Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

শ ব্দ র ম্য

অন্তর্বাসের অন্দরমহল

Icon

সুমন সাজ্জাদ

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২০, ১৬:৫৯

অন্তর্বাসের অন্দরমহল

একদা মানুষ নগ্ন ছিল; অতঃপর লজ্জানিবারণ হেতু বৃক্ষপত্রাদি, পশুচর্ম ইত্যাদি পরিধান করতে শিখিল। ধর্মতত্ত্ব যা-ই বলুক পোশাক-আশাকের ইতিহাসে এই ‘টারজান-তত্ত্ব’ সাধারণভাবে প্রচলিত। মোটা দাগে পোশাকের দুই ভাগ- বহির্বাস ও অন্তর্বাস। বহির্বাস বিষয়ে আমাদের প্রকাশ্য আগ্রহ যত বেশি অন্তর্বাস বিষয়ে গুপ্ত ফ্যান্টাসি তত কম নহে। একবার কোথায় যেন পড়েছিলাম জাপানে পুরনো অন্তর্বাস বিক্রি করা হয়, লোকে তা আবার কিনেও থাকে। অন্তর্বাস চুরির রসময় ঘটনাও শুনেছিলাম লোকমুখে। ফ্যাশনের একটি ধারাই আছে- ‘আন্ডারওয়্যার অ্যাজ আউটওয়্যার।’ সুপারম্যানের আন্ডারওয়্যার অবশ্য প্যান্টের ওপরেই থাকে। অন্তর্বাস যে অবহেলার বস্তু নয়, নিশ্চিতভাবেই তা বলা যায়। আজ আমরা তাই একটু ঘুরে আসতে চাই অন্তর্বাসের অন্দরমহল।

ধরা যাক, অন্তর্বাস শব্দটির কথাই। এটি সংস্কৃত অন্তর এবং বসনের বাস থেকে তৈরি। বলাবাহুল্য, অন্তর্বাস বলতে কেবলই পুরুষের আন্ডারওয়্যার বোঝাচ্ছে না। সকল ধরনের ভেতরের পোশাককেই বলা হচ্ছে অন্তর্বাস; এর আরেকটি বাংলা দেখা যায় মাঝে মাঝে- ভেতরবাস, মানে ভেতরের বসন। এ অর্থে ইংরেজি আন্ডারওয়্যারের বাংলা অন্তর্বাসই হওয়া উচিত; কিন্তু শব্দটি চলে গেল পুরুষের দখলে। মূলত আন্ডারওয়্যারের অর্থ সংকোচন ঘটেছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষ যে শব্দ ব্যবহার করা যেত সেটি হয়ে গেছে পুরুষের একক সামগ্রী। যদিও অন্তর্বাস শব্দটি নারী-পুরুষের গুপ্ত পোশাকের ক্ষেত্রে নির্বিশেষে ব্যবহার করা হয়। যেমন লিঙ্গনির্বিশেষে ইংরেজিতে ব্যবহৃত হয় আন্ডারওয়্যারের ক্ষুদ্র রূপ আন্ডিজ।

জড়তা এড়াতেই বোধ হয় ইদানীং দুটি ইংরেজি শব্দের প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে: বাইরের পোশাক বোঝাতে আউট ফিট, ভেতরের পোশাক বোঝাতে ইনার স্যুট। এখন প্রশ্ন হলো পুরুষের জন্য আর কী ধরনের অন্তর্বাস বরাদ্দ আছে? পুরুষমাত্রই তা জানেন; যেমন: জাঙ্গিয়া, লেঙ্গট। দুটির মোলায়েম রূপ হলো জাঙিয়া ও লেঙট। উল্লেখ্য যে, শিশুদের পরিধেয় হিসেবেও এই শব্দ দুটির চল ছিল। জাঙ্গিয়া শব্দটি তৈরি হয়েছে জঙ্ঘের সঙ্গে বাংলা ইয়া যোগ করে; কিন্তু সমস্যা আছে একটা। জঙ্ঘা বলতে বোঝায় হাঁটু থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত অংশকে; কিন্তু এই পর্যন্ত পরিধানের জন্য আলাদা কোনো অন্তর্বাস ভারতভুবনে আমি দেখিনি। তাহলে কি জঘনের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক আছে? জঘন বলতে বোঝায় কোমর বা কটিদেশ। জঘনের সঙ্গে ইয়া যোগ করেও জাঙিয়া শব্দটি তৈরি হয়ে থাকতে পারে।

এবার আসা যাক লেঙ্গটে। এটির উৎসও বেশ মজার। লিঙ্গপট থেকে লেঙ্গট, লেঙট। সহজ করে বললে বিষয়টি এমন: লিঙ্গ ঢাকাঢাকির জন্য যে পট্ট বা কাপড়, তা-ই কালে কালে লেঙটে পরিণত হয়েছে। লেঙটের বিকল্প হিসেবে আঞ্চলিক বাংলায় আছে লেংটি।

পুরুষের ঊর্ধ্বভাগে তাকানো যাক। অর্থাৎ আমরা কথা বলতে পারি গেঞ্জি নিয়ে। অন্তর্বাস হিসেবে এটির কদর না করে পারা যায় না। গেঞ্জির উৎস ইংরেজি guernsey বা gansey। ইংল্যান্ডের গুয়েরেন্সি দ্বীপপুঞ্জে জেলেরা নরম ও আরামদায়ক এক ধরনের পোশাক পরত। বৃষ্টি ও নোনা জলের ছাট থেকে বাঁচতে সহায়ক এই পোশাকের নাম প্রচারিত হতে থাকে ওই দ্বীপপুঞ্জের নামানুসারে। ব্রিটিশ নৌসেনারাও এই পোশাক ব্যবহার করত।

অনুমান করা যায়, ব্রিটিশদের আর সব নিয়ামতের মতো গেঞ্জির মতো এই ঔপনিবেশিক অন্তর্বাসের আগমন ঘটেছে ভারতবর্ষে এবং সেই সূত্রে ঢুকে গেছে বাংলা ভাষার শব্দসম্ভারে; কিন্তু গেঞ্জির সঙ্গে আমরা আবার স্যান্ডো বসাই। ফিলিপিনি ভাষায় স্যান্ডো মানেই ঊর্ধ্বভাগের অন্তর্বাস।

মেয়েদের অন্তর্বাস-বিশ্ব বেশ প্রসিদ্ধ। হরেক রকম তার নাম: কাঁচুলি, ব্রা, প্যান্টি, বিকিনি, শেমিজ। স্তন-আবরণী হিসেবে কাঁচুলি শব্দটির প্রয়োগ চলতি বাংলায় খুবই সীমিত। বলে রাখা যৌক্তিক যে, আমাদের দেশে যা কেবলই অন্তর্বাস হিসেবে বিবেচিত, প্রকাশ্যে পরিধানের বিষয় নয়, বিশ্বের অন্য অঞ্চলে কিন্তু তা নয়। সংস্কৃতে এটি ছিল কুঞ্চলী বা কুঞ্চলিকা, প্রাকৃতে কুংচলি; বাংলায় ছোট পোশাকটিকে আরও ছোট করে করা হয়েছে কাঁচুলি বা কাঁচল। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে কাঁচল বা কাঁচুলির প্রচুর প্রয়োগ লক্ষ্য করা যাবে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে রাধিকা-মগন কৃষ্ণের কথায় উঠে কাঁচুলি উন্মোচনের আহ্বান-
যশোদার পোঅ আহ্মে নামে গোবিন্দ।
তোর রূপ দেখিআঁ চখুতে নাইসে নিন্দ ॥
কাঞ্চুরী ঘুচাআঁ রাধা দেহ মোরে কোল।
তোব দুঈ তনে লাগু রসের হিলোল ॥

অতি সরলার্থ: যশোদার ছেলে আমি, নাম গোবিন্দ। তোর রূপ দেখে না আসে নিদ। কাঁচুলি ঘুচিয়ে রাধা আমাকে দে কোলে, তোর দুই স্তনে লাগবে রসের হিল্লোল। ওই দিকে আলাওল লিখেছেন, ‘অলকের পাশে যেন যেন কমলেতে অলি।/সগর্ব কঠিন কুচে শোভিত কাঞ্চুলি।’ রবীন্দ্রনাথের মতো ‘নিষ্ফল কামনা’র কবির চোখও কাঁচুলি-দর্শন এড়াতে পারেনি।

মেয়েদের আরেকটি অন্তর্বাস বডিস। bodz শব্দের বহুবচনবাচক রূপ bodies-এর রূপান্তর bodice। ষোল শতকের দিকে শব্দটি ব্যবহৃত হতো নারী শরীরের ঊর্ধ্ব ভাগের পোশাক অর্থে; কিন্তু অচিরেই এটি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে কোমরের ওপরভাগের অন্তর্বাস রূপে। বহুবচনবাচক শব্দ গ্রহণের কারণ সম্ভবত এই যে, নারীর ঊর্ধ্বাংশের পোশাক সাধারণত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে থাকে।

শেমিজ অন্য অন্তর্বাসগুলোর চাইতে আকারে প্রকারে আলাদা। ইংরেজি chemise শব্দটির ধারাক্রম বেশ দীর্ঘ। এটিকে ধরা হয় ইতালিয়ান camicia এবং স্প্যানিশ-পর্তুগিজ camisa’র সমধর্মী শব্দ হিসেবে। সবগুলোর উৎসমূলে আছে লাতিন camisia। অর্থাৎ কামিসিয়ার উচ্চারণগত সাম্প্রতিক পরিণতি শেমিজ; কিন্তু আরবি কামীস থেকে আসা কামিজ বলতে যে পোশাক তৈরি হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশে তা শেমিজ নয়। যদিও শেমিজ ও কামিজ দুটিই বাংলা ভাষায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রথমটি অন্তর্বাস, দ্বিতীয়টি বহির্বাস। শেমিজ যত ছোট কামিজ ততই লম্বা। তবে অনুমান করা যাচ্ছে যে, শেমিজ ও কামিজের উৎস-শব্দ একই।

ব্রার ইতিহাস কাঁচুলি বা বডিসের মতো পুরনো নয়। মাত্র ১৯৩০ সালের ব্যাপার। ইংরেজি এই শব্দ/শব্দাংশটি ফরাসিদের ব্রেসিয়ারের সামান্য একটি টুকরো মাত্র। brassiere থেকে bra। ব্রেসিয়ার থেকে ধার করা ফল হলো ইংরেজদের ব্রা। বাঙালি ব্রাকে ব্রেসিয়ারই বলত। ধীরে ধীরে সেটিকে ছোট করে নিয়েছে। তবে বাঙালি শুদ্ধতাবাদী ব্রাহ্মণ অভিধানকারে কেউ কেউ ব্রা, ব্রেসিয়ার কোনোটিই রাখেননি। পর্বতপ্রমাণ অভিধানে আন্ডারওয়্যার থাকলেও ব্রা নেই। ছোট পোশাকবিষয়ক সামাজিক জড়তা একটি কারণ হয়ে থাকতে পারে। এখনকার দিনে এসব শব্দ উচ্চারণের ক্ষেত্রে জড়তা কম বলে মনে হয়। তাই লুৎফর রহমান রিটন একবার লিখতে পেরেছিলেন, ‘শুনুন বলি ব্র্যাকেটে/দুইটি টুপি যায় বানানো/একটি মাত্র ব্রা কেটে।’

ব্রার বছর কয়েক আগের শব্দ প্যান্টি। এটি পুরুষের প্যান্টের আকৃতি ও প্রকৃতিগত সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। ইংরেজি প্যান্ট এসেছে pantaloon থেকে। শব্দের উৎস বিশারদদের মতে, ইতালিয়ান কমেডির pantalone নামক এক বুড়ো চরিত্রের নাম থেকে এসেছে প্যান্ট; লিকলিকে পাওয়ালা লোকটি পরত চামড়া-খামচে ধারা টাইট ফিট পোশাক। সেই কমেডির জেরে শব্দটি হয়ে গিয়েছে ফরাশিতে- pantalon, সেখান থেকে ঘুরে ইংরেজিতে প্যান্ট। মেয়েদের জন্য প্যান্ট হয়ে গেছে প্যান্টি। অবশ্য শুরুর দিকে, মানে ১৯০৮-এর দিকে, বাচ্চাদের অর্থাৎ পোশাক ছোটদের পোশাক অর্থেও প্যান্টির প্রচলন ছিল।

অন্যদিকে বিকিনির সঙ্গে সম্বন্ধ আসলে বোমার। তাও আবার অ্যাটম বোমার। কী আশ্চর্যের কথা! ১৯৪৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের বিকিনি অ্যাটোলে পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালায়। এই সময়টিতেই নারীদের মধ্যে দুই প্রস্থ সাঁতার পোশাক পরার প্রবণতা দেখা দেয়। সেই থেকে মেয়েদের সাঁতার পোশাকের নাম হয়ে যায় বিকিনি। এই বিবেচনায় একে অন্তর্বাসধর্মী পোশাক বলা যেতে পারে। বিকিনি বিচে যখন মেয়েরা সাঁতরায় তখন তা বহির্বাস হয়ে ওঠে। বিকিনির বিকিকিনির প্রসার বেড়ে যাওয়ায় ১৯৪৭ সালে ডিজাইনাররা পোশাকটিকে তৎক্ষণাৎ লুফে নেয়। হাল আমলে ডিজাইনের কী বাহার ব্যবহারকারী এবং দ্রষ্টামাত্রই তা জানেন।

অন্তর্বাস নিয়ে পৃথিবীতে নানা ধরনের কা-কারখানা ঘটে থাকে। তার একটা- নো প্যান্টস ডে। প্রতি বছর মে মাসের প্রথম শুক্রবারে কোনো প্যান্ট পরা হবে না; সবাই যার নিম্নভাগের অন্তর্বাস পরে ধরাধামে আবির্ভূত হবে। এই প্রথার উদ্ভব অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০২ সালে নিউইয়র্কে শুরু হয় ‘নো প্যান্টস সাব ওয়ে রাইড’; প্রতি বছর জানুয়ারিতে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী যাত্রীরা ট্রেনে উঠবে; দরজা বন্ধ হবার পর যার যার প্যান্ট খুলতে থাকবে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে, ‘ভালো লাগছে না’ এবং লাজশরমের মাথা খেয়ে মুখোমুখি বসে থাকতে হবে। আরেকটি বিখ্যাত ইভেন্ট হলো ‘আন্ডি রান’; বিনোদন কিংবা দাতব্য কাজের অংশ হিসেবে এই দৌড়ের সূত্রপাত। নিয়ম অনুযায়ী অংশগ্রহণকারী দৌড়াতে দৌড়াতে সবাইকে পোশাক খুলে ফেলতে হবে। পরিশেষে আদম সন্তানদের গায়ে ঝুলে থাকবে শুধু দুই খণ্ড অন্তর্বাস। না থাকলেই বা কী! আন্তর্বাস পরে তো আর কেউ জন্মায় না!

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫