
কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন চিরশিশু। চিরশিশু এই কবির জীবন কাহিনি বড়ই বিচিত্র। কবির বয়স যখন নয়-দশ বছর, তখন তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। পিতার মৃত্যুর পর সংসারের সব দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর ওপর। এতে তাঁর মা খুব হতাশ হয়ে পড়েন। পিতার মৃত্যুতে কবি দু’চোখে অন্ধকার দেখতে থাকেন। সংসারের হাল ধরতে অল্প বয়সেই তিনি মক্তবে শিক্ষকতার কাজ নেন।
এভাবে কখনো মাজারের খাদেম, আবার কখনোবা মসজিদের ইমামতি করে তাঁকে রোজগার করতে হতো। যে বয়সে শিশুরা বই-খাতা হাতে নিয়ে স্কুলে যায়, তিনি তখন জীবিকার সন্ধানে কঠিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এর মাঝে হঠাৎ তিনি ঝুকলেন গানের দিকে। কাজের ফাঁকে তখন কবি যাত্রাগান, কীর্তন ইত্যাদি শোনেন। আর লুকিয়ে লুকিয়ে ছড়া-কবিতা লিখে মাকে শোনাতে থাকেন। কবির চাচা কাজী বজলে করিম সুন্দর গজল ও ফার্সি কবিতা লিখতেন। নজরুল চাচার এ প্রতিভা দেখে নিজেও গান কবিতার দিকে ঝুকে পড়লেন। কবির প্রতিভা দেখে কেউ কেউ তাঁকে ব্যঙ্গ করে নাম দেয় ব্যাঙাচি। আবার কেউ কেউ বলেন, এই ব্যাঙাচিই হবে আগামী দিনের কেউটে সাপ। সেই ভবিষ্যদ্বাণী একদিন অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল তা তোমরা অনুমান করতে পারছ নিশ্চয়ই।
নজরুলের অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় পরবর্তীতে আমরা পেয়েছি। বিশেষ করে ছোটদের জন্য কবির ছিল খুব বেশি দরদ। তাই তাদের জন্য রচিত শিশুসাহিত্যে কবি এনেছিলেন বিপ্লব। তাঁর রচিত কবিতা- লিচু চোর, খাঁদুদাদু, খুকী ও কাঠবেড়ালী, চিঠি, খোকার সাধ, ঝিঙে ফুল, সাত ভাই চম্পা, প্রভাতী, ফ্যাসাদ, মটকু মাইতি বাটকুল রায় ইত্যাদি ছড়া-কবিতাগুলোতে তিনি আসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন।
লিচু চোর কবিতাটির কথাই ধরা যাক-
বাবুদের তালপুকুরে/হাবুদের ডাল কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া/বলি থাম একটু দাঁড়া।
পুকুরের ঐ কাছে না/লিচুর এক গাছ আছে না?
হোথা না আস্তে গিয়ে/য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গ্যে যেই চড়েছি/ছোট এক ডাল ধরেছি।
এভাবে লিচু চোরের কী দশাই না হয়েছিল সে কথা নিশ্চয়ই তোমরা জানো। তৌবা নাক খপতা বলে পগার পাড় হয়েছিল সে।
দাদুর সঙ্গে ঠাট্টা করতে গিয়ে খোকা মাকে বলছে-
‘অ- মা! তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং?
খাঁদা নাকে নাচছে ন্যাদা-নাক ড্যাঙা ড্যাং ড্যাং।
ওঁর নাকটাকে কে করল খাঁদা র্যাদা বুলিয়ে?
চামচিকে ছা বসে যেন ন্যাজুর ঝুলিয়ে।
এভাবে দাদুর সঙ্গে কত মজাই না করল খোকা।
খুকী ও কাঠবেড়ালী কবিতাটির কথাই ধরা যাক। কাঠবেড়ালী গাছে বসে আপন মনে পেয়ারা খাচ্ছে। তাকে দেখে খুকীরও পেয়ারা খেতে ইচ্ছে হলো। কী করা যায় এখন? কাঠবেড়ালীর কাছেই বায়না ধরলো সে।
কাঠবেড়ালী! কাঠবেড়ালী! পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি-নেবু? লাউ?
বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও?
ডাইনি তুমি হোঁৎকা পেটুক,
খাও একা পাও যেথায় যেটুক।
বাতাবি-নেবু সকলগুলো,
একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো!
তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে
পুটুস পাটুস চাও?
পেয়ারার লোভে তাকে ছোড়দি, বৌদি, রাঙাদিদি, কত নামেই না ডাকলো। এমন কি নিজের সুন্দর ফ্রক ও জামা দিতেও রাজি হলো সে। এতসব দেওয়ার কথা বলেও যখন পেয়ারা পেল না, তখন কাঠবেড়ালীকে ছোচা বলে গাল দিয়ে, আড়ি দিয়ে তবেই সব রাগ ঝাড়লো সে।
বাবার কাছে নামতা শিখতে গিয়ে খোকা নিজেই বাবা সেজে কী বলছে দেখ-
আমি যদি বাবা হতুম/বাবা হত খোকা
না হলে তার নামতা পড়া/মারতাম মাথায় টোকা।
বাবা-মার সঙ্গে এমন খুনসুটি নিয়ে কবির অনেক লেখা রয়েছে, যা তোমরা নিশ্চয় পড়েছ।
মায়ের কোলে শিশুন আগমন নিয়ে কবির একটি চমৎকার কবিতা রয়েছে। যা একবার পড়লে বারবার পড়তে ইচ্ছে করবে।
পার হয়ে কত নদী কত সে সাগর
এই পাড়ে এলি তুই শিশু জাদুকর।
কোনো রূপলোকে ছিলি তুই রূপকথা তুই
রূপ ধরে এলি এই মমতার ভূঁই।
...
ছোট তোর মুঠি ভরে আনিলি মণি
সোনার জীবন কাঠি মাথায় ননী
তোর সাথে ঘর ভরে এলো ফাল্গুন
সব হেসে খুন হলো কী জানিস গুণ?
পেলি হেতা ঠোঁট ভরা মধু চুম্বন,
আমি দিনু তোর হাতে নামের কাঁকন।
এমন অনেক সুন্দর মনোরম কবিতায় কবি ভরিয়ে তুলেছেন পাঠক মন।
সকাল বেলার পাখি কবিতাটির কথাই ধরা যাক-
আমি হব সকাল বেলার পাখি,
সবার আগে কুসুমবাগে/উঠব আমি ডাকি।
সূর্যি মামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে,
হয়নি সকাল ঘুমো এখন মা বলবেন রেগে।
খোকা সকাল বেলার পাখি হতে চাইছে। খোকার এই ইচ্ছে সকল শিশুর আশা, আকাক্সক্ষার সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। যা ছোট-বড় সব পাঠকের মনে দোলা না লেগে পারে না।
কবি নজরুলের সাহিত্যকর্মের সময় ছিল মাত্র ২৫ বছর। এই ২৫ বছরে অন্য সাহিত্যের পাশাপাশি শিশু সাহিত্যে যা দিয়েছেন তার মূল্য কম নয়। তিনি যদি আরও সময় পেতেন তাহলে তোমাদের জন্য আরও অনেক শিশু সাহিত্যের ভাণ্ডার দিয়ে যেতে পারতেন।
শিশুর সারল্যে কেটেছে কবি নজরুলের সারাটি জীবন। তাঁর রচিত গান, কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, নাটিকা সবই সহজ সরল সাদামাটা ভঙ্গিতে লিখে গেছেন। এখানেই অন্য লেখকের সঙ্গে কবি নজরুলের স্বাতন্ত্র্য ধরা পড়েছে।