‘আমি এই শহরেরই একজন কবি’

মুহাম্মাদ শাখাওয়াত হুসাইন ওয়াদুদ
প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২০, ১৪:২২

বাংলা কবিতার অঙ্গনে যাকে বিশেষভাবে চেনা হয় নাগরিক কবি বলে, তিনি শামসুর রাহমান। বাংলা কবিতায় নাগরিক এবং নগরকেন্দ্রিক যান্ত্রিক সভ্যতার অভিঘাত, নাগরিক নৈরাশ্য, বিষাদ আর বিবমিষা জনপ্রিয় বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে তিরিশের দশকে। ইয়োরোপীয় আধুনিক কবিতার নাগরিক অভিজ্ঞতার অনুসরণের ফলে বাংলা কবিতার নাগরিক রূপায়ণেও এর প্রভাব পড়ে। টিএস এলিয়টের লন্ডন যেমন মৃত আত্মাদের নগরী, বোদলেয়ারের প্যারিস যেমন স্পন্দনহীন ইটকাঠের শহর, ঠিক একইভাবে বাংলা কবিতায়ও নাগরিক অনুসঙ্গ এসেছে কেবল বিষাদ আর বিবমিষার আর্তনাদ হিসেবে। কিন্তু প্রথম শামসুর রাহমানই তাঁর প্রিয় ঢাকা শহরের প্রতিদিনের জীবনকে দেখছেন একটি রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে।
কতিপয় চিমনি, টালি, ছাদ, যন্ত্রপাতি, ফ্যাক্টরির
ধোঁয়ার আড়ালে ওড়া পায়রার ঝাঁক
এবং একটি মুখ ভেসে ওঠে আলোময় মেঘের মতোই।
শামসুর রাহমানের প্রথম জীবনের নাগরিক কবিতা যে বিষাদগ্রস্ত নাগরিকতা থেকে পুরোপুরি মুক্ত ছিলো, তা নয়। বরং প্রথম দিকের কবিতায় তিনিও নাগরিক যুগযন্ত্রণা আর বিষাদকে ধারণ করেছেন। যদিও তা থেকে সরে আসতে তিনি খুব বেশি সময় নেননি।
এ শহর শাদা হাসপাতালের ওয়ার্ডে কেবলি এপাশ ওপাশ করে
এ শহর সিফিলিসে ভোগে।
শামসুর রাহমানের নগর ঢাকা, এলিয়টের দ্য ওয়েস্টল্যান্ডের মতো নিষ্প্রাণ নয়। তিরিশি বা চল্লিশি কোলকাতার মতো কসমোপলিটন শহর নয়। বস্তুত শামসুর রাহমানের শৈশব-কৈশোরে দেখা ঢাকা শহর এক উঠতি মফস্বল ছাড়া কিছুই নয়। প্রিয়তমার মতো যেন তার স্বর- কণ্ঠস্বর। এখানেই শামসুর রাহমান তাঁর নাগরিক চেতনা নিয়ে স্বতন্ত্র।
আমার অসুখ বলে ঢাকা মন খারাপ করে আছে।
ওর চোখে-মুখে বিষণ্ণতা জেগে থাকে সারাক্ষণ,
যত বলি ফুল্ল স্বরে, ভেবো না লক্ষ্মীটি, আমি খুব
তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবো, দেখে নিও।
প্রিয়তমা নয়তো কী! জীবনানন্দ দাশ বা সমর সেন, আহসান হাবীব কিংবা শহীদ কাদরীর কবিতায় নগরকে এমন ভূমিকায় পাওয়া যাবে না। নিজের শহরকে ভালোবেসে তার কাছে নতজানু হওয়ার প্রেমিকসুলভ মনোভাবও শামসুর রাহমান ছাড়া আর কোনো কবির নাগরিক যাপনে খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য।
তোমার কাছে গোলাপ প্রার্থনা করে আমি নতজানু,
তুমি কেন ক্যাকটাস ছুড়ে দাও?
এই বক্তব্য কিছুতেই এটা প্রমাণ করে না যে, শামসুর রাহমান নাগরিক যুগযন্ত্রণাকে রোমান্টিক কল্পনাপ্রবণতা দিয়ে আড়াল করে রেখেছেন, এবং নাগরিক জীবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষাদকে তিনি আমল দেননি। আগেই বলা হয়েছে, শামসুর রাহমানের শৈশব-কৈশোরে দেখা ঢাকা মফস্বল শহর ছাড়া কিছুই নয়। তাঁর যৌবনের ঢাকা যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং সেই পরিস্থিতির বহিঃপ্রকাশ রাজনৈতিক স্বরে : ‘শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাংক এলো’। কবির দেখা ঢাকার প্রাক-যুদ্ধ গুমোট এবং যুদ্ধপরবর্তী বিধ্বস্ত চেহারা তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতায় পাওয়া যাবে। তবে নগরকে রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার ভূমিকাই বাংলা কবিতায় শামসুর রাহমানের নতুন সংযোজন।
কান্দুপট্টির খানকি
মাগির চক্ষুর কাজলের টান এই মাতোয়ালা
রাইতের তামাম গতরে।