
ও হেনরি।
উইলিয়াম সিডনী পোর্টার, যিনি বিখ্যাত তাঁর ছদ্মনাম ‘ও হেনরি’ নামে ছোটগল্প লিখে। তিনি ১৮৬২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯১০ সালের ৫ জুন তিনি নিউইয়র্ক শহরে মারা যান। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আলোচিত ছোট গল্পকারদের একজন। ও হেনরি আমেরিকান জীবনযাপন নিয়ে প্রায় ছয় শতাধিক গল্প লিখেছেন। এক সময়ে এদেশে কলেজে পাঠ্য হওয়ার কারণে তাঁর লেখা ‘দ্য গিফট অব ম্যাজাই’ গল্পটি বাংলাদেশে খুবই পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
এ গল্পটি ১৯০৬ সালে তাঁর বিখ্যাত গল্প সঙ্কলন ‘দ্য ফোর মিলিয়ন’-এ সঙ্কলিত হয়। তাঁর কর্মজীবনের শুরুতে তিনি একটি খামার বাড়িতে কাজ করেছিলেন। আবার স্নাতক পর্য়ায়ের অধ্যয়ন শেষ করে তিনি ফার্মাসিস্ট হিসেবেও কাজ করেন, এমনি করে তিনি নানা পেশায় নিয়োজিত হয়েছিলেন। তিনি এক সময়ে ভবঘুরে জীবন-যাপনও করেন। ছোটগল্প লিখে তিনি নিজের এবং পরিবারের সব ব্যয়ভার বহন করতেন। মানুষ তাঁর প্রবল ইচ্ছা শক্তির বলেই সকল অসম্ভবকে জয় করতে পারে এটা ও হেনরি’র কাজের মধ্যে দিয়ে প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি তাঁর জেল জীবনে ১৪ টি গল্প লিখেছিলেন, ধৈর্য্য আর মেধার গুণে তিনি সমাজে একজন বড় গল্পকার ও সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান।
ইংরেজী সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল ও বিশ্বের অন্যতম সর্বাধিক জনপ্রিয় গল্পকার ও হেনরি’র গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র এবং তা বেশ দর্শক নন্দিতও হয়েছে। স্বল্প সাহিত্য জীবনের পরিসরে তিনি রচনা করেছেন কালজয়ী সাহিত্যকর্ম যা তাঁকে দান করেছে অমরতা। এছাড়া তাঁর লেখা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে তা সেসব দেশে পাঠ্যও হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে।
ভিন্ন আমেজে সাহিত্য পরিবেশনা তাঁর রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো গল্পের খাতিরেই কেবল সজীব আর সাবলীল নয়, স্রষ্টার ছোঁয়ায় যেন তারা বাস্তবের মতো মূর্ত হয়ে উঠেছে, কলকল ঝরঝর করে প্রমত্তা নদীর মতো ছুটে চলেছে দুর্বার। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো দুর্ভাগ্যের মধ্যেও প্রচন্ড সাহসী, ব্যর্থতার বেড়াজালে অদম্য সাহসী, কখনওবা বিত্তবানদের অনুসরণ করতে গিয়ে অবস্থান করে নিয়েছে আরব্য রজনীর কাল্পনিক জগতে।
শহরের জীবনযাত্রা নয়, শহুরে মানুষ তাঁর গল্পের প্রধান উপজীব্য হলেও তিনি তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের মনস্তাতিক সবিস্তারে আলোচনায় দেখিয়েছেন অনীহা। কারণ, তাদের তিনি কেবল মানুষ হিসাবে দেখাতে চেয়েছেন। সমস্ত হিসেব-নিকেশের উর্ধ্বে রোমান্টিক মনটাই তাঁর আলোচ্য ও প্রধান প্রতীয়মান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশাল নগরের যান্ত্রিক জীবনে তাঁর প্রতিটি চরিত্র যেন এক একটি উর্বর বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো যেখানে জীবনের বেঁচে থাকার আশা আছে, হতাশা আছে, কঠিন বাস্তবতার নিগড় আছে, আর আছে অসীম স্বপ্নের ভান্ডার!
ও হেনরি’র শ্রেষ্ঠ গল্প নামে এদেশে একটি অনুবাদ গ্রন্থ পাওয়া যায়, এই গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘দ্য গিফট অব ম্যাজাই’ বা উপহার বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ট ছোট গল্প। যেখানে স্বল্প পরিসরে বৃহৎ ভালোবাসার অসীম ক্যানভাস মেলে ধরেছেন লেখক। যেখানে ভালোবাসার যে পদ্য রচিত হয়েছে তাতে অদ্ভুত এক প্রশান্তির ছায়া রয়েছে, যে যার সর্বোচ্চ গর্বের বস্তুর বিনিময়ে ভালোলাগার মানুষের মুখের এক টুকরো হাসি দেখবার আকুতিতে। তারা যীশুর জন্মের সময় আগত উপহার বহনকারী ঐসকল রাজন্যবর্গ হতে লেখকের চোখে এই জন্য জ্ঞানী সে, কেবল উপহার প্রদানের ধারাবাঁধা রীতিতে নয়, ভালোবাসার ফল্গুধারার অনন্ত বাহক হবার চমৎকার সৎসাহসের উপস্থিতি এ গল্পকে করেছে কালজয়ী।
চমৎকার লেগেছে ‘ঘুর ও বেঘুর’ যেখানে ঘোপি নামক এক ভবঘুরের বেঁচে থাকার জন্য লড়াইয়ের অনবদ্য কাব্য। যখন কল্পনাবিলাসী কিন্তু আত্মমর্যাদায় অনন্য ঘোপি শীতের তান্ডবের হাত থেকে বাঁচবার জন্য দিনমান দ্বীপের জেলে যাবার রাস্তা খুঁজে, তখন নিস্তব্ধ মোড়ের গীর্জার অর্গানের ধ্বনি তাকে করে তোলে অধিক স্বপ্নাতুর, নিয়ে যায় তার অতীতের কাছে যেখানে তার সব ছিল। ব্যর্থতার গ্লানি কাটিয়ে সে যখন অতীতের সেই ধূসর হয়ে পাওয়া স্বপ্নকে আবার রঙের আলপনায় ভরিয়ে তুলতে চায় কঠিন বাস্তবতা যেন তাকে ভেংচি কেটে আবার টেনে নিয়ে যায় সেই অসহায়ত্বের মাঝে, যেখানে মানুষ ভালো হতে চাইলেও সমাজ তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় তার সরল এক ছবি গল্পকার এখানে ঘোপির মাধ্যমে তুলে ধরেছেন, যা এক কথায় চমৎকার বাস্তবানুরাগ।
‘শেষ পাতা’ আশাহত মানুষের জীবনে ফিরে আসার অনাবিল সুরের আবেশ, যেখানে শৈল্পিক তুলির আঁচড়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকা একজন মানুষের ফিরে আসার মানবিক গল্পের অনবদ্য এক চিত্রকর্ম।
‘প্রেম, ঘড়ি ও খলিফা’ নামের মাঝেই এক চমক। প্রেমের সাথে সময়ের দ্বন্ধ চিরকাল। প্রেমে অপেক্ষা এক দুঃসহ যন্ত্রণা আর খলিফা এখানে দূর-দৃষ্টিসম্পন্ন এক জ্ঞানের প্রতীক যে সেখানে প্রেমে ধৈর্য্য এক মহৎ উদ্যোগ। ধৈর্য্য ধরলে পাওয়া যায় অমূল্য রত্ন, রাজ্য আর রাজকন্যা- দুই। চমৎকার এক কাহিনী যেখানে আছে রোমাঞ্চ আর বাস্তবের চমৎকার সম্মিলন।
অসাধারন লেগেছে ‘কুবের ও ফুলশর’। টাকার প্রয়োজন নেই আবার টাকাই সর্বত্র। টাকা দিয়ে মৃত্যু ব্যাতিরেকে সবই আটকানো এবং পাওয়া সম্ভব। তা প্রকাশ্যেই বা অপ্রকাশ্যেই হোক।
‘বিশ্ব নাগরিক’ প্রত্যেক মানুষের তার জন্মস্থানের প্রতি সে আদি ও অকৃত্রিম ভালোবাসা তার এক অনুপম চিত্র যেখানে কোগলান নিজেকে বিশ্ব নাগরিক বলে দাবি করলেও অন্যলোকের মুখে নিজের শহরের বদনাম শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি এবং কেউ পারেও না।
প্রতিটি গল্পই রোমান্স আর বাস্তবতার পটে মূর্ত, সুন্দর আর অসুন্দেেরর গল্প, যেখানে আশা-হতাশা, অ্যাডভেঞ্চার ভীরুতা, ভালোবাসা- ঘৃণার চমৎকার এক ছুটে চলা যা শহরের নাগরিক জীবনের সাথে জড়িয়ে গদ্যের কাব্যময় উপস্থাপন। আর ও হেনরির এই সাবলীল ছুটে চলাই তাঁর রচনাকে করেছে কালোত্তীর্ণ।