প্রতীকী ছবি
হাজার বছরের বাংলার ইতিহাসের পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও আত্মত্যাগের গাঁথা। যুগে যুগে অন্যায়-শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়েছে বাঙালি। বিনা দ্বিধায় উৎসর্গ করেছে নিজের জীবন। সাধারণের রক্তে রচিত হয়েছে ইতিহাস। সাধারণ মানুষের জেগে ওঠা, গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনগণের সংঘটিত প্রতিরোধই আমাদের ইতিহাসের গৌরবান্বিত অধ্যায়। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, চুয়াড় বিদ্রোহ, টংক, তেভাগা, নানকার বিদ্রোহসহ অসংখ্য ছোট-বড় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণমানুষের রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাসই বাংলার ইতিহাস।
নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোরই আরেক পর্ব বৃহত্তর ময়মনসিংহের শেরপুর অঞ্চলের পাগলপন্থি আন্দোলন। আজকে আমরা অসাম্প্রদায়িক এই আন্দোলন সূচনাপর্বের ২০০ বছর অতিক্রম করছি। পাগলপন্থি আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন টিপু শাহ ওরফে টিপু পাগল। তিনি বহন করেছেন তার বাবা করিম শাহের উত্তরাধিকার। করিম শাহ উত্তর ময়মনসিংহ জেলার গারো পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষা শেরপুরের সুসং পরগনায় ১৭৭৬ থেকেই প্রচার করতেন, ‘মানুষ এক আল্লাহর সৃষ্টি; সুতরাং সবাই সমান ও পরস্পরের ভাই।’ তার এই অহিংসা এবং সাম্যের বাণী মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রভাব ফেলে।
গারো, হাজং, ডলু, হুদি এবং রাজবংশীসহ নানা গোত্রের বঞ্চিত মানুষের মাঝে আলোড়ন তোলে। ১৮১৩ সালে করিম শাহের মৃত্যুর পর টিপু শাহ ওরফে টিপু পাগল উত্তরাধিকারসূত্রে পাগলপন্থিদের নেতৃত্ব পান। ১৯১৪ সালে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, যা স্থায়ী হয় ১৯১৮ পর্যন্ত। এই যুদ্ধের অভিঘাতে এবং পরবর্তী সময়ে ১৮২৪-২৬ পর্যন্ত ইঙ্গ-বার্মা যুদ্ধে ইংরেজদের যে বিপুল আর্থিক ক্ষতি হয়, সেই ঘাটতি মেটাতে তারা স্থানীয় জনগণের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে দেয়। ময়মনসিংহ অঞ্চলেও অস্বাভাবিক হারে কর বাড়ানো হয়। ফলে কৃষকদের দুরবস্থা চরমে ওঠে। পাগলপন্থিরা এর প্রতিবাদ করেন। দক্ষিণ-পশ্চিমে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ, উত্তরে গারো পাহাড়রাজি এবং পূর্বে হাওর এলাকার বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে সূচনা হয় বিদ্রোহের। অতিরিক্ত কর দিতে অস্বীকার করে পাগলপন্থিদের আন্দোলনের ১৮২৪ সালে। এ আন্দোলন প্রথমে স্থানীয় জমিদারদের বিরুদ্ধে হলেও এক পর্যায়ে তা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়।
টিপু শাহের নেতৃত্বের পাগলপন্থিরা ১৮২৫ সালে শেরপুর শহর ও জমিদারদের স্থাপনাগুলো দখল করে টিপু শাহ নিজেকে স্বাধীন শাসক ঘোষণা করেন। পাগলপন্থিরা জানিয়ে দেয়, তারা জমিদারের শোষণ-অত্যাচার মানতে রাজি নয়। প্রথম পর্বের এ আন্দোলন চলে প্রায় দুই বছর। এ প্রসঙ্গে ময়মনসিংহ জেলার তৎকালীন গেজিটিয়ারে লেখা হয়েছে, ‘১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে পাগলপন্থি গারো-বিদ্রোহ জমিদারদের ভয়ংকর শোষণ-উৎপীড়নেরই অনিবার্য পরিণতি।’ আর কেদারনাথ মজুমদার ময়মনসিংহের ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, ‘জমিদাররা প্রজাদের কাছ থেকে বাটোয়ারার খরচ আদায় করতে বর্ধিত হারে খাজনা ধার্য করে। এই উৎপীড়ন সহ্য করতে না পেরে বহু প্রজা জমিদারদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।
টিপু শাহ বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং শেরপুরে বিদ্রোহ গড়ে তোলেন।’ পাগলপন্থিদের শেরপুর দখল করে রাখার দুই বছরে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে তাদের কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধও হয়। ১৮২৬ সালের শেষ ভাগে রংপুর থেকে আসা ইংরেজদের একটি শক্তিশালী সৈন্যদলের সঙ্গে যুদ্ধে বিদ্রোহীরা পরাজিত হয়। ১৮২৭ সালে টিপু শাহ বন্দি হন এবং বিচারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কারাবাস কালেই ১৮৫২ সালের মে মাসে তিনি মারা যান। আন্দোলন চলে ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত। তবে এই সময়ের মধ্যে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে অনেক অন্যায় কর ও উৎপীড়নমূলক আইন তুলে নেয়। আন্দোলন স্তিমিত হলেও তার রেশ থেকে যায় প্রায় ৫০ বছর।
