
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন সাধারণের মধ্যে এক অসাধারণ মানুষ। সাধারণত তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক, একজন লেখক, একজন পণ্ডিত, একজন সাহিত্য সমালোচক ও একজন তাত্ত্বিক। কিন্তু তাঁর অসাধারণত্ব ছিল ব্যক্তিক গুণ, আচরণের বলিষ্ঠতা, জীবনযাপনের স্মার্টনেস ও ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তায়। আধুনিকতা উজিয়ে যখন বাঙালি পাঠক আধুনিক-উত্তর কিংবা পোস্টমডার্ন কিংবা অধুনাবাদী বাস্তবতায় সব কিছুকে মেপে নিচ্ছে; তখন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম দেশ ছেড়ে কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে কিংবা দেশে ফিরে আমাদের শিখিয়ে দেন বিশ্বসাহিত্যের প্রকৃত ভাষা, এই হচ্ছে পোস্টমডার্ন সাহিত্য, সাহিত্যিক, চিত্রকর, চিত্রকলা ও সংস্কৃতির নির্মাণকলা।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রথম তার সময়ের নজর কাড়েন ‘অলস দিনের হাওয়া’ সাহিত্য কলাম লিখে। তখন দেশের ঐতিহ্যবাহী জাতীয় পত্রিকা ‘সংবাদ’-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতো কলামটি, আশির দশকে। বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে বাঙালি পাঠকের সামনে এ যেন ‘না চাইতেই পাওয়া’র মতো এক বিরলতম টেক্সট। পাঠককে চিনিয়ে দেন বিশ্বসাহিত্য পাঠ, বিশ্বসাহিত্য সংগ্রহ আর বিশ্বসাহিত্য ও চিত্রকলার অনিবার্য অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্রগুলোকে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আগামী দিনের লেখকদের কথা অনুভব করেই হয়তো লিখতে শুরু করেছিলেন নন্দনতত্ত্ব বিষয়ক মহার্ঘ্য রচনাগুলো, যা পরবর্তী সময়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়ে বাংলা সাহিত্যভান্ডারে থেকে যায় এক অমূল্য সংযোজন হিসেবে। তার ভাষাজ্ঞান ও পাঠাভিজ্ঞতাই তাকে একটি স্বকীয় ভাষা সৃষ্টিতে সুবিধা করে দিয়েছে। মধ্যযৌবন থেকেই তিনি যখন আমাদের সামনে নিয়ে এলেন উত্তর আধুনিক উপন্যাস ও বর্ণনাকারীর ঐতিহ্য, ইয়েটসের কবিতা, মিরোসøাভ হলুভের মোহভঙ্গ, মিলান কুন্ডেরার অমরত্ব, বোর্হেসের আধুনিকতা, গার্সিয়া মার্কেসের একটি অপহরণের সংবাদ, পেসোয়ার কবিতা, শেমাস হিনির বিওউলফ-বিষয়ক প্রবন্ধাবলিসহ বিশ্বসাহিত্যের আরো অসংখ্য কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, চিত্রকর, নন্দনতাত্ত্বিকের নানা প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ বিষয়ক লেখালেখি।
আমৃত্যু ইংরেজি ভাষার অধ্যাপক বলেই নয় শুধু, তিনি তার ছাত্রজীবন থেকেই দেশি-বিদেশি সাহিত্যের অনুরক্ত ছিলেন। সাহিত্য চিনেছেন, লেখক চিনেছেন, শিল্পী চিনেছেন, শিল্পকলা চিনিয়েছেন এবং আরো নতুন নতুন কিছু চেনা ও চেনানোর অন্বেষায় তৃষ্ণার্ত ছিলেন আমৃত্যু। যে কারণে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের প্রবন্ধের ভাষা সব সময় ধারণ করত বিশ্বসাহিত্যের চারিত্র্য-মান এবং জাদুটা এখানে যে, এই ভাষায় বাঙালি পাঠকের একটা বিরাট গোষ্ঠী শিক্ষিত ও অভ্যস্ত হতে শুরু করেছিল। এই যে স্বদেশে বসবাস করে স্বদেশি একজন লেখকের মাধ্যমে স্বভাষার মৌলিক সাহিত্য দিয়ে বিশ্বসাহিত্যের রসাস্বাদন-এ ক্ষেত্রে বাঙালি লেখকদের মধ্যে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন অগ্রগণ্য। তার উপন্যাস ও গল্পের ভাষা যেকোনো বাঙালি লেখকের কাছে এক নতুন পাঠ হিসেবে বিবেচিত। বিশেষত তার গল্পের বই, দেখা অদেখার গল্প, প্রেম প্রার্থনার গল্প, বেলা -অবেলার গল্প, কয়লাতলা ও অন্যান্য গল্প সাহিত্যের অনন্য সংযোজন। তার গল্পের মানুষ ছিল সমাজের সাধারণ মানুষ। তাদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনাই তার গল্পের মূল আকর্ষণ। তার গল্পে সমকালীন বিভিন্ন ঘটনাবলি যেমন এসেছে, তেমনি মানবজীবনের নানা দিকও উঠে এসেছে। গার্মেন্টস বিদ্রোহ, ভূমিকম্পের ভয়, বন্যার কথা, টাকা জালনোট করা, টাকা প্রতারণা করা, হরতালে বোমা তৈরি করা, গৃহকর্মী নির্যাতন, গ্রামে কবর ব্যবসা, হারিয়ে যাওয়া মেয়ে-এ রকম বিভিন্ন ও বিচিত্র বিষয় উঠে এসেছে তার গল্পে। তার গল্পে উঠে এসেছে মানবজীবনের সংবেদনশীল নানান রকম পর্ব। যেসব পর্ব আমাদের অগোচরেই থেকে যায়। তার অন্যান্য লেখার মতো গল্পেরও স্বকীয়তা ছিল।
দেশে-বিদেশে তার সরাসরি অগণিত ছাত্রছাত্রী ছাড়াও যে বিপুল মানুষের ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন, তা তার স্মার্ট ব্যক্তিত্ব, বলিষ্ঠ উচ্চারণ ও নতুন ধারার সাহিত্য সৃষ্টির জাদুকরি ক্ষমতার জন্যই। তিনি কোনো দল, গোষ্ঠী বা মতের লেখক ছিলেন বলে তাই আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিনি সব সময় মনে করতেন প্রকৃত লেখকের কোনো জাতপাত-দল-গোষ্ঠী নেই।