
জেমস জয়েস।
একশত ষোল বছর আগে জেমস জয়েস এবং নোরা বার্নাকেল প্রথমবারের জন্য একসঙ্গে হেঁটেছিলেন। ১৯০৪ সালের ১৬ জুন অর্থাৎ এই ‘পূর্ণবিকশিত দিন’-এ অ্যালিসেস নামক উপন্যাসটির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। নিজ জীবনের অপ্রকাশিত অসংখ্য দৃশ্যের মাধ্যমে জয়েসের আখ্যানগুলো বেড়ে উঠেছে।
নোরা ছিলেন ফিন হোটেলের কর্মচারী। তারা সাক্ষাতের আয়োজন করেছিলেন ৬ ক্লেয়ার স্ট্রিট পেরিয়ে হোটেল এবং মেরিয়ন স্কোয়ারের মাঝে- যেখানে স্যামুয়েল বেক্টের বাবা তার ব্যবসা চালাতেন, যেখানে বেক্ট তার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘মরফি’ রচনা করেছিলেন।
১৯০৪ সালে জয়েস ‘ডাব্লিনারস’ বইটির গল্পগুলো রচনা শুরু করেছিলেন। নোরা সাক্ষাতের জন্য পরিকল্পনা করেছিলেন স্যার উইলিয়াম ওয়াইল্ডের বাসস্থানের বাইরে, যেখানে কেটেছিল অস্কার ওয়াইল্ডের ছেলেবেলা। ব্রাম স্টোকার, যিনি ডাবলিন ট্রিনিটি মহাবিদ্যালয়ে ‘ওয়াইল্ড’ নামে পরিচিতি অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন এই বাড়িটির অতিথি। তার স্ত্রী ছিলেন অস্কার ওয়াইল্ডের প্রাক্তন বান্ধবী। যদি আপনি এই নামগুলোর সঙ্গে পরিচিত হন, তবে জানতে পারবেন- এভাবেই ডাবলিনের জরাজীর্ণ শহরটি পবিত্র স্থানে পরিণত হয়েছে।
১৯৭৪ সালে শরৎকালে হ্যাচ স্ট্রিটের ভিক্টোরিয়ান বাড়িগুলোর বেজমেন্টের পেছনে আমি একটা স্যাঁতসেঁতে ঘর নিয়েছিলাম। হাঁটাপথে আমার এখান থেকে বাড়িগুলোর দূরত্ব ছিল ১০ মিনিট। বাড়িগুলো ১৯৮০ সালে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। ওপরতলায় বসবাসকৃত ভদ্র বাড়িওয়ালি আমার ঘরটিকে ‘বাগান বাড়ি’ বলতেন। অট্টালিকার সর্বনিম্ন তলে একটি নিচু বারান্দা এবং বাইরে একটি শৌচাগার ছিল; কিন্তু সেখানে কোনো স্নানাগার ছিল না। রাত্রিবেলা যখন আমি পানশালা বা জাতীয় গ্রন্থাগার থেকে হাঁটাপথে বাড়ি ফিরতাম, নিঃসঙ্গ রাস্তাটি স্টিফেন গ্রিনের বাসস্থান থেকে হ্যাচ স্ট্রিটের দিকে অগ্রসর হয়েছিল।
পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে জাতীয় মিলনকেন্দ্র স্থাপিত হবার পূর্বেই এইগুলোর অবস্থান লক্ষ্য করা যেত। বিশ্ববিদ্যালয়টিকে শহরতলিতে স্থানান্তর করা হয়েছিল। হারকোর্ট স্ট্রিটের রেললাইনগুলো যেন হ্যাচ স্ট্রিটের বাড়িগুলোকে পেছনে ফেলে দৌড়াতে থাকে। এটা কল্পনা করা কঠিন নয়, ডাবলিনারে জেমস জয়েস যেই শহরের কথা উল্লেখ করেছেন, বর্তমানে তার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। মনে হয় শহরটি যেন অনেক বেশি পক্ষাঘাতগ্রস্ত, যা জয়েসের কল্পনাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। তিনি তার গদ্যে এক বিদ্বেষপূর্ণ চেতনার আশ্রয় নিয়েছিলেন- যা রাতের নিঃসঙ্গ ব্যক্তিটির উপস্থিতির মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়েছে।
আমার সম্মুখের ভূগর্ভস্থ ঘরটিতে একজন ব্যক্তি বসবাস করতেন। তিনি প্রত্যহ সকালবেলা কাজে যেতেন এবং রাত্রিবেলা ফিরে আসতেন। অনেক সময় সাধারণ মানুষের মতো স্যুট পরিধান অবস্থায় তাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম। যদিও তিনি অফিসে কাজ করতেন, সুতরাং তাকে দেখে আশ্চর্য হবার মতো কিছুই ছিল না; কিন্তু তিনি সাধারণ মানুষ ছিলেন না। তার ঘরে বিদ্যুৎ ছিল না। তিনি মোমবাতির আলোতেই বসবাস করতেন।
তিনি কখনো আমার দরজাকে অতিক্রম করে আমাদের উঠানের পেছনের শৌচালয়টিতে যেতেন না। তার ঘরে ফেলবার জন্য কোনোরকম আবর্জনাও ছিল না। তিনি সপ্তাহের শেষ দিনে বেশিরভাগ সময়েই তার বিছানার ওপর কাটাতেন কিন্তু সপ্তাহের মধ্যবর্তী দিনগুলোতে তিনি ৯টার আগেই বেরিয়ে যেতেন এবং মধ্যরাতে পানশালা বন্ধ হলে তিনি ফিরে আসতেন। তার রাত্রিবেলার গতিবিধি দেখেই আমি উপলব্ধি করতে পারতাম শহরের কোনো একটি পানশালায় তিনি সন্ধ্যাবেলাটি অতিবাহিত করে এসেছেন।
হীনতা, একাকি এবং গোপনীয়তায়পূর্ণ জীবনের চিন্তা-পুরুষদের একাকিত্ব, মাদকাসক্তে বিভোর হয়ে ফুরিয়ে যাওয়া অর্ধেক জীবন, কর্মক্ষেত্রে ফাঁদের শিকারগ্রস্ত হওয়া, একটি বোর্ডিং বাড়িতে অথবা উন্মুক্ত ঘরে বসবাস, স্বল্প শিক্ষা থাকা সত্ত্বেও অসংখ্য আশা নিয়ে বেঁচে থাকা প্রভৃতি বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে ডাবলিনার্সের গল্পগুলোর মধ্যে একটি গতিময়তা তৈরি হয়েছিল। টু গ্যালান্টস, দ্য বোর্ডিং হাউস, অ্যা লিটল ক্লাউড, কাউন্টার পার্টস, অ্যা পেইনফুল কেস এবং গ্রেস প্রভৃতি তার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।
জয়েসের মানবজীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিস্থিতি এবং নিয়তি সম্পর্কিত বিষয়ের চেয়ে তার আবিষ্কৃত নাম এবং বিশেষত নির্জনতার প্রতি তুলনামূলক বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন। নিজস্ব গভীর তন্ময়তা এবং স্বতন্ত্র আত্মচেতনার বিচ্ছিন্নতা অপ্রকাশিত অবস্থাগুলোকে তিনি নাটকীয়তার সঙ্গে প্রস্ফুটিত করতে তৎপর হয়েছিলেন। আত্মসৃষ্ট ভয় এবং অভিসন্তাপ, উপেক্ষা এবং অসততা, সাহসিকতা অথবা ভীরুতা, নিঃসঙ্গ খাঁচায় নিজেকে আবদ্ধকরণ অথবা হিংস্র লালসা প্রভৃতি বিষয়ে দৃষ্টিপাতের মাধ্যমে তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন। কারণ নিজের থেকে নিজে এবং জীর্ণ শহর থেকে পালাবার কোনো রকম উপায় অবশিষ্ট নেই। এইগুলোই ছিল তার বিষয়বস্তু।
ডাবলিনার্সে জয়েস তার প্রাপ্তবয়স্ক অভিজ্ঞতা সম্পন্নের সঙ্গে শৈশবের নিরীহতা সম্পন্ন গল্পগুলোকে একই সুরে বাঁধতে চাননি। শৈশব এবং তারুণ্যের প্রথমদিকের গল্পগুলোর চেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় লেখা গল্প ছিল বেশি ভয়ংকর।
‘অ্যান এনকাউন্টার’ গল্পটিতে কথক ছিল একজন বিদ্যালয় পড়ুয়া বালককে মানুষের বিকৃত যৌন লালসার শিকার হতে দেখা গিয়েছে। (স্ট্যানিসলাস জয়েসের মতে, এই গল্পটি ছিল জয়েসের তারুণ্যের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।)
‘আরবি’ গল্পটি একজন তরুণীর প্রতি একজন তরুণের বিমুগ্ধকারী যৌনাবেদনপূর্ণ ভালোবাসাকে সুচিত্রিত করেছে, যা বইটির অন্যান্য বিষয়বস্তু থেকে অধিক বাস্তবিকতা এবং অতিনাটকীয়তার পরিচয় দেয়।
১৯০৬ সালের মে মাসে জয়েস তাঁর প্রকাশকের কাছে প্রেরিত চিঠিতে লিখেছিলেন- ‘আমার উদ্দেশ্য ছিল- আমার দেশের নৈতিক ইতিহাসকেন্দ্রিক একটি অধ্যায় লেখার। ফলে দৃশ্যের চিত্রায়নের জন্য আমি ডাবলিনকে বেছে নিয়েছি, কারণ- শহরটিকে ঠিক যেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত কেন্দ্রবিন্দুর মতো দেখাত। আমি শহরটিকে চার রকমের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে নির্বিকার জনসাধারণের কাছে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি : শৈশবকাল, যৌবনকাল, পূর্ণবয়স এবং জনসাধারণের জীবন। গল্পগুলো এভাবেই সুন্দরভাবে তৈরি হয়েছে।’
১৯০৪ সাল- ২২ বছরের তরুণ ডাবলিনে গল্পগুচ্ছ লেখা শুরু করেছিলেন এবং ১৯০৭ সালে ত্রিয়েস্তেতে ‘দ্য ডেড’-এর মাধ্যমে তা পরিসমাপ্তি করেছিলেন। অনেক বাঁধাবিপত্তি পেরিয়ে ১৯১৪ সালের জুন মাসে ‘ডাবলিনার্সে’ প্রকাশিত হয়েছিল।
‘টু গ্যালান্টস’ এবং ‘ইভিলাইন’ এখানে চরিত্রগুলো বেশ অদ্ভুত। চরিত্রগুলোর পারিবারিক বন্ধন এবং কর্মব্যস্ততা থেকে মুক্তির স্বপ্নকে উদ্বিগ্নতা এবং জাগ্রত অবস্থার মাধ্যমে প্রস্ফুটিত করা হয়েছে।
‘আফটার দ্য রেস’- ডয়েলের বাবা জীবন শুরু করেছিলেন একজন স্বদেশভক্ত হিসেবে। পরবর্তীকালে তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়েছিল এবং প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। প্রায় বেশিরভাগ গল্পের চরিত্রগুলোই ছিল দৃশ্যমান, বিনিদ্র এবং অস্থির। তাদের উচ্চাকাক্সক্ষা তাদের উন্মাদ করে তুলেছিল। জয়েস সেগুলোকে বিচার করেননি। কিন্তু চূড়ান্তভাবে দুর্বলতা এবং ব্যর্থতার কবল থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য তাদের সতর্ক করেছেন।
‘অ্যা লিটল ক্লাউড’- গল্পটিতে চান্দলার বুঝতে পেরেছিলেন কেল্ট-জাতীয় ধারা তার কাব্য তৈরিতে সাহায্য করবে। যার ফলে ইংল্যান্ডে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে। (জয়েস তার কাব্যে কখনো এই ধারার ব্যবহার করেননি, যেহেতু থমাস কেটল তার প্রথম সংকলনে সমালোচনা করেছিলেন : ‘সমকালীন আয়ারল্যান্ডের প্রতিটি লেখকের কাজকে রঙিন করার মতো সেখানে উপকথার, লোকাচারের উপভাষার অথবা জাতীয় অনুভূতির কোনোরকম ছাপ প্রকট হয়নি।’)
ডাবলিনার্সে জাতীয়তাবাদ সমর্থনের দ্বারা গঠিত অসাড়তা ত্যাগ করে বাঁচার চেষ্টাকে ফলপ্রদ হিসেবে দেখা হয়নি। যেসব চরিত্র এটা চেষ্টা করেছে তাদের অতিরিক্ত রুচিহীনতার পাতায় নথিভুক্ত করা হয়েছিল। ডাবলিনার্সের চরিত্ররা নাগরিকতার ধর্ম পালনের পূর্বেই একজন ভোক্তার ধর্মকে বেছে নিয়েছিল।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে সর্বশেষ গল্পটি অর্থাৎ ‘দ্য ডেড’ ডাবলিন ছাড়াও পাশাপাশি বিভিন্ন শহরে অর্থাৎ ডাবলিনের মতো অন্যান্য রাজধানীগুলোকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল- যেখানে কোনো আইনসভা নেই, সরকার নেই, যেখানে প্রচলিত দুটি ভাষা এবং দুটি সংস্কৃতির মধ্যে অমিল বিদ্যমান, যেখানকার নাগরিকদের আত্মা পরিশুদ্ধ, যেই শহরগুলো নিস্তেজ এবং অসাম্প্রদায়িকতায় আবদ্ধ ছিল।
ডাবলিনের ‘দ্য ডেড’ বার্সেলোনা, কলকাতা এবং এডিনবার্গের সেইসব জায়গায় প্রবলভাবে সাড়া ফেলেছিল, যেখানে সংগীতের তীব্রতা বেশি। সেখানে শিল্পীদের হাতে এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল।
‘দ্য ডেড’ গল্পটিতে জয়েস রসিকতার মাধ্যমে পৃথিবীর একটি সুস্পষ্ট চিত্র আমাদের কাছে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সমগ্র গল্পসংকলনের মধ্যে গাব্রিয়েলের চরিত্রটি ছিল অধিকতর সরলতায় মোড়া। যেখানে তাকে শিক্ষিত এবং আত্মসচেতন হিসেবে প্রতিফলিত হয়েছে। সে ছিল দৃষ্টি এবং চিন্তাশক্তিশূন্য। উক্ত গল্পের মাধ্যমে তিনি সমাজের একটি সুচিত্রিত প্রতিচ্ছবির প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন।
জয়েসের শৈল্পিকচিন্তার মধ্যে একটি মৌলিক অনিশ্চয়তা নিহিত আছে, যা বিভিন্ন অর্থ বহন করে, যা তার গল্পগুলোর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়; কিন্তু রহস্য ব্যতীত তা কোনোভাবেই আধিপত্য স্থাপন করতে পারে না। একজন আধুনিক মানুষের অন্তর্নিহিত অনিশ্চয়তা তার মুখম-লেই ফুটে ওঠে।