Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

ভূমিকম্প, ফুজিসান এবং নামাজু সংস্কৃতি

Icon

প্রবীর বিকাশ সরকার

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২০, ২০:৩৭

ভূমিকম্প, ফুজিসান এবং নামাজু সংস্কৃতি

জাপানে একটি প্রবচন আছে, ‘জিশিন, কামিনারি, কাজি, ওইয়াজি’ অর্থাৎ ‘ভূমিকম্প, বজ্রপাত, অগ্নিকাণ্ড, পিতৃদেব’। এই চারটি ভয়ঙ্কর জিনিস বলে জাপানিরা আজও মেনে থাকেন। এতেই বোঝা যায় আরো কত ভয়ঙ্কর ব্যাপার থাকতে কেন এই চারটি এত গুরুত্বপূর্ণ এবং ভূমিকম্প প্রথম স্থান অধিকার করে আছে। ভূমিকম্প উপরের জিনিস নিচে, নিচের জিনিস উপরে তুলে সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়, বজ্রপাতের বিকট শব্দে নির্ঘাৎ মৃত্যু, অগ্নিকাণ্ড সব পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে যায় কিছুই রাখে না আর পিতৃদেবের কঠোর শাসনে ফাঁকি দেবার উপায় নেই, পিতার আদেশ শিরোধার্য।

জাপান ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ-অহরহ ভূকম্পন এদেশে স্বাভাবিক ঘটনা। প্রচুর আগ্নেয়গিরি থাকার কারণে অগ্নুৎপাতও বেশি হয়ে থাকে। পৃথিবীর ১০ ভাগ ভূমিকম্প এই দেশে সংঘটিত হয়। প্রতিবছর কমপক্ষে একবার হলেও রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প একটা হবেই। কাজেই জাপানিরা যেমন এই ভূমিকম্প সম্পর্কে সর্বদা সচেতন, সজাগ তেমনি প্রস্তুতও। স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের মধ্যে ১৯২৩ সালের কানতোও দাইজিশিন, ১৯৯৫ সালের হানশিন আওয়াজি দাইজিশিন এবং ২০১১ সালের তোওহোকু দাইজিশিন-মহাভূমিকম্পসমূহ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বিপুল এবং অপূরণীয়।

পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রায়শ বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে। যেমন ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, চীন, ফিলিপিন্স, তুরস্ক, ইরান, আমেরিকা, ইতালি, চিলি, হাইতি, নিউজিল্যান্ড, জার্মানি, পাকিস্তান, ভারত প্রভৃতি। সাধারণত যেসব দেশে জীবন্ত আগ্নেয়গিরি রয়েছে সমতল ও সমুদ্রের তলদেশে সেখানে ভূমিকম্প বেশি হয়ে থাকে। জাপানে রয়েছে শতাধিক জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। যেমন বহুশ্রুত জাপানের প্রতীক ফুজিপর্বত একটি বড় ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি। বিগত সাত লক্ষ বছর ধরে সে বহুবার জেগে ওঠে ভূমিকম্প সংঘটন করে জাতিকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। ১৭০৭-০৮ সালে আপাত শেষবার সে অগ্নুৎপাত ঘটিয়েছে। গত ৩০০-৪০০ বছর ধরে তৎপরহীন তবে বলা যায় না কখন সে জেগে ওঠে। যে কারণে প্রাচীনকাল থেকেই জাপানিরা ফুজি ইয়ামাকে দেবতাজ্ঞানে ভক্তি করে আসছে। জাপানে তিনটি প্রধান পর্বত রয়েছে যারা পবিত্র পর্বত বলে পরিচিত যথাক্রমে ফুজি ইয়ামা, তাতে ইয়ামা এবং হাকু ইয়ামা। ফুজি শব্দের নানা অর্থ বিদ্যমান যেমন ঐশ্বর্য, অশেষ, শাশ্বত মৃত্যু, অদ্বিতীয় ইত্যাদি। এগুলোর কোন্টি সঠিক বলা মুশকিল কিন্তু এতে করে তার তাৎপর্যটা অনুধাবন করা যায়।

জাপানের জনজীবন তথা ইতিহাস, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ধর্ম, শিল্পকলা, নাটক, চলচ্চিত্র, কার্টুন, অ্যানিমেশন, প্রকাশনা, আলোকচিত্র এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে ‘ফুজি’র প্রসঙ্গ নেই। ফুজি পর্বতের অর্ধেক পর্যন্ত যাকে বলে ‘ফুজি গোকো’ পর্যটনের ব্যবস্থা রয়েছে। পাদদেশে গড়ে তোলা হয়েছে চমৎকার একটি জাতীয় উদ্যান এবং নয়নাভিরাম নীল হ্রদ। তাই বিদেশি পর্যটকের অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান হচ্ছে ফুজি ইয়ামা বা ফুজিসান। এটা জাপানিদের কাছে তীর্থস্থান। কারণ জাপানের ভূমিজাত নিজস্ব ধর্ম শিন্তোও এবং বহিরাগত বৌদ্ধ ধর্মীয় মন্দিরও সেখানে প্রতিষ্ঠিত। ৩৭৭৬ মিটার উঁচু রাজধানী টোকিও থেকে মাত্র ১০০ কিমি বা ৬১ মাইল দূরে অবস্থিত ফুজি ইয়ামা বছরের অধিকাংশ সময়ই মেঘে ও বরফে ঢাকা থাকে। রৌদ্রালেকিত তার মুখ বা চূড়াটি দেখার জন্য বহু মানুষ একাধিকবার আসাযাওয়া সত্ত্বেও দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেন খুবই কম। পেশাদার ফটোগ্রাফাররা বসেই থাকেন তার একটি হাস্যেজ্জ্বল ছবি তোলার জন্য তীর্থের কাকের মতো। সদয় হলে ফুজিসান মাঝেমধ্যে দেখা দেয়। তবে গ্রীষ্মকালে আকাশ কিছুটা পরিষ্কার থাকে বিধায় দর্শন দেয় বলে জাপানিরা বলেন। জাপানে চারটি ঋতুর আলোজলবায়ুর প্রভাবে ফুজিসান বিচিত্র রঙে উদ্ভাসিত হয়ে দেখা দেয়।


ফুজি পর্বত জাপানি সাহিত্য বা সঙ্গীতের চেয়ে সবচেয়ে বেশি আলোকিত হয়ে আছে এদেশের সুঐতিহ্যবাহী চিত্রকলা ‘উকিয়োএ’ বা ‘কাঠখোদাই ছাপচিত্রে’ যার তুলনা মেলা ভার! পবিত্র ফুজি পর্বতকে যেভাবে উৎকর্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই চিত্রকলা মাধ্যমে, এমনটি বিশ্বের আর কোনো পর্বত চিত্রিত হয়েছে বলে জানা নেই। যেমন জাপানের অন্যতম প্রধান উকিয়োএ-শিল্পী কাৎসুশিকা হোকুসাই অঙ্কিত ফুজি পর্বতের চিত্রটি অসাধারণ এবং জগৎখ্যাত। অন্যান্য উকিয়োএ-শিল্পীরাও ফুজি পর্বতকে নিয়ে একাধিক অনন্য সব ছবি এঁকে গেছেন, যা জাপানের অমূল্য সাংস্কৃতিক সম্পদ বলে বিবেচিত। ১৯৩৮ সালে ফুজি পর্বতের অঙ্কিত ছবি দিয়ে ডাক টিকিট প্রকাশ করেছে সরকার। পাঁচ হাজার টাকার কাগুজে নোটেও ফুজি মডেল হয়েছে। ফুজিকে কেন্দ্র করে একটি সংস্কৃতিই গড়ে উঠেছে অতীতকাল থেকে। ফুজি পর্বতকে নিয়ে বহু কথা বলা যায়, এখানে তার প্রসঙ্গটি আনার কারণ এই যে, এই পবিত্র পর্বতটি আধুনিক জাপানের জীবনদাতার ভূমিকায় রয়েছে। ধারণাতীত একটি ভয়ঙ্করতম ভূমিকম্পের সূতিকাঘর হচ্ছে এই পর্বত। মহাশক্তিশালী একটি ভূমিকম্প সংঘটিত হলে পরে রাজধানী টোকিও ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনাকে কেউ উড়িয়ে দিতে পারে না। ১ কোটি ৩০ লক্ষ টোকিওবাসী তাই মনে মনে সদাই সন্ত্রস্ত। শুধু তাই নয়, টোকিওকে ধারণকৃত বৃহৎ দ্বীপ হোনশু’রও বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যাবে নিমিষে।

প্রাচীনকাল থেকেই জাপানে এক একটি ঘটনা বা বিষয়কে কেন্দ্র এক একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। সংস্কৃতি হচ্ছে চিন্তা ও দর্শনের প্রতিফলন। ভূমিকম্প নিয়েও অনেক সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে, গীত-সঙ্গীত রচিত হয়েছে। নাটক, প্রামাণ্য চলচ্চিত্র তো নির্মিত হয়েছেই। এমনকি রূপকথা, উপকথাও-সেখানে মানুষের চিন্তা ও কল্পনার বিবিধ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

ভূমিকম্পের উৎস ও রূপ নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশে নানা রকম কল্পকথা ও চিত্র বিদ্যমান। এর মধ্যে ভূমিকম্পের সঙ্গে জীবজন্তুর সম্পর্ক বা তুলনা একটি দারুণ কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়। হয়ত এটা মানুষের স্বভাবসিদ্ধ এই কারণে যে, ভূকম্পন যেহেতু নড়াচড়া, কাঁপাকাঁপি এবং ঝাঁকুনিসম্পৃক্ত সুতরাং এটা জীবন্ত কিছু একটা হবে এই ধারণা বা বিশ্বাস প্রাচীনকালে অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষের চিন্তায়, কল্পনায় প্রতিফলিত হয়েছে। যেটা আধুনিককালে এসে রূপকথা বা উপকথার পরিচিতি লাভ করেছে। যেমন আমেরিকার দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের বিশ্বাস ‘কচ্ছপে’র পিঠে মহাদেশটি অবস্থান করছে, এর নড়াচড়া থেকেই ভূমিকম্পের উৎপত্তি। ভারতীয়রা বিশ্বাস করে ‘হাতি’ মহাদেশটিকে নিয়ন্ত্রণ করে যখন একটি হাতি ক্লান্ত হয়ে মাথা কাৎ করে তখন ভূমিকম্প হয়। তেমনিভাবে সাইবেরিয়ার মানুষের ধারণা ‘কুকুর’, মঙ্গোলিয়ায় বড় ‘ব্যাঙ’ প্রভৃতি। খুঁজলে আরও পাওয়া যাবে এমন কল্পচিত্র।


অনুরূপ, ভূমিকম্পের মাতৃভূমি জাপানেও একই রকম কল্পকথা ও তার চিত্র বিদ্যমান। অতিপ্রাচীনকালে একসময় জাপানিরা তাদের ভূখণ্ডটিকে ড্রাগনের নিয়ন্ত্রণাধীন বলে মনে করত। পরবর্তীকালে বিশেষ একটি মাছ যার নাম ‘নামাজু’ ইংরেজিতে বলে ‘ক্যাটফিস’ হয়ত বেড়ালের মতো গোঁফওলা মুখাবয়ব বলে এই নাম আর বাংলায় ‘মাগুর’ বা ‘ঝাগুড়’ মাছের মতোই অনেকটা দেখতে-যার সঙ্গে ভূমিকম্পের সম্পর্ক স্থাপন করেছে প্রাচীন মানুষ। ভূমিকম্পকে নামাজু মাছরূপে চিন্তা করে স্বতন্ত্র একটি সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে তারা। নিঃসন্দেহে মাছটি ছোট নয় বিশাল মাপের তাই এটা নড়লে-চড়লেই ভূকম্পন সৃষ্টি হয়। আর মাছ তো বেশিই নড়াচড়া করে তাই কি জাপানে ভূমিকম্প বেশি? পরীক্ষিত বৈজ্ঞানিকজ্ঞানে তা তো নয়।

কিন্তু মানুষের বিশ্বাসই অনেক ক্ষেত্রে সংস্কৃতির প্রতিভূ। জাপানের একটি প্রাচীন লোককাহিনী মতে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয় বিপুলাকার একটি ‘নামাজু’ মাছের দেহ মোচড়ানো বা পাক খাওয়া থেকে। দেবতারা মাছটিকে বিশাল একটি পাথরের নিচে বেঁধে রাখতেন যাতে নড়াচড়া করতে না পারে। কিন্তু যেই দেবতারা কোথাও চলে যেতেন, বিশেষ করে অক্টোবর মাসে শিমানে-প্রদেশের প্রাচীন ইজুমো শিন্তোও মন্দিরে বাৎসরিক দেবসম্মেলনে তখন নামাজু মুক্ত হয়ে নড়াচড়া শুরু করত এবং ফলে ঘনঘন হত ভূমিকম্প। এই লৌকিক বিশ্বাস বা কুসংস্কারের কথা জাপানের প্রাচীনতম ইতিহাসগ্রন্থ ‘নিহোন শোকি’তেও লিখিত আছে।

বর্তমানে জাপানে বড়সড় নামাজু দেখা না গেলেও থাই-ভিয়েতনামে প্রবাহিত খরস্রোতা মেকং নদীতে বিস্ময়কর বিশাল বিশাল আকৃতির ক্যাটফিস ধরা পড়ে। বাংলাদেশের মাগুরমাছ বা আফ্রিকান মাগুরও মেকংকের মাগুরের কাছে নস্যি মাত্র। তাহলে একটা বিষয় দেখা যাচ্ছে যে, নামাজু তথা মাগুর মাছ বিশাল আকৃতির হয় এবং নিশ্চয়ই প্রাচীনকালে জাপানেও বিদ্যমান ছিলো। কিন্তু কত বড় আকৃতির নামাজু হলে পরে ভূমিকম্পের মতো একটি শক্তির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, আবার সেটা নামাজু না হলে নয়-এই রহস্যটা বড়ই অদ্ভুত, কিন্তু বোধগম্য নয়।


যাহোক, ভূমিকম্পের এই মূলনায়ক নামাজুকে কেন্দ্র করে বহুবর্ণ উকিয়োএ বা ছাপচিত্রে শিল্পীরা তাকে বিচিত্রভাবে এবং চরিত্রে অঙ্কিত করেছেন। ‘নামাজুএ’ বা ‘নামাজুচিত্র’ এই চিত্রাঙ্কনধারা একান্তই স্বতন্ত্ররূপে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই চিত্রের জন্ম এদো যুগে (১৬০৩-১৮৬৮)। ১৮৫৫ সালের অক্টোবর মাসের ২ তারিখে ‘আনসেই নো দাইজিশিন’ নামক একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। ৬.৯ মাত্রার এই ভূমিকম্পে প্রায় ৪,৩০০ মানুষ মারা যায়, ১০ হাজারের মতো ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিলো তৎকালীন রাজধানী এদো মহানগর বর্তমান টোকিও উপসাগর এবং আরাকাওয়া নদীর প্রবেশপথসংলগ্ন অঞ্চল। ভূমিকম্পের পরপরই রাজধানী এদোকে কেন্দ্র করে বহুল পরিমাণে ‘নামাজুএ’ চিত্র প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন সংগ্রহে থাকা প্রায় আড়াইশ’র বেশি চিত্র শুধু ভূমিকম্পবিষয়ক। মাত্র দু’মাসের মধ্যে জনসাধারণে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে বুম্ হয়ে দেখা দেয় ফলে বিক্রিও হয় দেদার। কিন্তু কেন হঠাৎ করে এই চিত্রগুলো আঁকা হলো সেটা যেমন এক রহস্য তেমনি শিল্পীদের নামও ছবির কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না সেও আরেক রহস্য। অবশ্য এই সময় এদো’র সামুরাই শাসকদের দ্বারা ‘উকিয়োএ’ চিত্র ব্যয়বহুল বিলাসী বস্তু হিসেবে সরকারি নিয়ন্ত্রণের শিকার হয়েছিল হয়ত যে কারণেও শিল্পীরা তাদের নাম কোথাও উল্লেখ করেননি। কিন্তু এগুলো যে দক্ষ শিল্পীর আঁকা তাতেও কোনো ভুল নেই। সাধারণত জাপানে প্রাচীনকাল থেকেই চিত্রশিল্পীরা নিজের নামের সীলমোহরের ছাপ শিল্পকর্মে রেখে দেন এটাই রীতি। কিন্তু এই ছবিগুলোতে সেটা না থাকাতে কে বা কারা আঁকল, কেন আঁকল অজানাই থেকে গেল। তবে চিত্রগুলো যে ইউনিক বা স্বতন্ত্র তা স্বীকার করতেই হবে! জাপানিদের হিউমর বা রসবোধ যে ওই সময়েও ছিলো সত্যিই চমৎকার সেটা এই চিত্রগুলোতে সুস্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পীরা যা প্রশংসিত হওয়ার দাবি রাখে। উল্লেখ্য যে, এর আগে ১৮৪৭ সালের ২৪ মার্চে সংঘটিত জেনকোওজি-জিশিন নামক ভূমিকম্পের পর উতাগাওয়া কুনিতেরু নামে একজন উকিয়োএ-চিত্রকর নামাজুর ছবি আঁকেন। তারপর ১৮৫৩ সালে ২ ফেব্রুয়ারিতে ওদাওয়ারা-জিশিন ভূমিকম্পের পর কিছু নামাজুএ প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলো সামান্যই।

যে আড়াই শত চিত্র পাওয়া গেছে সেগুলোতে ভূমিকম্প ঘটানোর কারণে নামাজুকে দলবেঁধে শাস্তি প্রদান, এককভাবে মেরে ফেলা; নামাজুর ওপর দেবতার আরোহন, দেবতা ‘কাশিমা’ কর্তৃক নামাজুহত্যা, নামাজু নিজেই কৃতকর্মের শাস্তিস্বরূপ হারাকিরি (উদর কাটা) করে পেট থেকে অঢেল মুদ্রা বের করে ঋণশোধকরা, দেবতা ‘কাশিমা’ ও নামাজু পরস্পরের গলায় দড়ি বেঁধে টানাটানি, ভূমিকম্পে য়োশিওয়ারা বা পতিতালয় ধ্বংস হয়ে গেলে পথাশ্রিত গেইশার বিজ্ঞাপনে নামাজু, ভূমিকম্প সংঘটনের কারণে নামাজুদের ক্ষমাপ্রার্থনা, দেবতা কর্তৃক নামাজুর মাথায় পাথর চাপা দেয়া এবং অন্যান্য নামাজুর ক্ষমা চাওয়া, এবিসু দেবতার কাছে নামাজুদের ক্ষমা পার্থনা, এদো নামাজু ও শিনশু নামাজু কর্তৃক জনসাধারণকে হানা দেয়া, ভূমিকম্প ঘটানোর কারণে নামাজুদের বেঁধে ধরে নিয়ে আসা, মহানামাজুসৃদশ প্রাণীর নদীতে ভেসে ওঠা, পুরোহিতরূপী নামাজুকে ঘিরে থাকা কারিগর ও শ্রমিক, বড় লাউ জাতীয় ভারী কিছু দিয়ে নামাজুর মাথায় চেপে ধরা, য়োশিওয়ারাতে নাগরিকদের সঙ্গে নামাজুদেরও ভীড় করা, নামাজুকে সাধারণ মানুষের আক্রমণ, নামাজু কর্তৃক ব্যবসায়ীকে আক্রমণ, নামাজু কর্তৃক দানবকে সুরা প্রদান, জনসাধারাণ্যে নামাজুকে পরিচিত করে দেয়া, এবিসু দেবতা কর্তৃক বিশাল নামাজুকে দমিয়ে রাখা, নামাজুর বুশি বা যোদ্ধার রূপ ধারণ, পুরোহিত হিসেবে নামাজুর আত্মপ্রকাশ, বানরের নামাজুকে চেপে ধরা, সাজাপ্রাপ্ত পুরুষ নামাজুকে নারী নামাজুর সুরা প্রদান, নামাজু ও সন্তান কর্তৃক সাধারণের সঙ্গে দাঙ্গা, নামাজুকে কেন্দ্র করে গৃহনির্মাণ কারিগরদের সুরাপান, বিশলাকায় পাখির পায়ে ধৃত নামাজু, নামাজু কর্তৃক ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের ঘরবাড়ি মেরামত করা, আহতকে উদ্ধার করা; নগর পুনর্নির্মাণের কারণে ব্যবসা চাঙ্গা হওয়ার জন্য ব্যবসায়ীরা নামাজুকে দেবতা হিসেবে ভক্তি করা ইত্যাদি নানা মোটিফ পরিলক্ষিত হয়। হাস্যরসে টইটুম্বুর, কৌতুকে ভরপুর প্রতিটি চিত্রকর্ম! স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। যেমন রং, রেখা, আঙ্গিক তেমনি চিত্রের ভাষা এবং প্রতিটি মুখের সরস ভঙ্গিমা সত্যি অসামান্য কাজ, অপার আনন্দদায়ক! সন্দেহ নেই যে, অত্যন্ত পরিতৃপ্তির সঙ্গেই নামাজুচিত্র এদো মহানগরের নাগরিকরা ক্রয় করেছেন। নামাজুচিত্রের প্রভাবে ওই সময়কার বিখ্যাত একটি কাবুকি নাটক ‘শিবারাকু’তে একটি দুষ্ট নামাজু চরিত্র ‘নামাজু বোওজু’ বা ‘নামাজু-বালক’ সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই নাটকে প্রধান নায়ক কর্তৃক ওই নামাজু-বালককে পাথর দিয়ে চেপে ধরার দৃশ্যও মঞ্চায়িত হয়।  

‘নামাজু-এ’ চিত্রকলা যেমন অতীতের বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে প্রভাব গ্রহণ করেছে তেমনি পরবর্তীকালে প্রচলিত ‘ফুওশিগা’ বা ‘বিদ্রুপাত্মকচিত্রকলা’, ‘হাশিকাএ’ হামরোগ সংক্রান্ত চিত্র, ‘আওয়াতেএ’ চিত্র যা রাজনৈতিক অস্থির সময়ের (১৮৬৩) চিত্র নামে খ্যাত (উকিয়োএ-রই দুটি শাখা) প্রভৃতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। নামাজুর ছবি যে এদো যুগের অন্যান্য শিল্পীরা আঁকেননি তা কিন্তু নয় বিখ্যাত উকিয়োএ মাস্টাররাও এঁকেছেন যেমন উতাগাওয়া কুনিয়োশি, কাওয়ানাবে কিয়োসাই প্রমুখ।  

‘নামাজুএ’ চিত্র থেকেই জাপানে এই মাছটি জনপ্রিয়তায় নতুন মাত্রা পেয়েছিল বলে মনে হয় এবং তার সংস্কৃতিও বিস্তৃতি লাভ করে। সাম্প্রতিককালে সাইতামা-প্রদেশের য়োশিকাওয়া রেলস্টেশনের সামনে একটি বিশাল ও একটি ছোট্ট নামাজু মাছের দৃষ্টিনন্দন সোনালি ভাস্কর্য পরিবেশকেই বদলে দিয়েছে! গিফু-প্রদেশের ওওগাকি মাৎসুরি উৎসব এবং শিরাহিগে মাৎসুরি উৎসবে নামাজুকে সোনার লাউ হাতে এক বৃদ্ধ কর্তৃক চেপেধরা কারাকুরি (যান্ত্রিক) পুতুল স্থাপিত ‘দাশি’ নামক গাড়ি টেনে টেনে চালানো হয়, এই পুতুলটি মূল্যবান সাংস্কৃতিক সম্পদ। অনুরূপ জাপানের বিভিন্ন জায়গায় নামাজুকেন্দ্রিক নানা প্রবাদ ও কর্মকাণ্ড বিদ্যমান। যেমন শিগা-প্রদেশের নয়নাভিরাম বিওয়াকো হ্রদসংলগ্ন চিকুবুশিমা দ্বীপের মানুষের মধ্যে নামাজু ড্রাগনে রূপান্তরিত হওয়া অথবা ড্রাগন বড় নামাজুতে পরিণত হয়েছে বলে প্রচলিত আছে। কিউশুর কুমামোতো প্রদেশের আসো-শি শহরে নামাজুকে দেবতা হিসেবে উপাসনা করার শিন্তোও মন্দির বিদ্যমান। এখানে নামাজু শিকার করা ও খাওয়া নিষিদ্ধ। সাগা-প্রদেশে নামাজু খেলে পরে অসুখ হওয়ার কুসংস্কার প্রচলিত। বড়শি দিয়ে নামাজু ধরার রীতিও আছে।


জাপানে অঞ্চলভেদে নানা ধরনের খাবার তৈরি হয় নামাজুর। এর মধ্যে নামাজু সাশিমি, নামাজু সুশি, নামাজু ইয়াকি, নামাজু দোম্বুরি, নামাজু ফ্রাই, নামাজু তেনপুরা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে খুব সস্তা একথা বলা যাবে না। যেমন নামাজু ফ্রাই, নামাজু তেনপুরা ৫৮০ ইয়েন।  

নামাজু অনেকে বাসাবাড়িতে একুইরিয়ামে অথবা ‘ইকে’ বা ‘ছোট্ট পুকুরে’ লালন-পালন করে থাকেন। নামাজু নামে ১৯৩৭-৮৮ সাল পর্যন্ত নাগোয়া রেল রোড কোস্পানি কর্তৃক পরিচালিত বেশ জনপ্রিয় একটি ট্রেনের নাম ছিলো। এদেশে  বহুল বিক্রিত একটি কম্পিউটার সিস্টেম সফটওয়্যারের নাম নামাজু। তরুণদের জন্য প্রসিদ্ধ শোগাকুকান প্রকাশনা সংস্থার বহুল প্রচারিত ও জনপ্রিয় দুটি কমিকস্ মাসিক ও সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন যথাক্রমে ‘বিগ্গু কমিক্কু’ এবং ‘শুউকান শোওনেন সানডে’র প্রতীক হচ্ছে নামাজু। নামাজু জনপ্রিয় এটাই তার প্রমাণ। এই ম্যাগাজিন দুটির প্রচার সংখ্যা লক্ষ লক্ষ কপি। শুধু তাই নয়, জগৎজোড়া তোলপাড় করা জাপানি কার্টুন / অ্যানিমেশন গেমস ‘পোকেমোন’ এর একটি জনপ্রিয় ক্যারেক্টার নামাজু থেকে তৈরি নাম ‘নামাজুন’।

নামাজু নিয়ে ক’জন গবেষণা করছেন জানা নেই তবে জাপানি সম্রাটের দ্বিতীয় রাজপুত্র আকিশিনোমিয়া একজন স্বনামখ্যাত নামাজু গবেষক। নামাজু নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন।  

‘নামাজুএ’-চিত্র এখনো আঁকা হচ্ছে নতুন নতুন আঁকিয়েদের দ্বারা, হারিয়ে যায়নি এই সংস্কৃতি। যতদিন জাপানে ভূমিকম্প থাকবে ততদিন ‘নামাজুএ’ চিত্রগুলো গবেষণাগারে, জাদুঘরে এবং ভক্তদের ঘরে থাকবে। লক্ষাধিক টাকা মূল্য হলেও পুরনো ‘নামাজুএ’ চিত্র কেনার ভক্তের অভাব নেই। মাঝেমধ্যে এগুলো জাদুঘর কর্তৃক প্রদর্শিত হয়ে থাকে। ভীড় করে দেখার জন্য নবীন-প্রবীণরা এবং শিল্পকর্ম জগতের মানুষজন। বিদেশিদের কাছে ‘নামাজুএ’ এবং ‘নামাজু উকিয়োএ’ চিত্রকলা অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিশ্বের বড় বড় জাদুঘর এবং উচ্চবিদ্যাপীঠসমূহে সংরক্ষিত আছে অনেক চিত্র। ‘নামাজুএ’ চিত্র দেখে নতুন প্রজন্ম বিশ্বাস করুক আর নাই করুক তাদের পূর্বপুরুষরা একদিন বিশ্বাস করত যে মাটির নিচে, জলের তলে দৈত্যসম শক্তিশালী বিশাল নামাজু ছিলো যারা নড়লেই ভূমিকম্প হত! ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প নিয়েও যে স্বতন্ত্র সংস্কৃতি গড়ে ওঠে জাপান তার উজ্জ্বল প্রমাণ।    

লেখক: প্রবীর বিকাশ সরকার
শিশুসাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫