Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

নিষ্ঠুরতা এখন সম্পূর্ণ মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই

Icon

তৌফিকুল ইসলাম

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:২৬

লাসলো ক্রাসনাহোরকাই

নোবেল বিজয়ী হাঙ্গেরির লেখক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই

২০২৫ সালে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন হাঙ্গেরির লেখক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। তিনি ইউরোপের এ সময়ের শ্রেষ্ঠ লেখকদের একজন। তার লেখা ‘স্যাটানট্যাঙ্গো’ (১৯৮৫), ‘দ্য মেলানকলি অব রেজিস্ট্যান্স’ (১৯৮৯), ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ (১৯৯৯) ইংরেজিতে অনূদিত হওয়ার পর বেশ পাঠকপ্রিয়তা পায়। বইগুলো অনুবাদ করেছেন জর্জ সির্টেস। ধ্বংসযজ্ঞের ভেতর শিল্পের সৌন্দর্য স্থাপনের স্বীকৃতি হিসেবে তাকে এ বছর নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এরপর সাহিত্যবিষয়ক পোর্টাল ট্রান্সক্রিপ্টে তার একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জেমস হপকিন।  ওই সাক্ষাৎকারটি ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করেছেন তৌফিকুল ইসলাম


আপনার বই ‘অ্যানিমাল ইনসাইড’-এর ধারণা কীভাবে এলো, যেখানে একটি কালো কুকুরের ছবির বিপরীতে আপনার ভাষ্য তৈরি হয়েছে?

একটি ছবির দিকে যতক্ষণ তাকিয়ে থাকা সম্ভব, ততক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। তারপর আমি সেই ছবি নিয়ে লেখার ইচ্ছা পোষণ করি, লেখাটি আমি ছবির শিল্পী ম্যাক্স নিউম্যানকে দেখাতে চেয়েছি, হয়তো তিনি এটি দেখার পর ছবিটির নতুন সংস্করণ আঁকবেন, তারপর আমি আবার লিখব এভাবে আমাদের কথোপকথন চলতে থাকবে। হয়তো এই সংলাপ থেকে কিছু একটা তৈরি হবে। এমন ভাবনাই ছিল।

শুরুতে আমি ছবিটি নিয়ে একটি ছোট লেখা লিখেছিলাম, কারণ ছবিটি ‘অশুভ’ বা ‘খারাপ’-এর সঙ্গে সম্পর্কিত এবং আমি এই ছবির প্রভাব থেকে বের হতে পারছিলাম না। আমি বুঝতে পারছিলাম, এড়িয়ে যাওয়া কোনো সমাধান নয়, কারণ কিছু জিনিস চিরস্থায়ী হয়। তাই একমাত্র উপায় ছিল, এ নিয়ে লেখা। আমি ‘নিউ ব্রুটালে’ বা ‘নতুন নিষ্ঠুরতা’ সম্পর্কে লেখার পরিকল্পনা করেছিলাম এবং সেই কারণেই পরদিন  চিত্রশিল্পী ম্যাক্স নিউম্যানের কাছে গেলাম। এর মধ্যে আমার লেখার একটি অংশ জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেছি। ম্যাক্স খুব খুশি হন, কিন্তু মুখে কিছুই বললেন না। কয়েক দিন পর তিনি ফোন করলেন : ‘তুমি কি আজ বিকেলে আসতে পারবে?’ আমি যাওয়ার পর আমাকে দ্বিতীয় সংস্করণের ছবি দেখালেন। আমি বিস্মিত হলাম, কারণ আমি তো তাকে এই পরিকল্পনার কথা বলিনি! তাই আমি দ্বিতীয় ছবিটি নিয়ে আবার একটি লেখা লিখলাম এবং তার জন্য সেটি জার্মানে অনুবাদ করলাম। এভাবে ১৪টি ছবি ও ১৪টি লেখা তৈরি হলো। কেন ১৪? ব্যাখ্যাটা খুব সহজ, আমার মনে হয়েছিল ১৩ যথেষ্ট নয়, আর ১৫ খুব বেশি।’

কিন্তু কাজটি শেষ হওয়ার পর এক প্রশ্ন তাড়া করল : ‘অসুন্দর’ বিষয়ে লেখা বা আঁকা কি সম্ভব? আর যদি সম্ভব হয় এর জন্য কোনো মূল্য দিতে হয় কি? এ প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ হলে সেটি কখন? আমি বুঝেছিলাম ‘অসুন্দর’কে কোনো রূপ দেওয়া যায় কেবল তার ভেতর থেকে। বাইরে থেকে নয়। আর ভেতর থেকে দেখা মানে বিপদে পড়া।

তবু আমার ভেতরে কেউ যেন বলছিল, ‘খারাপের ব্যাপারে মানুষকে কথা বলতেই হবে খারাপের ব্যাপারে মানুষকে কথা বলতেই হবে...।’ (তিনি মন্ত্রের মতো বাক্যটি আরো দুইবার পুনরাবৃত্তি করেন, কণ্ঠ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়।)

এই হলো ‘অ্যানিমাল ইনসাইড’ এর গল্প।

আপনার ‘নিউ ব্রুটালে’ ধারণা নিয়ে আরো কিছু বলতে পারেন?

‘আপনি জানেন, নিষ্ঠুরতার এই রূপ এই ধরনের ‘অশুভ’ বিষয় ইতিহাসে বারবার নানা ছদ্মবেশে ফিরে আসে। এখন আমরা এমনই একসময়ের মধ্যে বাস করছি। নিষ্ঠুরতা এখন সম্পূর্ণ মুক্তভাবে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের আত্মরক্ষার একমাত্র উপায়ের ক্ষেত্রে আমি শুধু একটি কাজই করতে পারি, তা হচ্ছে ‘লেখা’।

তাহলে ‘লেখা’ এক ধরনের প্রতিরোধ হয়ে দাঁড়ায়?

এই ক্ষেত্রে হ্যাঁ। সাধারণত আমি এ রকম কিছু করি না। আমার অন্যান্য উপন্যাস ও ছোটগল্প একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির। অ্যানিমাল ইনসাইড আসলে এক চিৎকার। এটি আমার জীবনের প্রথম যৌথ কাজ এবং হয়তো শেষ। কিন্তু ভীষণ আকর্ষণীয়।

আপনার উপন্যাসগুলোও তো একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা রীতিতে, শৈলীতে, বিষয়বস্তুতে।

সম্পূর্ণ সত্যি, সম্পূর্ণ সত্যি। আমার উপন্যাস ও ছোটগল্পগুলোতে (আমার প্রথম ইংরেজি গল্পসংকলন সেইওবো দেওয়ার বিলো এই শরতে প্রকাশিত হবে) আমি এক ধরনের ভাষা ব্যবহার করি যে ভাষা কিছু বোঝাতে চায়। কিন্তু অ্যানিমাল ইনসাইডে আমি শুধু ভাষা ব্যবহার করেছি, আর চিত্রশিল্পী ব্যবহার করেছেন তার দৃশ্যমান ভাষা অশুভকে প্রকাশ করার জন্য। কারণ ‘অশুভ’-এর কোনো গল্পই নেই।

যখন অন্য দেশে থাকেন, তখন সেই দেশের ভাষা আপনার লেখায় প্রভাব ফেলে কি?

অন্য ভাষাও ভাষা, তাও মানবিক। আমি খুব ভালোবাসি অপরিচিত ভাষার ভেতরে থাকতে। যেমনÑকোনো আরব দেশে, যা অসাধারণ অনুভূতি এনে দেয়।

আমরা আগেও যেমন আলোচনা করেছি, আপনার কাজ শুধু দ্য মেলানকলি অব রেজিস্ট্যান্সের মতো গভীর বিষণ্নতায় ভরা নয়। কিন্তু এটি কেবল আত্মমগ্নতা বা অন্তর্দ্বন্দ্বের কথাও নয়। যেমন-চিওরান লিখেছিলেন, ‘এক ধরনের বিষণ্নতা আছে, যা পর্বত সরিয়ে দেয়।’

আমি একজন বিষণ্ন মানুষ। আমার বিষণ্নতা সম্পর্কে একটি ধারণা আছে। লাসলো ক্রাসনাহোরকাই আপনাকে বলছে যে সে একজন বিষণ্ন মানুষ, সে জানে বিষণ্নতা কী। যেমন-আপনি যদি কখনো কাউকে সত্যিকারভাবে ভালোবেসে থাকেন একজন পুরুষ বা একজন নারীকে, তাহলে আপনি জানেন ভালোবাসা কী। কিন্তু আমি বিষণ্নতা সম্পর্কে কি বলতে পারি।

বিষণ্নতা বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের একটি স্বাভাবিক অবস্থা। কারণ এই অবস্থায় মানুষ এক ধরনের প্রজ্ঞা ও ধৈর্যের মধ্যে শান্তি খুঁজে পায়। একজন বিষণ্ন মানুষ সময়কে কেবল বসে থাকার জন্যই ব্যবহার করতে পারে শুধু বসে থাকা। ইউরোপের বিষণ্ন মানুষ কিছুটা জাপানের সেই মানুষের মতো, যে শুধু বসে থাকার জন্য বসে থাকে। এই বিন্দুতে এসে আমরা ইউরোপীয় ও প্রাচ্যের সংস্কৃতির মধ্যে এক ধরনের সংযোগ খুঁজে পাই।

আর এই ‘থাকা’র অবস্থা কি শেষ পর্যন্ত এক ধরনের প্রতিরোধ নয়?

অবশ্যই, বিষণ্ন হওয়া মানে মানবজীবন ও মানবকর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোও বটে। এটি কাজের প্রকৃতির বিরুদ্ধেও এক অবস্থান। কারণ বিষণ্নতা মানুষের ক্রিয়াশীলতাকে অন্য রূপে বদলে দেয়। তাই যদি পৃথিবীতে খুব বেশি বিষণ্ন মানুষ থাকত, তাহলে সমাজের তি হতো! (একটু হেসে) কিন্তু আমরা ভাগ্যবান তাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫