ-ভাঙ্গা রাতের গল্প (১৯৯৮), অন্ধকার ও আলো দেখার গল্প (২০০১), প্রেম ও প্রার্থনার গল্প (২০০৫), সুখ-দুঃখের গল্প (২০১১), বেলা অবেলার গল্প (২০১২), মেঘশিকারি (২০১৫), তালপাতার সেপাই ও অন্যান্য গল্প (২০১৫), একাত্তর ও অন্যান্য গল্প (২০১৭), কয়লাতলা ও অন্যান্য গল্প (২০১৯), গল্পসকল প্রথম খণ্ড (২০২০)। এ ছাড়া তিনি উপন্যাস লিখেছেন, লিখেছেন বিপুল পরিমাণে প্রবন্ধ এবং করেছেন গবেষণামূলক কাজ। বিশ্বসাহিত্য নিয়ে দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত তার একসময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় কলাম ‘অলস দিনের হাওয়া’র একটি কলাম থেকে জাদুবাস্তবতার কথা জেনেছিলেন শহীদুল জহির, আর বদলে নিয়েছিলেন তার নিজের রচনার ধারাগতি। এই কলামটি সৈয়দ শামসুল হকের ‘হৃদকলমের টানে’র মতো আজও পাঠকের স্মরণে এক সাহিত্যভোজের স্মৃতি হয়ে আছে।

দুই

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ক্ষেত্রে জগদীশ গুপ্তকে বিশেষভাবে মনে রাখতে হচ্ছে। কারণ বাংলা সাহিত্যে নিয়তিবাদ ও অতিপ্রাকৃত গল্পের সঙ্গে অত্যন্ত নির্মোহ ও নির্মমভাবে মনুষ্যচরিত্র অবলোকনে কিন্তু গভীর সংবেদনশীলতার সঙ্গে হাজির করতে জগদীশ গুপ্ত এক তুলনারোহিত লেখক। তার এই মনোবৃত্তির সঙ্গে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও হাসান আজিজুল হককেই পাশে রাখতে হয়। জগদীশ গুপ্তের মতোই সৈয়দ মনজুুরুল ইসলামের গল্প আমাদের বিমূঢ় করে দেয়। কিন্তু একভাবে নয়। কারণ জগদীশ গুপ্তের মতো তিনি অত্যন্ত উপভোগ্য ভাষায় গল্পটি বললেও তত নির্মম নন। অমিয়ভূষণ মজুমদার বা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের মতে, জগদীশ গুপ্ত যতই নির্মম বাস্তবতার গল্প লেখক হন না কেন, তিনি ভেতরে ভেতরে আসলে ওই শরৎচন্দ্রগোত্রীয়ই। এখানে আমরা শরৎচন্দ্রের বৈঠকি মেজাজের কথা বলতে পারি। কিন্তু চমকপ্রদ বিষয় হলো জগদীশ গুপ্ত গল্প বলার চেয়ে গল্প লেখেন, একই কাজ করেছেন বাকিরা প্রায় সবাই। সেদিক থেকে গল্পকথনে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামও যুক্ত হতে পারেন শরৎচন্দ্রের মেজাজের সঙ্গে। তদুপরি, মনজুরুল জীবনের একবারে দৈনন্দিনতা থেকে অতি সহজে চলে যেতে পারেন মানুষের অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনযাপনের ভেতরে। ‘ডিডেলাসের ঘুড়ি’, ‘ফেরিঘাটের রান্নাবান্না’ বা ‘তিন টাকার নোট’-এর মতো গল্পগুলোতে অপমৃত্যু, বেশ্যাবৃত্তি আর জালিয়াতির বিষয়গুলো হাজির হয় কথনের কোমলতা নিয়ে। বলা যায়, মনজুরুল কখনোই খুব শক্ত বা কঠোর চোখে জীবনের দিকে, মানুষের দিকে তাকান না। আমরা চমৎকৃত হই তার গল্পের বৈচিত্র্যে, কারণ যিনি ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্রয় বিক্রয়’-এর মতো গল্প লিখেছেন, তিনি অবলীলায় লেখেন ‘জলপুরুষের প্রার্থনা’ বা ‘জিন্দা লাশ’-এর মতো গল্প যেখানে মানুষ তার কায়ার সঙ্গে ছায়া হয়ে যেতে পারে, কল্পনার দুয়ার খুলে গল্প হয়ে উঠে যায় চিত্রকল্পের স্তরে। ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্রয় বিক্রয়’ গল্পটি এতই বিশ্বাসযোগ্যতার স্তরে চলে যায়, আমরা বিহ্বল হয়ে উঠি এই গ্যাসক্ষেত্রের ভাগ-বাটোয়ারার মতো তলের কাহিনি তাহলে সিরাজের পতনের পেছনে কাজ করেছে? তেমনটাই ‘পরকীয়া’ গল্পের কাহিনি জয়সালমির না ভারতবর্ষের যেকোনো অঞ্চলে আঠারো শতক থেকে হানা দিয়ে আসে অতীত ও অতি সাম্প্রতিক মন ও প্রবণতার আদান-প্রদান ঘটতে থাকে।

মনজুরুলের গল্পের আরো একটি দিক হলো : তিনি অনেক সময়ই পাঠকের ওপর লেখক ছেড়ে দেন গল্পটির ইতি টানার দায়িত্ব। তার নিজের কিশোরবেলায় এক বৃদ্ধা হিন্দু বিধবা নারী ও তাদের বাড়ির গৃহপরিচারক হাবিব ভাইয়ের কাছে গল্প শোনার সময় এই ধরনটি লক্ষ করেছিলেন। এই দুজনই গল্প নিয়ে খেলতেন, অনেক ক্ষেত্রেই গল্প শেষ করতে চাইতেন না, শেষ না হওয়া গল্পের ভেতর আরো আরো গল্পের সম্ভাবনা জিইয়ে রাখতেন। মনজুরুলও প্রায় একই কাজ করেন। তবে এই শেষ না হওয়া রবীন্দ্রনাথের বর্ষা যাপন কবিতায় বলা ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ ধরনের নয়। সেটি আসলে একটা মুক্ত অভিমুখ লাভ করে, পাঠকই এর অনেকগুলো অভিমুখ তৈরি করে নিক মনজুরুল যেন সেটাই চান। আবার কোনো গল্পের ভেতরে কাজ করে ইতিহাসের একটি দীর্ঘ পরম্পরা যেমন ‘ফার্গুসন ডিনারওয়ালার গল্প’। ঔপনিবেশিক বাস্তবতা, ধর্মান্তর, নাম বদলের, পদবি বদলের, কি পেশা বদল বিচিত্র চমকপ্রদ কাহিনি থেকে মুক্তিযুদ্ধের পরিণতিতে হানা দেন মনজুরুল। 

বিশ্বসাহিত্যের নানা গল্পকার ও বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার বুম পরবর্তী লেখকদের অনেকের ভেতর এই ধরন লক্ষ করা গেছে। ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্রয় বিক্রয়’, ‘পরকীয়া’ বা ‘ফার্গুসন ডিনারওয়ালার গল্প’ মতো আরো অনেক গল্পে ইতিহাসের লেনাদেনা ও কায়কারবারে মানুষের নিয়তি ও পরিণতিকে গেঁথেছেন মনজুরুল তার গল্পকথনের অভূতপূর্ব সৃষ্টিশীলতায়। 

অদ্ভুত ও বিরল চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় তার ‘খোদারাখার জন্ম’, ‘যে মানুষ আলো দেখেছিল’, ‘পরিতোষের পায়ের নিচে মাটি’ এবং ‘কাঁঠালকন্যা’র মতো গল্পগুলোতে। খুব স্বাভাবিক মেজাজে সহজভাবে তিনি যে গল্প বলেন তাতে বাস্তবতা ও জাদু এসে মেলে। তবে এ জাদু যত জাদুবাস্তববাদী, তার চেয়ে অতিপ্রাকৃত ও ফ্যান্টাসির সঙ্গে বেশি লগ্ন। তবে কথনের ভঙ্গিতে গল্প বলার জন্যই হয়তো মনজুরুলের গল্পের গদ্য অপেক্ষাকৃত ঢিলাঢালা। গদ্যে কোনো টান টান নির্মেদ গড়ন নেই, কিন্তু গল্পের বুননে আছে এক অপ্রতিরোধ্য টান টান আবহ, যে জন্য তার গল্প পড়তে শুরু করলে শেষ না করে ছেড়ে দেওয়া কঠিন। এর ভেতরেই তিনি জন্ম-মৃত্যু-অপমৃত্যু, শৈশব-কৈশোর-যৌবন-বার্ধক্য, নিঃসঙ্গতা-প্রেম-পরিণয়-দাম্পত্য ও সম্পর্কের ভাঙাগড়াগুলো হাজির করেন, পাশাপাশি চলতে থাকে সমাজ-রাষ্ট্র ইতিহাসের পালাবদল। জীবনের সামগ্রিকতাকে যেভাবে একজন ঔপন্যাসিক ছুঁতে চান, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তার ছোটগল্প দিয়ে আমাদের নিয়ে যেতে চান জীবন ও ভুবনের সমগ্রতায়। ব্যক্তিকে ছুঁয়ে ছেনে দেখেন, মনকে ঘাতসহনীয় করে তোলেন আর পাঠকের কল্পনাকে অবারিত করেন। এভাবেই তিনি সাহিত্যের দাবি পূরণ করেন আর পালন করেন একজন লেখকের ভূমিকা। 

লেখক : গল্পকার ও শিক্ষক 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫