Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

বিশ্ব মানব মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন

Icon

মামুন রশীদ

প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:৫৫

বিশ্ব মানব মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন

‘সাতাশে মার্চ। সন্ধ্যাবেলা। বেশ জোরে হাওয়া বইছে। হাওয়ার সঙ্গে রাশি রাশি ধুলাবালি, শুকনা পাতা বেগে উড়ে চলেছে। হাওয়া গায়ে লাগলে শান্তি হয় না, কেমন যেন গা পুড়ে যায়। প্রকৃতি রুক্ষ্ম,বৃক্ষ-লতাদি রূঢ়ভাবে বারংবার আন্দোলিত হচ্ছে। পথচারীদের গায়ে মাথায় ধুলাবালি লেগে কেমন যেন অপ্রাকৃতিক করে 

তুলেছে। আকাশ পিঙ্গলবর্ণ। এর সঙ্গে নেমে আসছে সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকার। গাছপালার আন্দোলন, সবেগে প্রবাহিত রুক্ষ হাওয়া এবং গাঢ় অন্ধকার একটি অবাস্তব পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন ধরিত্রীর মর্মভেদী হাহাকার যেন বংশের সোচ্ছ্বাস আন্দোলন, বৃক্ষপত্রের প্রকম্পন এবং নিবিড় অন্ধকারকে ভয়াবহ করে তুলেছে। পাবনা থেকে একখানা মোটরবাস আমিরাবাদের হাটখোলার পাশে এসে দাঁড়াল।’

প্রবল বেগে ধেয়ে আসা শব্দমালায় এই যে দৃশ্যের পর দৃশ্যের বর্ণনা, সামনে এগিয়ে যাওয়া-একটি জিজ্ঞাসা তৈরি হওয়া, যা সম্ভাবনার সন্ধিক্ষণে দাঁড় করিয়ে দেয়, তা একটি উপন্যাসের সূচনাংশ। ‘সাতাশে মার্চ’ শিরোনামের উপন্যাসটির রচয়িতা মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন। স্বাভাবিকভাবেই পাঠক মনে কৌতূহল জাগতে পারে ঔপন্যাসিক সম্পর্কে। এমন স্বচ্ছ বেগবান গদ্য যার হাতে আত্মবিশ্বাসের সুর তুলে পাঠককে তাড়িয়ে নিয়ে যেতে থাকে পরবর্তী অংশের সন্ধানে, তার আরো পরিচয় জানার কৌতূহল এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই। তবে পাঠকের জন্য আফসোসের খবর,  এই একটি মাত্র উপন্যাস ঔপন্যাসিকের হাত ধরে প্রকাশের আলোয় এসেছে। তাও প্রায় দুষ্প্রাপ্য। তবে ঔপন্যাসিক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের সঙ্গে পাঠকের খুব বেশি পরিচয় না থাকলেও তার নামটি যে কারণে বাংলা সাহিত্যে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়, তা তেরো খণ্ডে লোকগীতির সংগ্রহ ‘হারামনি’ ও একখণ্ডে লোককথার সংগ্রহ ‘শিরণী’র জন্য। এ দুটির গ্রন্থের নাম প্রকাশের পর মনসুরউদ্দীন সম্পর্কে দ্বিতীয় বাক্য বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার অবকাশ থাকে না। সচেতন বাঙালি পাঠক মাত্রেই এ দুটি গ্রন্থের ঋণ স্বীকার করেন। তিনি ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা’ গ্রন্থের জন্যও পরিচিত। 

মনসুরউদ্দীনের হারামনি আমাদের সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এই বইয়ের ভেতরে ধরা রয়েছে বাংলা সাহিত্যের প্রাণ ভোমরা, যা আমাদের লোকসাহিত্যে স্বর্ণখনি হিসেবে আখ্যায়িত। তিনি পুরোপুরি নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছিলেন লোকসংগীতের বিপুল ভান্ডার সংগ্রহে। রাজশাহী কলেজে বিএ পড়ার সময়ই ফোকলোর চর্চায় উৎসাহী হন। গড়ে তোলেন গ্রামবাংলার বাউল-ফকিরদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ। দেশের নানাপ্রান্তে লোকসংগীত সংগ্রহের জন্য ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন। লোকসংগীত ও লোকসাহিত্য সংগ্রহে তিনি আশীর্বাদ পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও। তার প্রশংসা করে ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের পৌষ-সংক্রান্তিতে শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখেন, ‘বাঙলা দেশের গ্রামের গভীর চিত্তে উচ্চ সভ্যতার প্রেরণা স্কুল-কলেজের অগোচরে আপনা-আপনি কি রকম কাজ করে এসেছে, হিন্দু মুসলমানের জন্য এক আসন রচনার চেষ্টা করেছে, এই বাউল গানে তারই পরিচয় পাওয়া যায়। এই জন্য মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন মহাশয় বাউল সংগীত সংগ্রহ করে প্রকাশ করবার যে উদ্যোগ করেছেন, আমি তার অভিনন্দন করি।’ মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন গ্রামীণ জনপদে ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করেছিলেন প্রায় ছয় হাজার লোকগান। তার রচিত এবং সম্পাদিত বইয়ের সংখ্যা ৪২টি। যেখানে আগামীর জন্য  তিনি ধরে রেখেছেন নিজের চিন্তাকে। শুধু লোকগীতি ও লোককথাই নয়, তিনি তার মননশীল গদ্যে চর্যাপদ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের কবি-সাহিত্যিকদের ছবিও এঁকেছেন। সেই সঙ্গে মুসলমান কবিদের মধ্যে আদিতম কবি শাহ মোহাম্মদ সগীরসহ প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের মুসলিম লেখকদের পরিচয় পাওয়া যায় তার বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা গ্রন্থে।

মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন ছিলেন বিশ্ব মানব। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি ফোকলোর ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার, যা এই কর্মবীরের কল্পনা ও দূরদৃষ্টি যেখানে পরিস্ফুট হয় ভবিষ্যৎ সমাজের ছবি। ১৯৮৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান। তার স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫