তথাগত বুদ্ধের প্রবর্তিত ধর্ম ও দর্শন মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি ও কল্যাণের জন্য ভিক্ষুসংঘকে চারদিকে বিচরণ করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন, ‘চরক্খং ভিক্খবে বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়’ এই নীতি ও আদর্শকে ধারণ করে বুদ্ধের দর্শন প্রচার ও প্রসারে ভিক্ষুসংঘের অবদান ছিল অপরিসীম।
চর্যাপদের লেখকদের অনেকেই বাংলা অঞ্চলের, তিলপা, বনরত্ন, আচার্য শান্তরক্ষিত, জ্ঞানতাপস অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান ছাড়াও আরো অনেক বৌদ্ধ পণ্ডিত ভিক্ষু বাংলা অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করে বাংলার অঞ্চলকে করেছে গৌরাবান্বিত ও সমৃদ্ধ। তাদের মধ্যে আমরা আচার্য শান্তিরক্ষিত ও জ্ঞানতাপস অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞানের জন্ম অন্যতম, ঢাকার বিক্রমপুরের (মুন্সীগঞ্জ) বজ্রযোগিনীতে জন্ম। বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগের মুন্সীগঞ্জ (বিক্রমপুর) জেলার বজ্রযোগিনী গ্রামে জ্ঞানতাপস অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান (চন্দ্রগর্ভ) ৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
১০২৫ সালে পালরাজাদের প্রতিষ্ঠিত বর্তমান বাংলাদেশের বগুড়ার সোমপুর মহাবিহারে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং এ সময়ে বই লিখলেন ‘মধ্যামকররত্নপ্রদীপ’ ও ‘তর্কজালা’। সোমপুর বিহারে প্রায় সাত (৭) বছর অবস্থান করেন, এরপর বাংলার পালরাজা ন্যায়পালের অনুরোধে বিক্রমশীলা বিহার ও বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। পাল রাজা ন্যায়পাল ১০৩৩ খ্রিষ্টাব্দে অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞানকে বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব অর্পণ করেন। বিক্রমশীলায় ‘সংসার-মনোনির্যাণীকার-গীতি’ সংকলনে গুরুত্ব এবং সংসারের দুঃখময় জগৎ হতে মুক্তির জন্য উপদেশ প্রদান করেন।
‘‘ও আমার সখারা, কেবল ভাবো, অনন্তকালব্যাপী/প্রতীত্যসমুৎপন্ন হয়ে তুমি আবর্তিত হয়ে চলেছ :/তিন ভাগবিশিষ্ট এবং বারো অর-বিশিষ্ট পানির চাকার মতো,/যার গুরু অবিদ্যা থেকে এবং যার শেষ জরা ও মৃত্যুতে।/ অগুনতি জীবনের পর এই জীবন, এখন আবারও জন্ম নিয়ে,/ তুমি দুঃখগ্রস্ত হয়ে চলেছে বারংবার/ জন্ম, পৌঢ়ত্ব, রোগ ও মৃত্যুর চক্রে।/ আবিদ্যার কারণে ভবচক্রে (আবারও) আবর্তিত হবে।/কী দুর্ভাগ্য!’’
১০৩৯-৪০ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝিতে ভারত ও নেপালের মধ্য দিয়ে অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান তিব্বতের উদ্দেশে যাত্রা করেন। নেপাল থেকে বিদায় নেওয়ার সময় জ্ঞানতাপস অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান পালরাজ ন্যায়পালকে উপদেশমূলক একটি পত্র লেখেন, কিভাবে রাজ্য শাসন করবেন এবং প্রতিবেশী রাজাদের সঙ্গে ব্যবহার কেমন হবে-প্রিয় রাজা ন্যায়পালকে ‘বিমলরত্নলেখ’ নামে পত্র লেখেন। এই পত্রের কিছু অংশ তুলে ধরলাম-
‘নয়পাল, যার জন্ম মগধে বৌদ্ধমত প্রচার করেন এবং ধর্মসম্মতভাবে পরিচালনা করেন রাজ্য তার সমৃদ্ধি হোক। অতীতে তুমি দান করে গেছ, যাপন করেছ দশ-পুণ্য, চর্চা করেছ ক্ষমা ও সাহসের।
এ কারণেই তুমি, দেব, তিন পারমিতার ধন্য। ক্রোধ এবংঅহংকার ত্যাগ করো। নিরহংকার হোক তোমার মন।
অসাধু উপায়ে জীবিকা নির্বাহ কোরো না, বাঁচো ধর্মসম্মত উপায়ে।’
তিব্বতীয়দের জ্ঞানের আলোয় আনয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখলেন, বোধি-পথ-প্রদীপ’ lamp for the path to Enlightenment ও ‘বোধিমার্গ-প্রদীপ-পঞ্জিকা’ এবং দৈনন্দিন জীবনের চরিতের জন্য ‘দশ-অকুশল-কর্ম-পথ-দেশনা’ মানুষের সুস্বাস্থ্যর জন্য লেখেন, ‘চিকিৎসা-জীব-সেবা’ ‘The Method of Curing Head Ailments’ এভাবে দুই শতাধিক গ্রন্থ ও অনুবাদ রচনা করেন। পরবর্তী সময়ে শিষ্যকেই অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞানের উত্তরাধিকার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিব্বতের রাজা চংছুবের অনুরোধে ‘বোধি-পথ-প্রদীপ’ গ্রন্থটি রচনা করেন এবং গ্রন্থটি রাজার কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য বই হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তাই তিব্বতের রাজা চংছুব দীপংকর শ্রীজ্ঞানকে ‘অতীশ’ উপাধি প্রদান করেন। এই বইয়ে অতীশ বলেন, “পুরুষকে তিন প্রকার জানতে হবে-অধম, মধ্যম এবং উত্তম। তাদের প্রত্যেকের লক্ষণ তাদের ভেদের মাধ্যমে উপস্থাপন করছি। জ্ঞানতাপস অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান তিব্বতের নাথাঙ বৌদ্ধ বিহারে ১০৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মহাপ্রয়াণ করেন।
