
আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় অসামান্য অবদানকারী সার্বীয়-আমেরিকান বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলা তাঁর জীবনের সিংহভাগ সময়ই বিজ্ঞানের কল্যাণে ব্যয় করেছেন। উদ্ভাবক, তড়িৎ প্রকৌশলী, যন্ত্র প্রকৌশলী এবং ভবিষ্যবাদী, যিনি আধুনিক পরিবর্তী তড়িৎ প্রবাহ ও তারবিহীন তড়িৎ পরিবহন ব্যবস্থা আবিষ্কারের জন্য সমধিক পরিচিত। টেসলা ১৮৫৬ সালের ১০ জুলাই স্মিলিয়ান (এখনকার ক্রোয়েশিয়া) নামের গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
টেসলার পিতা মিলুতিন টেসলা গির্জার ধর্মযাজক থাকলেও অসামান্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন; তিনি ঘরের জিনিসপত্র ও যন্ত্রপাতি বানাতে জানতেন আর স্মৃতিশক্তি ভালো থাকার কারণে তিনি সার্বীয় মহাকাব্য মুখস্ত বলতে পারতেন। মা ডুকা টেসলা বিদ্যায়তনিক শিক্ষায় কোনো শিক্ষা পাননি; কিন্তু টেসলার মতে- ‘তাঁর মা ছিলেন অসামান্য গুণী নারী, যাঁর প্রখর স্মৃতিশক্তির সবটাই তিনি পেয়েছেন।’
টেসলার পিতৃগোষ্ঠীর লোকেরা এক সময় পশ্চিম সাইবেরিয়ার মন্তিনিগ্র এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে টেসলা ছিলেন চতুর্থ। যখন টেসলা ৫ বছরের, তখন তাঁর ভাইটি এক ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় মারা যায়। ১৮৬১ সালে সিমিলজানের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সেখানে টেসলা জার্মান, গণিত আর ধর্ম শেখেন। ১৮৭০ সালে তিনি উত্তরের কারলোভাকে উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরে তিনি একজন পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকের মাধ্যমে তড়িৎ প্রদর্শনীতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
টেসলা বলেন, ‘এসব রহস্যময় ঘটনাগুলোর প্রদর্শনীই তাকে বিদ্যুতের মতো এই অসাধারণ শক্তি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী করে তোলে।’ সে সময়ে তিনি মনে মনে ক্যালকুলাসের যেসব সমাধান করতে পারতেন, তা দেখে তার শিক্ষকদের মনে সন্দেহ আর বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল। ১৮৭৩ সালে তিনি তাঁর ৪ বছরের শিক্ষা কোর্সটি মাত্র ৩ বছরে শেষ করেন।
এরপরে তিনি যোগ দিয়েছিলেন অস্ট্রীয়-হাঙ্গেরির সেনাবাহিনীতে। এ সময়ে তিনি পর্বতে যেতে ভালোবাসতেন। তাঁর মতে, ‘প্রকৃতি তাঁকে মানসিক এবং শারীরিকভাবে শক্তিশালী করেছে।’ তিনি প্রচুর বই পড়তে ভালোবাসতেন। ১৮৭৫ সালে টেসলা সেনাবাহিনীর একটি বৃত্তি পেয়ে যান অস্ট্রিয়ার গারাজে। এই বৃত্তি পাওয়ার পর তিনি কঠোর পরিশ্রম শুরু করেন, প্রথম বছরে তিনি একটি ক্লাসও বাদ দেননি এবং ৯টি পরীক্ষায় তিনি সর্বোচ্চ নম্বার পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এ সময়ে তিনি সাইবেরিয়ান একটি সংস্কৃতি বিজ্ঞান ক্লাবের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। মেধাবী শিক্ষার্থী পরবর্তীকালের বিখ্যাত আবিষ্কারক টেসলার পিতার কাছে এই সময়ে তাঁর বিজ্ঞান বিভাগের প্রধানের লেখা একটি চিরকুট পৌঁছে, যেখানে তিনি জানান- ‘আপনার পুত্র মেধা তালিকায় প্রথম।’
টেসলা তাঁর শিক্ষা গ্রহণকালে একটুও অবহেলা করতেন না বরং তিনি অতিরিক্ত পরিশ্রম করতেন শিক্ষাকালীন যে জন্য তাঁর পিতার মৃত্যুর পরে তাঁরই অধ্যাপকের হাতে পিতার পাঠানো একটি চিরকুটে দেখেন তাঁর পিতা লিখেছেন- ‘অতিরিক্ত পরিশ্রম করলে টেসলা মারা যেতে পারে। যদি টেসলা অতিরিক্ত পরিশ্রম করে, তবে তাঁকে যেন বিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হয়।’
কিন্তু পিতার কাছ থেকেই টেসলা পরিশ্রম করতে শিখেছে, এক কথায় পিতাই দিয়েছেন তাঁকে সবচেয়ে বেশি প্রেরণা। এই সময়ে তিনি বৃত্তি হারান- এর প্রধান কারণ ছিল তিনি আসক্ত হয়ে পড়েন জুয়ায়। বিলিয়ার্ড খেলায় পরবর্তীতে অবশ্য তিনি পুরো আমেরিকায় সুনাম অর্জন করেন।
বিশ^বিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে তাঁর আর কোনো নম্বার যুক্ত হয়নি। কারণ তাঁর যখন পরীক্ষা শুরু হয় তখন পরীক্ষার প্রস্তুতি ছিল না। ফলে তিনি পড়ালেখা সমাপ্ত না করেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন- কিন্তু এ বিষয় তিনি পরিবারে গোপন রাখেন।
পরে তিনি কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন একটি নতুন প্রতিষ্ঠানে, যেখানে তিনি ছিলেন প্রধান ইলেকট্রিশিয়ান। দিনের পর দিন তিনি কঠোর পরিশ্রম করতে থাকেন। ১৮৮২ সালে তিনি যুক্ত হন এডিসনের কোম্পানির সঙ্গে, এই সময়েই এডিসনের কোম্পানির প্রভূত উন্নতি সাধন করেন অপর্যাপ্ত মটর ও জেনারেটর ডিজাইন করে; কিন্তু এডিসনের থেকে পরে টেসলা চলে যান বনিবনা না হওয়ায়। এরপর নিজ প্রতিষ্ঠান শুরু করেন এবং সেখানে তিনি কারখানা ও পরীক্ষাগারে কঠোর পরিশ্রম করে একের পর এক আবিষ্কার করতে থাকেন নব নব জিনিস; কিন্তু সেসব তিনি পেটেন্ট করতে পারেননি সব তাঁর নিজের নামে। বরং চালাক লোকেরাই সব নিজের করে নিয়েছেন কৌশলে।
জীবনের শেষ দিকে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, নিউইয়র্ক শহরে হোটেলে থাকতেন- সেই হোটেলের বিলও পরিশোধ করার অবস্থা ছিল না তাঁর। এই সময়ে এফবিআই-এর প্রধান হোটেলে হানা দিয়ে প্রচুর গবেষণাপত্র ও গবেষণা প্রকল্প হাতিয়ে নেয়। যা আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। সন্দেহ করা হয়- আমেরিকার মানব ধ্বংসাত্মক অধিকাংশ আবিষ্কারই টেসলার সেই হোটেল কক্ষ থেকে চুরি করে আনা। মানুষের জীবনের জন্য টেসলা বহু আবিষ্কার করেছেন- কিন্তু তা তাঁর নিজের কল্যাণে লাগেনি। বরং অনাহারে অর্ধাহারে দিন অতিবাহিত করেছেন।
টেসলার আবিষ্কার আমরা রোজ ব্যবহার করি কিন্তু জানি না- কে এসবের আবিষ্কারক। বৈদ্যুতিক জেনারেটর (মূলনীতি মাইকেল ফ্যারাডের হলেও ব্যবহারিক আবিষ্কার টেসলার), রেডিও, রিমোট কন্ট্রোল, স্পার্ক প্লাগ, রোবট, ফ্লুরোসেন্ট বাতি (যা পরে ‘এডিসন’ নিয়ে নেন তার নিজের নামে), টেসলা কয়েল (টিভি, রেডিও দুটিরই অপরিহার্য অংশ) এবং আরও অনেক কিছু যা এই বিংশ শতাব্দীতে আপনার জীবনকে পুরোই বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে।
টেসলা অর্থলিপ্সু ছিলেন না, মানুষের কল্যাণে কাজ করতে চেয়েছিলেন- ধূর্ত-অর্থলিপ্সু বিজ্ঞানের কালো লোকেরা তা হতে দিতে চাননি। ফলে টেসলার মতো মানবতার কল্যাণের বিজ্ঞানপাগল সাধককে আমরা হারিয়ে ফেলি অকালে। ১৯৪৩ সালের জানুয়ারিতে তিনি নিউইয়র্ক শহরে মারা যান। মৃত্যুর পরও টেসলার অনেক গবেষণা ১৯৬০ সালের আগ পর্যন্ত রহস্যময় থেকে যায়। ১৯৬০ সালে জেনারেল কনফারেন্স অন ওয়েট অ্যান্ড মেজারস টেসলার সম্মানে চৌম্বকীয় প্রবাহের ঘনত্বের এসআই ইউনিটটির নামকরণ ‘টেসলা’ করে। ১৯৯০-এর দশক থেকে টেসলার জনপ্রিয়তা পুনরায় বাড়তে থাকে।