Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

অচল পয়সা ভেজাল মানুষ

Icon

মাহবুব আলী

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৩৮

অচল পয়সা ভেজাল মানুষ

প্রতীকী ছবি

জান মহম্মদের চোখ এড়ায়নি। মাথার ওপর চকচকে সাইনবোর্ড। রয়েল বেকারি অ্যান্ড ফুডস। নিচে তার দৃষ্টিও ঝকঝকে। মধ্যদুপুর। সবকিছু রোদের আলোয় উজ্জ্বল। তবু তার মধ্যে অন্ধকার খুঁজে পায় কারো মন। উন্মন অস্থির ভাবনা সব সময়। অনেক কিছু আরো নিশ্চুপ দেখে যায়। এই ফাঁকে দুই চোখ চারপাশ ঘুরে আসে। তার বাঁ হাত, তেল কুচকুচে কালো ভুঁড়ি। উনিশ শ সাতষষ্টি। শহরের মানুষ বাড়ছে। কোথা থেকে ভেসে আসছে মানুষ আর মানুষ। এর মধ্যে ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যাও কম নয়। এই গল্প একজন মানুষ আর বালকের। এই কাহিনি সত্য বনাম শঠতার। উপলব্ধির। 

ছেলেটি অবশেষে সিকি কয়েনটি বয়ামের উপর রাখে। অস্থির দৃষ্টি। গুমোট আকাশের মতো মুখ। মøান। বিষণ্ন। রাস্তার ওপাশে দুল-চুড়ি-খেলনার দোকান থেকে নেইলপলিশের গন্ধ দমকা বাতাসের মতো ছুটে আসে।

‘নিমকি বিস্কুট দেন।’

‘চার আনার?’

মাথা কাত করে জবাব দেয় সে। তার চোখ-মুখ বসে গেছে। সকাল থেকে মুখে কিছু দিতে পারেনি। কি দেবে? ভারি করুণ মুখচ্ছবি! একটু কি ঘাবড়ানো? জান মহম্মদের দৃষ্টিতে মোটর বাইকের কালো ধোঁয়া উড়ে আসে। এখন রাস্তায় তেমন ভিড় নেই। আকস্মিক দু-একটি রিকশা-সাইকেল-ঠ্যালা কিংবা মোটর বাইক দেখা যায়। কখনো কখনো রাস্তা কাঁপিয়ে মিউনিসিপ্যালিটির গাড়ি। তার পেছনে জলের ফোয়ারা। রাস্তা ভিজিয়ে দেয়। মানুষের মন ভেজে না।

জান মহম্মদের হাতে কয়েন। অচল পয়সা। স্পর্শ করেই টের পায়। অভিজ্ঞতা কম হলো না। এখন হাতের তালুতে দুটি চোখ গজিয়ে গেছে। তবু কিছু বলে না। ক্যাশবাক্সে কয়েন ফেলে কাগজের ঠোঙায় বিস্কুট তোলে। বিস্কুটের তেলে ঠোঙা ভিজে ওঠে। কেউ নির্ণিমেষ তাকিয়ে থাকে সেখানে।

ছেলেটি রাস্তা পেরিয়ে পুবে চলে যায়। সেখানে একটি স্কুল। আজ রবিবার। স্কুল বন্ধ। সে আমগাছের ছায়ায় সিমেন্টের বেঞ্চে বসে। তার চোখে-মুখে রোদ। এলোমেলো পাতার ছায়ার সঙ্গে লুকোচুরি খেলে। সে একটি একটি করে বিস্কুট খেতে থাকে। অভিব্যক্তিহীন চোখে উত্তরে তাকায়। কত কিছু ভাবে। মা-বাবার কথা। পুরোনো দিনের হয়তো ছোট ছোট ঘটনা। তারপর উদাস চোখে পুনরায় মানুষ দেখা। মানুষের ভিড়ে নিজেকে খুব একলা লাগে। কেউ নেই তার। আমগাছের আলো-ছায়ার মধ্যে মাথার ওপর দু-একটি কাক মুখ হাঁ করে বাতাস গেলে। প্রচণ্ড রোদ। দাবদাহ।

জান মহম্মদ ক্যাশবাক্স খোলে। হাতড়ে তুলে আনে কয়েন। গোল। শীতল। রুপোলি। যা অনুমান করেছিল সঠিক। অচল পয়সা। দুই পয়সার চারকোনা কয়েন কেটে ঘষে সিকি করা হয়েছে। ছেলেটি কি জানে? জেনে-বুঝেই ঠকিয়ে গেল? জানে হয়তো অথবা জানে না। আট-দশ বছর বয়সী ছেলে জানবে না ঠিক নয়। ভেজাল মানুষ। সে তবে কেন জেনে-শুনে প্রশ্রয় দেয়? এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। আচ্ছা, সে নিজে কি আসল মানুষ? তার বাঁ হাত আবার ভুঁড়ির উপর একপাক ঘুরে আসে। সে নিজে ভেজাল ময়দা, পচা ডিম আর পুরোনো বাতিল তেলে মণ্ড করে। চাকু আর ডাইস দিয়ে কেটে কেটে তোলে বিস্কুট। লম্বা হাতায় টিনের ট্রে বসিয়ে তন্দুরে রেখে দেয়। সেগুলো গনগনে আগুনে ঝলসে ওঠে। সেঁকা হয় বিস্কুট। ফুলে-ফেঁপে ওঠে পাউরুটি। বাতাসে ছড়ায় লোভাতুর সুবাস। মানুষের রসনা ফুলে-ফেঁপে ওঠে। ফুলে-ফেঁপে ওঠে ক্যাশবাক্স। ফুলে-ফেঁপে ওঠে তার ভুঁড়ি। বছর বছর বদলে যায় দোকানের সাইবোর্ড। রং বাহারি রং। ঝিক ঝিক করে ওঠে তার আঙিনা। ছেলেমেয়ের পোশাক। জীবন আর বেঁচে থাকা। অথচ কখনো কখনো মনের ভেতর জেগে ওঠে অন্ধকার।

মন্দ আর ভেজাল জিনিসের স্বাদ বেশি। পচা ময়দা, পচা ডিম আর পচা তেলে তৈরি বিস্কুটে শান্তি বেশি। সে তৈরি করে। মানুষ খায়। খেয়ে মজা পায়। মজা পায় বলে দাম দেয়। তাকেও দাম দিতে হবে। তার দুই চোখে কোত্থেকে কেমন উপলব্ধি এসে জমা হতে থাকে। সেই যেমন ছেলেটি কয়েন বয়ামের উপর রেখে বলে বসে, সে কি চায়? তার চোখ-মুখে উদাস বাতাসের বিষাদ ছায়া। কোনো আতঙ্ক খেলা করে। ঘাবড়ে যাওয়া অস্থির। জান মহম্মদ দেখেছে। আচ্ছা, তেমন করে কি তার চেহারা বদলে যায়? সে কি চাইবে? অচল পয়সার ভেজাল মানুষ।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫