লালন সাঁই বাংলার লোক সাংস্কৃতিক ধারা-বাউল সাধক সম্প্রদায়ের অনন্য প্রতিনিধি। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বিশ্বাসের বাইরের একটি বিশাল মরমি জগতের রূপ দিয়েছিলেন তিনি। মানবিক চেতনাবোধে ঋদ্ধ এই ধারা মানুষকে দ্বিধাহীনভাবে টেনেছে। শ্রেণিহীনভাবে ভালো বেসেছে মানুষকে। মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনাকে জাগ্রত করতে সাধন-ভজনের দিশা দিয়েছেন। মূলত বাউল মতবাদকে একটি মানস পুরাণ বলা হয়। বাউলরা মনে করেন দেহের আধারে যে চেতনা বিরাজ করছে, সে-ই আত্মা। এই আত্মার খোঁজ বা সন্ধানই হচ্ছে বাউল মতবাদের প্রধান লক্ষ্য। আরবের রাজ শক্তির প্রতিঘাতে জন্ম হয়েছে সুফি মতবাদের। এটিকে লালন-পালন করেছে পারস্য। পরবর্তি সময়ে যতই পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে থাকে, এর মধ্যে ততই পূর্বের প্রচলিত ভাবধারার সম্মিলন ঘটতে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ায় এসে অধ্যাত্ম সংগীত চর্যাগীতিতে রূপান্তর হয়। পরে তুর্কি বিজয়ের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সুফি-দরবেশদের আগমনে বৌদ্ধ সিদ্ধাচর্যাগণের আদর্শ মানবতাবাদ, সুফিবাদে সম্মিলিত হয়ে ভাবসংগীতে রূপান্তর হয়েছে। ফলে সুফি দর্শন অতি সহজে বৌদ্ধদের কাছে প্রশংসনীয় হয়। কাজেই একদিকে সুফিবাদ এবং অন্যদিকে বৌদ্ধ সাধনা এসবের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে মরমি ভাব-সাধনার উৎপত্তি।
ফকির লালন সাঁই তার চিন্তা-চেতনায়, ভাবে-ভাবনায় ও বিশ্বাসে অর্থাৎ তার গুরুবাদী দর্শনে মূলত মানুষকেই অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন। মানুষ তার গানে আত্মার যে খোড়াক পেয়েছে, সেটা কোনো সাধারণ গান নয়। ভাব রসে নিষিক্ত আত্মাকে কর্ষণ করার গান। এই গান মূলত লালনের লৌকিক মতাদর্শ প্রচারের অংশ। এটা তার সাধন-পদ্ধতির মূল ভাষ্য। তার রচিত গানে বাউল সাধনার বিভিন্ন উপাত্ত, পদ্ধতির কথাও বলা হয়েছে। লালন দর্শন বলতে আমরা যা বুঝি সেটা তিনি তার গানের মধ্য দিয়েই বলে গেছেন। লালন গান রচনা করতেন মুখে মুখে আর তার শিষ্য-ভক্তরা এগুলো লিখে রাখতেন।
কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার আখরায় লালনের জীবিতকালের লিপিবদ্ধ কয়েকটি গানের খাতা ছিল। সেগুলো একসময় বেহাত হয়ে গেলেও মানুষের মুখে মুখে রয়ে গেছে অজস্র গান। তার অজস্র গান শিষ্যদের ভাবচর্চার মধ্য দিয়ে মানুষের ভেতরে ছড়িয়ে গেছে দিক থেকে দিগন্তে। লালনের অনুসারী বাড়ছে, বাড়ছে আশ্রমের সংখ্যা। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে বাউল মতাদর্শের ঘরানা। সমাজের জাতপাতহীন এক মানবিক সমাজের যে পথ লালন দেখিয়েছেন তার নির্দেশিত পথে অজুত মানুষ গেয়ে চলছে মানবিক সমাজ নির্মাণের গান-‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।’ মানুষকে এরকমভাবে গুরুত্ব দিয়ে মতাদর্শের প্রচার করেছে এমন দ্বিতীয় সাধক আর কে আছে? লালনের সহজিয়া ভাব দর্শনের সুবাদে সমাজের অচ্ছুত, শোষিত, বঞ্চিত শ্রেণিহীন মানুষের আশ্রয় হয়েছে লালন। মানুষকে তিনি পরমাত্মার অংশ হিসেবে তুলে ধরেছেন। মানুষকে গুরুজ্ঞানে ভক্তি করেছেন। তাই লিখেছেন, ‘সহজ মানুষ ভজে দেখ নারে মন দিব্যজ্ঞানে,/পাবিরে অমূল্য নিধি বর্তমানে।’
বাউল মতাদর্শে জীবাত্মার মধ্যে পরমাত্মার যে স্থিতির কথা বলা হয়েছে লালন এবং তার সাধন-ভজনের অন্যতম অনুষঙ্গ গানের মধ্যে-এ প্রসঙ্গ বারবার এসেছে। এ ব্যাপারে অধ্যাপক আহমদ শরীফ বলেছেন, জীবনের যে চিরন্তন প্রশ্নে আত্মার আকুলতা; উদার পটভূমিকায় ও বিস্মৃত পরিসরে তার সমাধান খুঁজতে চাইলে জাতি, ধর্ম ও সমাজ চেতনার ঊর্ধ্বে উঠতে হয়। ... ভেদবুদ্ধিহীন মানবতার উদার পরিসরে সাম্য ও প্রেমের সুউচ্চ মিনারে বসেই লালন সাধনা করেছেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাধক ও দার্শনিকদের কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তিনি সাম্য ও প্রেমের বাণী শুনিয়েছেন। তিনি রুমি, জামি ও হাফিজের সগোত্র কবীর ও রজবের উত্তর সাধক। লালন (১৭৭৪-১৮৯০) কবি, দার্শনিক, ধর্মবেত্তা ও প্রেমিক। তার গান লোকসাহিত্য নয়, বাঙালির প্রাণের কথা, মনীষার ফসল ও সংস্কৃতির স্বাক্ষর। আমাদের উনিশ শতকি পাশ্চাত্যমুখিতার জন্যই আজও তার কদর হয়নি। তবু তিনি আড়াই লাখ বাউলের গুরু-জীবনপথের দিশারী।
