
গ্রামের নাম দৌলতপুর, বিদ্রোহী কবির আগমনের কারণে সেই নামের আগে যোগ হয়েছে কবিতীর্থ। নজরুল দৌলতপুরে আসেন ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ৩ এপ্রিল মোতাবেক ১৩২৭ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে। বিদ্রোহী কবি দৌলতপুরে এসে হয়ে গেলেন প্রেমের কবি। এক নারী তার জীবনের গতিপথও বদলে দিয়েছিলেন। নজরুল লিখেছেন-
‘এক অচেনা পল্লী বালিকার কাছে
এত বিব্রত আর অসাবধান হয়ে পড়েছি,
যা কোন নারীর কাছে হয়নি।...’
এ বালিকাটি আর কেউ নন, তিনি মুরাদনগরের বাঙ্গরা ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের মুন্সী বাড়ির আবদুল খালেক মুন্সীর মেয়ে সৈয়দা খাতুন। আদর করে নজরুল তাকে ডাকতেন নার্গিস। নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যখন অংশ নিয়েছিলেন, তখন ক্যাপ্টেন আলী আকবর খাঁর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। নজরুলের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে আলী আকবর তাকে কুমিল্লায় নিজের গ্রামের বাড়িতে আসতে আমন্ত্রণ জানান। নজরুল কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম মেইলে করে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ৩ এপ্রিল রাতে আলী আকবর খাঁর সঙ্গে কুমিল্লায় আসেন। ট্রেনে বসে তিনি রচনা করেছিলেন ‘নীলপরী’ নামের একটি কবিতা। ওই রাতে নজরুল কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে তার সহপাঠী বন্ধু বীরেন্দ্র কুমার সেনের বাড়িতে ওঠেন। কান্দিরপাড়ে দু’দন বেড়ানোর পর ৬ এপ্রিল আলী আকবর খাঁ নজরুলকে নিয়ে দৌলতপুরে আসেন।
বর্তমানে যেখানে আলী আকবর মেমোরিয়াল ট্রাস্টের বিল্ডিংটি অবস্থিত। এটি তখন ছিল না। এখানে ৪৫ হাত দৈর্ঘ্য ও ১৫ হাত প্রস্থ আরেকটি ঘর ছিল। এ ঘরেই নজরুলকে থাকতে দেয়া হয়েছিল। এখানে থাকার সময়ই আলী আকবর খাঁর ভাগ্নি সৈয়দা নার্গিস আরা খানমের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয়। নার্গিসের বাড়ি ছিল আলী আকবর খাঁর পাশের বাড়িতেই। বাল্যকালে নার্গিসের মা-বাবা মারা গেছেন। তাই নার্গিস অধিকাংশ সময় মামার বাড়িতে থাকতেন। কবিতীর্থে প্রবেশের শুরুতেই চোখে পড়ল দুটি তোরণ, পথের দুই ধারে নির্মিত এ তোরণদ্বয়ের নাম রাখা হয়েছে কবি নজরুল তোরণ। তোরণ দুটোর সামনে বিখ্যাত কিছু কবিতার চরণ খোদাই করে রাখা।
‘নার্গিস! নার্গিস!
কেন ফুটলে আমার ফুল-বাগিচায়
আনলে মদির সুরভি
কেন গাইলে গজল শিরীন-সুর
কাঁদলো সাঁঝের পূরবি।’
এ তোরণ পেরিয়ে গ্রামের ভেতরে যে পাকা রাস্তাটা গেছে, সেটা দিয়ে একটু সামনে এগিয়ে চোখে পড়ল একটা মাঠ, নজরুল মাঠ। আসলে এ গ্রামে যা কিছু চোখে পড়ে, সবই নজরুলের নামে নামকরণ করা। মাঠের এক পাশে পাকা করে নজরুল মঞ্চ বানানো। প্রতি বছর ১১ জ্যৈষ্ঠ এ মাঠেই মেলা হয়। মাঠের দক্ষিণ দিকে আলী আকবর খানের সেই বাড়িটি, যেখানে নজরুল-নার্গিসের বিয়ে ও বাসর রাত উদযাপন হয়েছিল, সেটা ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুন মোতাবেক ১৩২৮ বঙ্গাব্দের ৩ আষাঢ় শুক্রবার। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে বিয়ের দিন রাতেই কবি দৌলতপুর ত্যাগ করে কুমিল্লার কান্দিরপাড় চলে যান। কেন তিনি ওভাবে চলে গিয়েছিলেন, আজও তা জানা যায়নি। তবে কুমিল্লা থেকে তিনি নার্গিসের মামা আলী আকবর খাঁকে ‘বাবা শ্বশুর’ সম্বোধন করে যে চিঠি লিখেছিলেন, তাতে কিছুটা অনুমান করা যায়। তিনি লিখেছেন,
‘‘বাবা শ্বশুর! আপনাদের এই অসুর জামাই পশুর মতন ব্যবহার ক’রে এ’সে যা কিছু কসুুর করেছে, তা মাফ করো সকলে...। ...আমি সাধ ক’রে পথের ভিখারী সেজেছি ব’লে লোকের পদাঘাত সইবার মতন ‘ক্ষুদ্র-আত্মা’ অমানুষ হয়ে যাই নি। আপনজনের কাছ থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত এত হীন ঘৃণা, অবহেলা আমার বুক ভেঙ্গে দিয়েছে...।”
দৌলতপুরে নার্গিসের বসতবাড়িটি এখন আর নেই। নার্গিস মারা গেছেন ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর দুই পুত্র এখন বিদেশে থাকেন। নজরুল চলে যাওয়ার পর নার্গিস সুদীর্ঘ ১৬ বছর প্রিয় কবির জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। নার্গিসের বর্তমান বাড়িতে এসে তাঁরই ভাইয়ের ছেলে আব্দুর রউফ মুন্সির কাছ থেকে জানতে পারলাম এসব কথা।
আলী আকবর খাঁর সেই বাড়িটি এখনও আছে। রাজপ্রাসাদের মতো কারুকার্যময় দ্বিতল ভবন। বাড়িটির সামনে পুকুর, আম গাছ। এই আমতলায় বসেই নজরুল প্রতিদিন রাতদুপুরে মন ভোলানো উদাস সুরে বাঁশি বাজাতেন। দুপুরে শীতল পাটিতে বসে কবিতা ও গান রচনা করতেন। এই আমগাছের পাশেই ছিল কামরাঙ্গা, কামিনী, কাঁঠাল গাছের সারি।
এখানে তিনি খাঁ বাড়ির ও গ্রামের ছেলেমেয়েদের নাচ, গান, বাদ্য শেখাতেন। যদিও গাছটি এখন আর নেই। কয়েক বছর আগে মারা গেছে। গাছের গোড়াটি পাকা করে রাখা হয়েছে। আম গাছের সামনে রয়েছে একটি শান বাঁধানো ঘাট। এ আমগাছের পার্শ্ববর্তী পুকুরেই নজরুল ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার কাটতেন। একবার পুকুরে নামলে ওঠার নামও নিতেন না। সাবানের পর সাবান মেখে পুকুরের পানি সাদা করে ছোট শিশুদের নিয়ে লাই খেলতেন, ডুব দিয়ে তাদের কলের গান শোনাতেন।
আলী আকবর খাঁর এক বোন ছিল, নাম ইফতেখারুন্নেছা। নজরুল তাকে মা ডাকতেন। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে একটি আম গাছ ছিল। সেটি এখন নেই। ইফতেখারুন্নেছা এ আম গাছের তলায় খাবার নিয়ে এসে নজরুলকে ডাকতেন ‘আয় নুরু, খেতে আয়!’ তখন নজরুল ভদ্র ছেলের মতো গোসল সেরে বাড়িতে এসে ভাত খেতেন। তখন খাঁ বাড়িতে ১২টি কামরাঙ্গা গাছ ছিল, এখন আছে দুটি। কবির শয়নকক্ষসংলগ্ন ছিল একটি প্রাচীন কামরাঙ্গা গাছ, যা তার অনেক কবিতা গানে, হাসি-কান্না, মান-অভিমান ও মিলন-বিরহের নীরব সাক্ষী। এ গাছকে নিয়েই তিনি লিখেছেন-
‘কামরাঙ্গা রঙ্গ লোকের পীড়ন থাকে
ঐ সুখের স্মরণ চিবুক তোমার বুকের
তোমার মান জামরুলের রস ফেটে পড়ে
হায় কে দেবে দাম...।’
নজরুল মাঝেমধ্যে, বিশেষ করে দুপুরে এ গাছের শীতল ছায়ায় বসে আপনমনে গান গাইতেন, গান রচনা করতেন। সেই গাছটি এখনও আছে। নজরুল স্মৃতি ধরে রাখতে গাছটিতে ফলক রয়েছে। নজরুল ও আলী আকবর খাঁ যখন বিকালবেলায় একসঙ্গে এ গাছের ছায়ায় শীতলপাটি বিছিয়ে বসে কবিতা ও গান রচনা করতেন, নার্গিস তখন নানা কাজের ছলে ছুটে আসতেন এখানে। তখনই নজরুল-নার্র্গিসের মন দেয়া-নেয়া ঘটে যায়। দৌলতপুরে নজরুল ৭৩ দিন ছিলেন। সে সময় তিনি ১৬০টি গান ও ১২০টি কবিতা লিখেছিলেন। ‘পাপড়ি-খোলা’ কবিতাটি এখানে বসেই তিনি রচনা করেছিলেন। এছাড়া তিনি রচনা করেন ‘অ-বেলায়’, ‘অনাদৃতা’, ‘বিদায়-বেলায়’, ‘হারমানা-হার’, ‘হারামণি’, ‘বেদনা অভিমান’, ‘বিধুরা পথিক প্রিয়া’ ইত্যাদি কবিতা।
রাতে বাজাতেন বাঁশি আর দিনের বেলা পুকুরের শান্ত জলে নেমে খেলতেন জলকেলি। গ্রামের বউ-ঝিয়েরা কলসি ভরতে পুকুরে এলে তিনি তাদের সঙ্গে ছেলেমানুষি করতেন। এজন্য নজরুল ঘুম থেকে ওঠার আগেই কলসি ভরে নিত গ্রামের মেয়েরা। কবিতীর্থের একজন প্রবীণ লোক এ কথাগুলো জানালেন আমাকে। পুকুর, আম গাছ, বাসরঘর ও বাসর রাতের খাট দেখে গেলাম ‘নার্গিস-নজরুল বিদ্যানিকেতন’-এ, যা নজরুল নিকেতন কর্তৃক ২ জুলাই ২০০২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠার ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও এমপিওভুক্ত করা হয়নি। কবিতীর্থের বিত্তবানদের আর্থিক সহায়তায় চলছে ১৭৫ জন ছাত্রী অধ্যয়নরত বিদ্যানিকেতনটি।