অমর একুশে গ্রন্থমেলা
বইমেলা নিয়ে দোলাচলে সংশ্লিষ্টরা

বিশেষ প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২০, ১১:২৪

অমর একুশে বইমেলা। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে বাংলা একাডেমী প্রাঙনে বসে এই মেলা। উদযাপিত হয় সারা মাস ব্যাপী। লেখক-প্রকাশক-প্রচ্ছদ শিল্পী আর সাধারণ পাঠকদের এক মিলন মেলায় পরিণত হয় এটি।
যদিও একদিনে গড়ে ওঠেনি এই ‘অমর একুশে বইমেলা’। এর পেছনের ইতিহাস বিস্তর। ১৯৭২ সালে চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়–সংলগ্ন বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউস প্রাঙণের বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে গোড়াপত্তন করেন এই বইমেলার। বলা ভালো, এই ৩২টি বই–ই ছিল চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ—বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী—থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের শরণার্থী লেখকদের লেখা। অনেকের মতে, এই বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্পেরও প্রথম দিককার প্রকাশনা। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত একাই বইমেলা চালিয়ে যান চিত্তরঞ্জন সাহা।
পরে ১৯৭৭ তার এই আয়োজনে অণুপ্রাণিত হলেন অন্যরা। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক লোকসংস্কৃতিবিদ আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। আর ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি।
তারও পরে ১৯৮৩ সালে মনজুরে মওলা যখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, সে সময়েই তিনি একাডেমিতে প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজন সম্পন্ন করেন। তবে এরশাদ সরকার ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দেওয়ায় ওই বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি। এর পরের বছর ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি প্রাঙণে সাড়ম্বরে উদ্বোধন ঘটে ‘অমর একুশে বইমেলা’র। সেই থেকে শুরু, ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই এই লেখক-পাঠক-কলাকুশলীদের মিলনমেলা উদযাপিত হচ্ছে একই নিয়মে। একই ধারাবাহিকতায়।
তবে বিপত্তিটা বেধেছে সামনের আগমনী বইমেলাকে কেন্দ্র করে। বৈশ্বিক মহামারী করোনার প্রভাবে সবকিছুই স্থবির। বইমেলাও রেহাই পায়নি এর থেকে। এ বছর আদৌ মেলা উদযিাপিত হচ্ছে কিনা? অথবা হলেও মেলার পরবর্তী প্রভাব করোনার প্রকপ কতটুকু হয় তা নিয়ে শুরু হয়েছে সংশয়। যদিও বাংলা একাডেমী বলছে, স্বাস্থ্য বিধি মেনেই এবারের মেলার আয়োজন করা হবে।
এ বিষয়ে বাংলা একাডেমী সূত্র জানায়, এবারের মেলায় একসঙ্গে সকল দর্শনার্থী বা গ্রন্থানুরাগীদের প্রবেশের সুযোগ থাকছে না। ধাপে ধাপে প্রবেশ করতে হবে গ্রন্থমেলায়। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে মেলার চেহারা হবে একরকম এবং অবনতি হলে সেটা হবে আরেক রকম। এমনকি আগামী ফেব্রুয়ারিতে করোনা সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে গেলে থাকছে মেলা আয়োজনের অনিশ্চয়তা। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বাতিল বা স্থগিত হবে গ্রন্থমেলা।
এ বিষয়ে বাংলা একাডেমি মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী এক গণমাধ্যমকে বলেন, করোনার কারণে কলকাতা বইমেলা বা ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা পিছিয়ে গেলেও আমরা নির্দিষ্ট সময়েই মেলার আয়োজন করতে চাই। এ লক্ষ্যে আমরা যারা মাঠে কাজ করি তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ আলোচনা হয়েছে। লেখক ও প্রকাশকদের সঙ্গেও বৈঠক হয়েছে। করোনার ঝুঁকি এড়িয়ে মেলা আয়োজনে তাদের সুচিন্তিত পরামর্শ গ্রহণ করেছি। মেলার মাধ্যমে যেন কারো কোন ক্ষতি যেন না হয় সেই বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনেই আমরা মেলার আয়োজন করতে চাই। সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে অক্টোবর মাসেই মেলা আয়োজনের আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে, গ্রন্থমেলার পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ও বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. জালাল আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী-এই দুই উপলক্ষকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিতব্য এবারের মেলা বিশেষ গুরুত্ববহ। ২০২১ সালের গ্রন্থমেলার থিম হবে মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। মেলার কাঠামোগত বিন্যাস ও নক্সায় এ বিষয়গুলো ধারণ করা হবে। মহামারীর সকল প্রতিবন্ধকতাকে বিবেচনায় নিয়ে আমরা একটি সুন্দর ও প্রাণবন্ত মেলার আয়োজন করতে চাই। এজন্য লেখক, প্রকাশক সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ নিয়ে মেলার আগে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে শুরু হবে। তবে মেলার পূর্ব মুহূর্তে মহামারীর প্রকোপ বাড়লে বাতিল বা স্থগিত হবে বইমেলা। সেক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি কোন দায় নেবে না। সরকারি স্বাস্থ্যনীতির আলোকেই এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।
এ সকল বিষয়ে পাঠকের সংশয় ক্ষানিকটা কমলেও, বেড়ে যাচ্ছে লেখক-প্রকাশক এবং অন্যান্য কলাকুশলীদের সংশয়।
২০২০ সালের মেলায় সাড়ে পাঁচশ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশ নিলেও এবার সেই সংখ্যা কমবে। এছাড়া নতুন প্রকাশনা সংস্থার মেলায় অংশগ্রহণ নিয়ে এখনো কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। এছাড়া মেলা অনুষ্ঠিত না হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তো রয়েই গেছে।
প্রতি বছরের এই সময়ে বইয়ের কাজ করে ফুরসৎ পাওয়া দায় হয়ে যায় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। বেশ দোলাচলে রয়েছেন তারা। ছোট ছোট প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের অনেকেই এখনো বইয়ের কাজে হাত দেননি এখনো। লেখা পাওয়ার অভাবের সাথে সাথে যুক্ত হয়েছে অর্থের অভাবও।
এ বিষয়ে সাম্প্রতিক দেশকালের কথা হয়েছিলো পূর্বা প্রকাশনীর প্রকাশক বাদল সাহা শোভনের সাথে। বাদল সাহা শোভন বলেন, এবার করোনার কারণে লেখকরা লেখালেখির বিষয়ে যথেষ্ট সময় পেলেও, সার্বিক পরিস্থিতিতে প্রকাশকরা অর্থনৈতিক ভাবে বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তাই বই প্রকাশের ক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়োগ ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
এছাড়া আশঙ্কার কথা চিন্তা করে এবারের বইমেলায় বেশ কিছু প্রকাশনী অংশ নেয়ার শঙ্কাও সিৃষ্টি হয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রকাশকদের মতো প্রচ্ছদ শিল্পীদের অবস্থাও অভিন্ন নয়। সাম্প্রতিক দেশকালের কথা হয়েছিলো প্রচ্ছদ শিল্পী চারু পিন্টুর সাথে।
তার ভাষ্যমতে, সাধারণত প্রতিবছর সারামাসেই প্রচ্ছদ আঁকায় ব্যস্ত থাকতে হয়। কিন্তু এই সমকালীন জটিলতায়তো প্রায় ৬ মাস স্থবির অবস্থায় ছিলো। বাংলা একাডেমি প্রাথমিক ঘোষণা দেবার পরেই আসলে মানুষের আগ্রহ ধীরে ধীরে বাড়ছে। অনেকে হয়তো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য সময় নিচ্ছেন। আবার অনেক প্রকাশকও টেনশনে বইয়ের সংখ্যাও হয়তো কমাবে বলে ধারণা করছি। প্রচ্ছদের কাজগুলোও ধীরে ধীরে শুরু হয়েছে। তবে, বাকিটা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষনের বিষয়। তবে, নভেম্বর- জানুয়ারিতে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হবে বলে আশা ব্যক্ত করেন এই প্রচ্ছদ শিল্পী।
নানা দোলাচলের মধ্য দিয়ে অপেক্ষা করছে মেলা সংশ্লিষ্টরা। তবে, সকল বাধা পেরিয়ে সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে সম্পন্ন হবে এই প্রত্যাশা প্রত্যেকের।