Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

বার্ডম্যান সালিম আলি : শিকারি থেকে পক্ষীবিশারদ

Icon

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ১৫:৩৪

বার্ডম্যান সালিম আলি : শিকারি থেকে পক্ষীবিশারদ

মামা তাকে কিনে দিয়েছিলেন একটি এয়ারগান। এই এয়ারগান দিয়ে মনের সুখে পাখি শিকার করতেন। তার গুলিতে ঘায়েল হয়েছিল এক আজব ধরনের চড়ুই; সেটা কি পাখি বা এর মাংস হালাল-এসব জানতে তিনি গিয়েছিলেন চাচা আমিরুদ্দিনের কাছে। আমিরুদ্দিন তাকে পাঠিয়ে দেন ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটিতে।  সেখানে সেক্রেটারি মিলার্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তিনি জানিয়েছিলেন পাখিটি দুর্লভ প্রজাতির। এর নাম  ইয়েলো থ্রোটেড স্প্যারো। একই সঙ্গে মিলার্ড  তার বিশাল সংগ্রহশালা উন্মুক্ত করে কৌতূহলী বালককে দেখালেন নানা ধরনের চড়ুই পাখির স্টাফ করা মৃতদেহ। মিলার্ডের সঙ্গে আলোচনার পরে বালক সালিমের চিন্তার দিগন্ত যেন খুলে গেল। তিনি পাখি শিকার বাদ দিয়ে পাখি ও প্রকৃতি নিয়ে যে ভাবনা জগতে ডুব দিলেন, তার মধ্য দিয়ে তিনি তাকে নির্মাণ করলেন ভিন্ন রূপে, ভিন্ন আঙ্গিকে। তিনিই  ভারতীয় উপমহাদেশের সেরা পাখিবিশেষজ্ঞ  সালিম আলি। তার লেখা ‘দ্য ফল অব আ স্প্যারো’ প্রকৃতির স্নিগ্ধ পরশ বুলানো সুখপাঠ্য আত্মজীবনী। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদে ‘চড়াই-উতরাই’ নামকরণ করেছিলেন তিনি। ৮৭ বছর বয়সে বইটি লেখা শুরু করেন, ততদিনে চির তরুণ পাখিবুড়ো উপাধি পেয়ে যান সালিম আলি। প্রথমেই স্মৃতির ঝাঁপি খুলে শৈশবের কথা বলেছেন।

সেই ধূসর সময়ে নানা রোমাঞ্চকর সত্য কাহিনি পড়ে তখন পর্যন্ত জীবনের লক্ষ্য ছিল বিখ্যাত একজন শিকারি হওয়া। কিন্তু বাড়িতে নানা ধরনের পাখি পোষা এবং প্রকৃতিতে পাখি দেখার নেশা থেকেই সিদ্ধান্ত নেন সম্ভব হলে জীববিজ্ঞানকেই পেশা হিসেবে নেবেন জীবনে। এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ ম্যাট্রিক পরীক্ষাতেই পাস করেছিলেন টেনেটুনে। তারপর মুম্বাইয়ের সেন্ট জাভিয়ের কলেজে এক বছর পড়ালেখা করেই ড্রপআউট হন। উদ্ভিদবিজ্ঞান পড়লেও প্রাণিবিজ্ঞান পড়ে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত সালিম আলি পাখি সম্পর্কে ছিলেন খুবই উৎসাহী। তার পরও কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট না থাকার দরুন, বহুবার রিক্ত হস্তে ফিরতে হয়েছে চাকরির দুয়ার থেকে। তার মধ্যে ১৯২৫ সালে ‘জুওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’র পক্ষীবিদের পদটি হাতছাড়া হওয়াটাই তাকে সবচেয়ে ব্যথিত করেছিল। অবশ্য পরের বছরই ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’ জাদুঘরে চাকরি পেয়ে যান। এই জাদুঘরের বর্তমান নাম ‘ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ ভাস্তু সংগ্রহশালা’। এখানে দুই বছর কাজ করেই নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি বৃদ্ধি করতে চলে যান জার্মানিতে। বার্লিনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি জাদুঘরে নমুনা বিশ্লেষণের কাজ করেন আরো বছর কয়েক।

পাখির ডানা ঝাপটার শব্দ শুনেও তিনি বুঝে ফেলতেন, সেটি কোন প্রজাতির পাখি! তিনি সালিম আলি, ভারতের ‘বার্ডম্যান’! পাখি পর্যবেক্ষণের ব্যাপারটিকে তখন নিছক সময় নষ্ট মনে করা হতো। সালিম আলি যখন পাখি নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন, তখন পৃথিবীতে পাখির আট হাজার ৫৮০টি স্বীকৃত প্রজাতি ছিল। এর মধ্যে এক হাজার ২০০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যেত ভারতে। কিন্তু বিজ্ঞানের অন্যান্য দিকে এক পা দুই পা করে এগোতে থাকা ভারত পক্ষীবিজ্ঞানে পিছিয়েই ছিল। পাখি দেখা বা পাখির একটি যথাযথ শ্রেণিবিভাজন করার প্রতি আগ্রহ ছিল না কারোরই। এই কাজটি শুরু করার সাহস দেখিয়েছিলেন তরুণ সালিম আলি। ভারতের পাশাপাশি আফগানিস্তান, তিব্বত, ভুটানের পাখির প্রজনন, তাদের বাসস্থান, জীবনযাত্রা সব কিছু নিয়ে খুঁটিয়ে কাজ করেছেন তিনি। প্রতিটি সমীক্ষার ওপর লিখেছেন বই।

সালিম আলির লেখা বুক অব ইন্ডিয়ান বার্ডস আজও পক্ষীপ্রেমীদের কাছে বাইবেলসম।  তার আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন-‘অস্থিতপঞ্চক সভ্যতার দ্রুতবেগের এই যান্ত্রিকযুগের কোলাহলময় ডামাডোল থেকে আমার মুক্তির রাস্তা হলো পাখি দেখা।’ সালিম নামে নামকরণ করা হয়েছে গোয়ার বার্ড স্যাংচুয়ারি, কেরলের থাট্টেকাড বার্ড স্যাংচুয়ারি, পুদুচেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স বিভাগ ইত্যাদি। ভারত সরকার তাকে ১৯৫৮ সালে ‘পদ্মভূষণ’ এবং ১৯৭৬ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক উপাধি ‘পদ্মবিভূষণে’ ভূষিত করে। এ ছাড়া তিনি ১৯৫৮ সালে ‘রাজ্যসভায় সদস্যরূপে মনোনীত’ হন । পক্ষীবিজ্ঞান কিংবা পরিবেশ রক্ষায় ভারতে ও বিশ্বে সালিম আলি ছিলেন নিজেই নিজের প্রতিযোগী। তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ‘পাখি নিরীক্ষণ করার মতন আপাত নিরর্থক বৃত্তিতেও কেউ যদি কায়মনোবাক্যে লেগে থেকে নিজেকে উজাড় করে দেন, তাহলে তার প্রাপ্তির ঘর কিছুতেই ফাঁকা যাবে না।’ এই মহান কর্মবীর ১৮৯৬ সালের ১২ নভেম্বর ভারতের মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৮৭ সালের ২০ জুন মৃত্যুবরণ করেন।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫