Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

অনঙ্গ শীতের দেশে

Icon

জোবায়ের মিলন

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২০, ১৫:০০

অনঙ্গ শীতের দেশে

বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রকৃতির ছয়টি ঋতুর আবিরে ছয় রূপে উদ্ভাসিত হয়। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত-শীত ও বসন্তের চক্রাকার প্রকাশে ফুটে ওঠে এ বাংলার প্রকৃত চেহারা। গ্রীষ্মে তাপে দাউ দাউ করে তো বর্ষায় ভিজে ভরে ওঠে জলে আর জলে। শরতে আকাশনীলায় সেজে নীলমণি হয় তার প্রতিপ্রান্ত। হেমন্ত এলে জাগে আরেক নবীন রূপ। ঘামের শরীরে তিরতির করে লাগে উত্তরের শীতল বায়ু। শেষ রাতে ঝরে কুয়াশা ভাঙা শিশির। ধানের ডগায় রুপার বিন্দুর মতো চেয়ে থাকে চোখ মেলে জলের ফোঁটা। ভারি সুন্দর সে তাকিয়ে থাকা। তারপর আসে হিমশীতল শীত। গা কাঁপিয়ে জড়োসড়ো করে আবহমান বাংলার আদ্যোপান্ত। ঘাসের রঙ মরে। পাতার বদন বদলায়। গাছে গাছে বয়স্ক ছাপ দেখা দেয়। বলিরেখার ভাঁজে ভাঁজে জমে ধুলার রেখা। জীর্ণ দেখায় চারপাশ। শীর্ণতায় কাত হয়ে পড়ে থাকে মাঠ-ঘাট, শূন্যতায় খাঁ খাঁ করে ফসলের জমিন। ভারী সাদা মেঘের মতো কায়াশার চাদর ঢেকে রাখে গ্রাম-গঞ্জ, তখন আকাশ আর মাটির সীমা যেন হাতের কাছের পাশের পরশী।

ঋতুর আছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। শীতেরও তা স্বতন্ত্র। শীতে এক ধরনের ধূসরতা নেমে আসে। মলিন আভা জেগে ওঠে। মরা মরা ভাব দেখা যায়। প্রাণহীন পল্লবে পল্লবে ভরে ধরাতল। জলে, স্থলে মৃতগন্ধ বয়ে যায়। বাতাসে ত্বকফাটা অত্যাচার। ঠোঁট ফেটে চৌচির হয়। নিজেকে লুকাতে উঠানে উঠানে আগুনের উনুন জ্বলে। গায়ে জড়ায় গরম কাপড়। প্রকৃতির রূপ এঁকে রাখাতে কবি এই মরা ঋতু নিয়ে লেখেন, ‘প্রকৃতির প্রফুল্লতা, সুখগাঁথা লুকায় কোথায়-/শীত-ক্লিষ্ট নিস্তব্ধ বিজনে?/যৌবন গিয়েছে মরে, মর্মভরা প্রেমের ব্যথায়,/জরা আজি বিচরে জীবনে।/আসিবে না সে যৌবন, ফিরে নিয়ে সুখ-উন্মাদনা...’ (শীত বাসরে; বিজয়চন্দ্র মজুমদার।) প্রকৃতি ও ঋতু নিয়ে সবচেয়ে বিচক্ষণ ও খেয়ালী লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লিখেছেন, ‘ডেকেছো আজি, এসেছি সাজি/হে মোর লীলাগুরু-/শীতের রাতে তোমার সাথে/কী খেলা হবে শুরু!/ ভাবিয়াছিনু গতিবিহীন গোধূলি ছায়ে হলো বিলীন/পরাণ মম, হিমে মলিন আড়ালে তারে হেরি?/উত্তরবায় কারে জাগায়, কে বুঝে তার বাণী-/অন্ধকারে কুঞ্জদ্বারে বেড়ায় কর খানি।’ (উদ্বোধন)। তবে জরা, মরা, জীর্ণ, শীর্ণ, ক্লান্ত, বলিরেখার ঋতু নামে শীতের ঋতুকে যতই ডাকা হউক-না কেন শীতের আলাদা অলঙ্কার, বিভা বিমোহিত করে এ জনপদের মানুষকে। তার অঙ্গ-অনঙ্গে ভরে ওঠে প্রকৃতির শূন্যস্থান। পূরণ হয় জীবজগতের নানান উপকরণ, উপাদান। শীতে ফুল ফোটে ভিন, ফল ফলে আরেক, সফলের চাহিদায় তারে কাজে লাগে আলাদা। লতায় পাতায় আসে অবসতা। নতুন জন্মের সুপ্ত প্রস্তুতি চলে বৃক্ষে বৃক্ষে। বাকলে বাকলে ভেতরে ভেতরে সজাগ হয় পুনর্জন্মের প্রেরণাপত্র। মৃত্যুতে বোধ ফেরে প্রকৃতির, কিংবা গতজন্মের অপরাধ ঝরায় এই শীত।

শীতে খোলা প্রান্তরে জীবন-জীবিকার অদল-বদল ব্যঞ্জনা তৈরি করে আবাসে অভ্যাসে, আনন্দে বিনোদনে। শুকনো মুখেও চেনা হাসির দেখা মেলে। সতেজ শাকে-সবজিতে, আমন ধানের নতুন চালের পিঠাপুলিতে, তরতাজা খাবারে আহারে, আচারে অনুষ্ঠানে শীত তার আপন রঙ দেখায়। সে রঙে মলিনের মধ্যে রঙিন হয়ে ওঠে বাঙালির মন। এ রঙ যদিও বা বসন্ত মতো নয়, তবুও উৎযাপন করে এ অঞ্চলের হাজার বছরের শীতলোভা হৃদয়। তারা প্রত্যাশা করে শীত পড়ুক।

গ্রামে ও শহরে শীতের উপভোগ চরিত্র এক নয়। নগরে শীত আসে বিলম্বে। শীত এখানে কাবুও করে কম। যেন তার শক্তি চতুর মানুষের কাছে পরাস্ত। পৌষের শেষ ভাগ বা মাঘের মধ্যে কিছুটা শীত জেঁকে বসে। শৈত্যপ্রবাহ হলে শহরের মানুষ বোঝে শীত এসেছে। কোটে, জ্যাকেটে, মাফলারে নিজেকে আবৃত্ত করে পথে নামে তারা। ততক্ষণে ঘরে ফ্যান বন্ধ হয়। টি-স্টলে ভিড় বাড়ে। অভিজাত দোকানে ওঠে শীতের কুলিপিঠা, গুড় পিঠা। স্টেশন মোড়ে, ঘনবসতি স্থানে বসে চিতই আর ভাঁপা পিঠার অস্থায়ী দোকান। মধ্যবিত্ত লাইন দেয় সেখানে। গ্রামের নাড়ি ছেঁড়া মানুষ আবার ফিরে পায় শৈশব। কেউ কেউ ফিরেও যায় সেই গ্রামে, এই শীতে। সন্তানের স্কুল ছুটি হলে থাকে কয়েক দিন। তখন খালি পায়ে হাঁটে। খোলা মাঠে দৌড়ায়। চুলার পাশে বসে চলে ঝোলা গুড়ে ভাজা মুড়ি। অন্যরকম এক তৃপ্তির ঢেকুর বাজে বাংলা মায়ের কোলে-ফেরা বাংলা সন্তানের।

শীতের সম্মোহনে মোহিন হয় না এমন বাঙালি দেখি না। চরম রুদ্র যিনি তাকেও যেমন দেখি শীতের দিক-দিগন্তে উৎফুল্ল হতে, তেমনি আত্মমগ্ন কোমলকেও দেখি কুয়াশা ছুঁয়ে কপলে মাখতে। দুই রূপকেই দেখি শীতের জরতায় জীর্ণ হতে আবার বিভায় বিমুগ্ধ হতে। ভালো ও মন্দ, ওপিঠ ওপিঠের সৃষ্টিজগতে ঋতুর সন্তান শীতের এপিঠ-ওপিঠ আছে। দুই পিঠ নিয়েই আমাদের শীত ঋতু। ঋতুর সৌকর্য।

মারী ও মরকে মানুষ মরেছে। মানুষের দুর্দিন আজকে। ডানে ও বামে মৃত্যুর শোক সংবাদ। এক ঢেউ গিয়েছে আরেক ঢেউ সমাগত। শীতে শক্তি পাবে মরণ করোনা। হৃদযন্ত্রে কম্পন। দীর্ঘ নিঃশ্বাসের কষ্ট কল্পনা। তবু কি থেমে থাকবে জীবনযাপন রেলগাড়ি? থামবে না। রাত আসবে দিন যাবে, চাঁদের পর সূর্য, আলোর পর অন্ধকার... স্টেশন পেরিয়ে গাড়ি চলবে আরেক স্টেশনে। জীবন আর মৃত্যু। এর সঙ্গে শীত দেখা দেবে গত বছর, তার আগের বছর, তার আগের বছরের চেয়ে আরেক অবয়বে। অনেক দিন মানুষের অত্যাচারে থেকে মুক্তি পাওয়া প্রকৃতিতে এবার শীত হয়তো জাগবে অন্য অনন্য দ্যুতিময়তায়। টিনের চালে পাতা গড়িয়ে শিশির পড়ছে রিমঝিম বৃষ্টির তালে। কুয়াশায় অধিক ঝাপসা হবে গ্রাম, পাশের মফস্বল; বাজার ভরবে কাঁচা ফলে, ফসলে। ঘর থেকে বের হওয়া-না হওয়া নতুন অভ্যাসে মুখোবন্ধ পড়া কাউকে হয়তো আমরা চিনব না পুরোটা, তবে দেখব আপদকালের অন্যরূপে, মরণকালের শঙ্কিত সময়ে অনেকে শিশিরসিক্ত ঘাসে পা ডুবিয়ে শীতের সকাল মাখছে চিরকালীন বাঙালিয়ান মননে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫