
ক্ষমতা সবসময় কেন্দ্র অনুবর্তী হয়- এ ব্যাপারে যে যাই বলুন না কেন, প্রকৃতপ্রস্তাবে এ মতের সঙ্গে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। পূর্ব-বাংলার হিসাব-নিকাশের বেলায়ও এবং এখনকার ঢাকাকে মেলাতে গেলেও এই কথাই সত্য বলে গ্রহণ করতে হয়। ঢাকাকে নানাজন নানান প্রত্যয়গত মাপজোকে গ্রহণ করেছেন। সেই হিসেবে অনেকেই ঢাকার বিরিয়ানিরও সুখ্যাতি করতে কসুর করেননি; কিন্তু একটু ভিন্ন হিসেবেই আলোচিত হবে আবদুর রাজ্জাকের ঢাকাবিষয়ক চিন্তা; যার সঙ্গে প্রবলভাবে অর্থনীতি এবং ক্ষমতা-সম্পর্ক জড়িত। আবদুর রাজ্জাক অবশ্য নিছক বিরিয়ানির হিসেবে ঢাকাকে বিবেচনা করেননি; কিংবা মুসলিম শাসনামলের কঙ্কালসার স্থাপত্যের দিকে তাকিয়ে ‘ন্যাকা কান্দনের’ হিসেবেও। তিনি ধরতে পেরেছিলেন ঢাকার ভূমিরেখা ধরে এগিয়ে যাওয়া আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক বিষয় এবং এই বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যান্য বিষয়াদি।
রাজধানী ও ক্ষমতা- ব্যাপারটি একে-অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। রাজধানী হিসেবে নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানা আদতেই ধারণ করে ক্ষমতার নানান সূচক। কেউ কেউ যতই এই ব্যাপারটিকে খারিজ করে দিতে চান না কেন, তা কোনোভাবেই যৌক্তিক বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে না। ঢাকা বিষয়ে আবদুর রাজ্জাক-ই ঔপনিবেশিক এবং উদারবাদী ধারার ইতিহাসের কাউন্টার আলাপের সূচনাকারী; এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ লোকজনের মধ্যেও অন্যতম। আবদুর রাজ্জাক-ই প্রথম দেখিয়েছেন যে, কীভাবে ঢাকা তার ক্ষমতা হারিয়ে নিঃশেষ হতে থেকেছে; আবার বিশ শতকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, এবং নতুন নতুন নানা আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মেইনস্ট্রিমে ফিরে আসতে পেরেছে। হয়ে উঠছে ক্রমেই মেট্রোপলিটনধর্মী নগরে এবং তার ভেতর দিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনই বা কীভাবে এই নগরে উদ্ভব হয়েছে : জন্ম হয়েছে নতুন দেশের, তারপর আরও নানান কিছু।
কেউ কেউ ইংরেজ আমলে, কলকাতার ক্ষমতায়ন এবং কলকাতাকে রাজধানী করা- এই দুটি বিষয়কে উনিশ শতকে ঢাকার পতনের ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখেন; কিন্তু আদতে বিষয়টি এমন সরলরেখায় সীমাবদ্ধ নয়। আবদুর রাজ্জাকের মতে সত্য তো নয়ই। তার মতে ঢাকার পতন এবং ক্ষমতা-নিঃশেষের সূচনা আরও আগে। বিশেষ করে মুসলিম আমলে মুসলমান শাসকদের সুবা বাংলা টিকিয়ে রাখার প্রবল বাসনা থেকেই যেমন রাজধানী ঢাকার উদ্ভব; তেমনি তাদের প্রয়োজনেই আবার রাজধানী ঢাকার পতন; কিন্তু কোনো সচল বিষয়ের হঠাৎ পতন তো একটি মহা বিস্ফোরণের মতো ব্যাপারই বটে। আর এই বিস্ফোরণের প্রভাবও কোনো ছোটখাটো বিষয় নয়। এই পতন-পূর্ব অবস্থায় ক্ষমতা যে সমস্ত সূচকের ওপর নির্ভরশীল থাকে, তা পতন-প্রভাবে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ফলে তার প্রভাবে বলতে গেলে, একটি অঞ্চলের রমরমা আর গমগমা অবস্থা হয়ে পড়ে একেবারেই পরিত্যক্ত। ঢাকার অবস্থাও তেমনই হয়েছিল, মুসলমানরা ঢাকাকে রাজধানী হিসেবে বাতিল করে মুর্শিদাবাদকে রাজধানী হিসেবে গ্রহণ করার ফলে।
কেবল ক্ষমতা নয়, ব্যবসাকেন্দ্রের বদলও ক্ষমতার সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত থাকে। মুসলিম আমল থেকে বলে নয়, প্রাচীন আমলেও নানান কারণে ব্যবসা-কেন্দ্র হিসেবে ঢাকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে মধ্যযুগের হিসেব থেকে শুরু করে ইংরেজ আমলের প্রথম দিকেও ঢাকা ব্যবসার এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমি হিসেবেই বিবেচিত ছিল; কিন্তু অহরহ, এই সময়কালে পূর্ব-বাংলার কেন্দ্র ও নগরীয় ক্ষমতার বদলের ফলে ঢাকা প্রকৃত মেট্রোপলিটনের রূপলাভে ব্যর্থ হয়েছিল। যদিও এই বিষয়টি হওয়ার কথা ছিল না; কিন্তু হয়েছিল কেবল রাজধানীর এই হরদম পরিবর্তনের ফলে, আবদুর রাজ্জাক এমনটিই বলেন, নানান বচসায়। বিশেষ করে নাগরিক মধ্যবিত্তের উদ্ভবের যে ডিলেমা তৈরি হলো- তার পেছনেও বড় ভূমিকা পালন করেছিল এই ক্রমাগত রাজধানীর পরিবর্তন : আবদুর রাজ্জাকের মত এমনটিই। এই হিসেবে ঢাকা যে রাজনৈতিক যুগের হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ নগর ছিল- তার নানান ঐতিহাসিক সূত্র বিদ্যমান।
রাজধানী হিসেবে আঠার শতকেই যে পতন হয়েছিল, তার খেসারত ঢাকাকে দিতে হয়েছিল বহুদিন; এখনো যে হচ্ছে না, তা নয়। রাজধানী হিসেবে ঢাকার এখনো যে ‘আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে গরিব অবস্থা’-তা এই বিষয়কে স্পষ্ট করে। যার সূচনা হয়েছিল মুসলিম শাসনামলে, রাজধানীর ক্রমাগত রদবদল ঢাকাকে একেবারেই আর্থিকভাবে পঙ্গু করে দিয়েছে। আঠারো শতকে মুর্শিদাবাদে রাজধানী বদল হওয়ার পর থেকেই বিষয়টি আরও পেকে ওঠে। আবদুর রাজ্জাক রাজ-অনুবর্তী কিংবা উদারবাদী ঐতিহাসিকদের বিবেচনায় ব্যাপারটিকে দেখেননি। তিনি কেবল ক্ষমতার পালাবদল কিংবা এর সঙ্গে শাসকের পরিবর্তনকেই বিবেচনা করেননি। অন্যান্য বিষয়ও বিশেষভাবে দেখেছিলেন এবং সেই সমস্ত বিষয় উপলব্ধি করেছিলেন; কিন্তু ‘নিজে কিছু লেখেননি’ অভিযোগটি সত্য হলেও, অন্যের ভেতরে নিজের চিন্তা সংক্রমিত করতে পেরেছিলেন। বিশেষ উদাহরণ হিসেবে বাংলায় মুসলিম কমিউনিটির চেতনা-জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বজায় রেখে বাংলা সাহিত্যে মুসলিম লেখকরা কীভাবে লেখাজোখা তৈরি করেছিলেন- সে বিষয়ে বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ থিসিসটি করেছেন আনিসুজ্জামান। সেইখানেও তো আবদুর রাজ্জাকের প্রভাব ও ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আনিসুজ্জামানের কৃতজ্ঞতা-জ্ঞাপন তাই নির্দেশ করে।
এসব কথা রাখি। আসল যে কথা, তা হলো রাজধানীর রদবদলের সঙ্গে কেবল শাসকগোষ্ঠীরই চলে যাওয়া নয়, সঙ্গে সঙ্গে পোষ্যশ্রেণি হিসেবে এই শাসকদের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি বড় শ্রেণিরও লোকান্তর ঘটে এই প্রক্রিয়ায়। ফলে চলে যাওয়া মানে প্রস্থানই বটে। প্রস্থান নানান বিষয়ের। আবদুর রাজ্জাকের মতে রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরের ফলে নাগরিকদের বসবাসের সংখ্যাগত পরিমাণও ক্রমাগত কমতে থাকে। কর আদায় থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসনিক ও ক্ষমতাগতভাবে ফাঁক-নির্মাণ, সবদিক থেকেই কর্তৃত্ব হারায় ঢাকা। ঢাকা আবার হয়ে পড়ে ম্রিয়মাণ- বহু আগে যেমন ছিল; কিন্তু মাঝখানের কিছু সময়ের ঢাকা বিশেষ হয়েছিল এক্ষেত্রে। যদি ‘বিশেষ হওয়াটি’ ঢাকা টিকে যেত, তাহলে বেশ ভালোই হতো; কিন্তু তা হয়নি।
এরই ফলে ঢাকায় সহজেই নাগরিক মধ্যবিত্তের উদ্ভবটি সম্ভব হয়নি; যেটি একটি রূপলাভ করেছিল ষাটের দশকেই, বলতে গেলে পরিপূর্ণভাবে। কারণ এই যে, কলকাতা যেখানে নগরীয় বা মেট্রাপলিটন বৈশিষ্ট্য-প্রাপ্তিতে যে সমস্ত অনুঘটক-বিষয় পেয়েছিল, তা ঢাকা চটজলদি পায়নি, লেগেছিল বহু সময়। ঢাকার তা পাওয়ার কোনো কারণ ও সম্ভাবনাও সঙ্গত কারণে ছিল না। কারণ মধ্যযুগে মুসলিম শাসনামল থেকেই পূর্ব-বাংলা হিন্টারল্যান্ডের যে তকমা অর্জন করেছিল- সেই তকমা ব্রিটিশ পিরিয়ডে আরও দীর্ঘ হয়েছিল। একভাবে বিষয়টি হয়েছিল স্থায়ী।
পূর্ব-বাংলাকে ঘিরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ কিংবা রেল-ব্যবস্থার মতো যেসব দৃশ্যমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে- তা একেবারেই ঔপনিবেশিক ও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ভিন্ন কিছু নয়। কারণ হিন্টারল্যান্ডের কাঁচামাল কেন্দ্রে পৌঁছানোর তো দরকার পড়বে; দরকার পড়বে একান্তই উৎপাদন, বণ্টন ও বিপণনকে সামনে রেখে। তবে কেবল দ্রব্যের উৎপাদন, বণ্টন কিংবা কাঁচামালের জোগানদাতা হলেই যে কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল নগরীয় কর্মকাণ্ডের মধ্যে স্থিত হতে পারে- ব্যাপারটি তেমন নয়। এর জন্য শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েরও দরকার পড়ে; কিন্তু তার টিকির নাগাল ঢাকা পায়নি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত। ফলে মেট্রোপলিটনের কোনো রূপ পাওয়া ঢাকার সম্ভব ছিল না; কিন্তু দ্রব্যের উৎপাদন, বণ্টন কিংবা কাঁচামালের জোগানদাতা- এই তিন হিসেবেই তা পাওয়ার যোগ্যতা ঢাকার ছিল; কিন্তু অন্যান্য বিষয়-বিবেচনা আপাতদৃষ্টিতে খাটো হলেও প্রকৃতপ্রস্তাবে ছিল গুরুত্বপূর্ণ শর্ত, মেট্রোপলিটনের স্বরূপ অর্জনে। এমনই এক পর্যায়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আবদুর রাজ্জাক। তিনি এর কারণটি খুঁজেছিলেন এবং পরবর্তী ধারার অবস্থা সম্পর্কেও নিজ চিন্তাকে সুদৃঢ় করেছিলেন। সেই চিন্তা-উপলব্ধিকে নানাভাবে যেমন জারি রাখতে পেরেছিলেন, তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিক কমিউনিটিতে পৌঁছাতেও সমর্থ হয়েছিলেন।
তবে ঢাকার এই আলাদা থাকাও যেন ‘শাপে বর হয়েছে’। বিশেষ করে শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পার্থক্য হুমায়ুন কবির তার বাঙলার কাব্যে আলোচনা করেছিলেন এই হিন্টারল্যান্ডের প্রেক্ষাপটে। এখানে হুমায়ুন কবির কেবল সাহিত্যের উদ্ভবের পেছনে পূর্ব-বাংলার নানান বিষয় বিবেচনায় এনেছেন; কিন্তু এক্ষেত্রে অন্যান্য বিষয়-বিবেচনায়ও গুরুত্বপূর্ণ। যেটি আবদুর রাজ্জাকের চিন্তায় ছিল। অর্থাৎ সমাজ এগিয়ে যাওয়ার হিসেবে এই বিষয়ে আবদ্ধ থাকাও যৌক্তিক নয়। কারণ হুমায়ুন কবির যে বিষয়াদি আলোচনা করেছেন, সেই বিষয়ের মধ্যে এখনো যদি পূর্ব-বাংলা আবদ্ধ থাকত তবে কি খুব লাভ হতো? হতো না। এ বিষয় নিশ্চিত করেই বলা যায়। এই বিষয়েও আবদুর রাজ্জাক এগিয়ে ছিলেন। কারণ তিনি সমাজ-প্রগতির হিসেবকে কেবল একটি আবর্তেই ঘূর্ণনশীল বিষয় হিসেবে মানতে নারাজ। তিনি ক্রমাগত- তা যেভাবেই হোক, পরিবর্তনকে সমর্থন করেছেন।
বিশেষ করে মুসলিম কমিউনিটির কেন্দ্র কলকাতা থেকে দূরে অবস্থানের বিষয়- যা মুসলিমদের মানসিক অবস্থা এবং নন কো-অপারেশনের মতো বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। থিসিস হিসেবেও যা শক্তিমান এবং বহুল প্রচলিত; কিন্তু এই বিষয় মানতে নারাজ আবদুর রাজ্জাক। তিনি পরিসংখ্যান প্রদানে জানাচ্ছেন ১৮৩৫ সালে রাজভাষা হিসেবে ইংরেজি প্রবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত মুসলিমরাও ইংরেজ ক্ষমতাকাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত ছিল। অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ন্যাটিভ পদেই ছিল মুসলিমরা। তাছাড়া অন্যান্য বেসরকারি পেশায়ও বড় ভূমিকা ও অংশগ্রহণ ছিল মুসলমানদের; কিন্তু রাজভাষার বদলেই সমস্যাটি গুরুতর হয়ে ওঠে। দীর্ঘদিন আরবি-ফারসির চর্চার ফলে যে শিক্ষগত অর্জন মুসলিমদের ছিল, তা দিয়ে আর কাজ ঠিকঠাক চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছিল না। ততদিনে এই অর্জনটি চলে গেছে হিন্দু কমিউনিটির হাতে। কারণ তারা ভাষা-অভিজ্ঞতাও অর্জন ততদিনে করে ফেলেছে। তারা তা কাজে লাগিয়েছিল ১৮৩৫ এর পরে। মুসলিমদের মধ্যে কিছু গোঁড়ামি ছিল না- বিষয়টি তেমনও নয়। ফলে পরবর্তীতে নতুন করে রাজভাষার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে মুসলিম কমিউনিটির বেশ বেগ যেমন পেতে হয়েছিল, তেমনি সময় তো লেগেছিলই। আর কেন্দ্র কলকাতা থেকে দূরবর্তী অবস্থানে থাকা পূর্ব-বাংলার জন্য বিষয়টি আরও কঠিন ছিল। ফলে পেরে যে উঠবে না, এটিই স্বাভাবিক। ফলে পূর্ব-বাংলার লোকজন আগেই পিছিয়ে ছিল, ১৮৩৫ পরবর্তী সময়ে আরও পিছিয়ে পড়ল। সমস্যাটি আরও বেগবান হয় ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের দ্বারা; কিন্তু এই অবস্থা বদলেছে একটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের বদৌলতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার নাম।
নগর, নগরীয় কর্মকা-, নাগরিকতা এবং নতুন নাগরিক সমাজের প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি পূর্ব-বাংলায় পুরা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরপরই। ইউরোপের মাল-মসলায় কলকাতায় সংঘটিত হয়েছিল একটি মেকি রেনেসাঁ। তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরে, ঢাকায় সংঘটিত হয়েছিল পূর্ব-বাংলার মুসলিম কমিউনিটির রেনেসাঁ, কলকাতার রেনেসাঁর আদলে, শিখা-গোষ্ঠীর উদ্যোগে। এই রেনেসাঁর মূল্য নেই বললেই একটি সমস্যা হয়, বর্তমান ঢাকার যে প্রতিষ্ঠা তার পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছে এই গোষ্ঠী- তা অস্বীকার করা। তাই এই গোষ্ঠীকে খারিজ করে দেওয়া মানে ঢাকার বর্তমান অবস্থানকেও খারিজ করে দেওয়া, খারিজ করে দেওয়া আরও নানান বিষয়।
শিখা গোষ্ঠীর এই বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবান্দোলন যখন ঢাকায় দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে, তখন আবদুর রাজ্জাক নিছকই বালক; কিন্তু এই আন্দোলনের এক্সটেনশন নির্মাণে পরবর্তীতে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের অন্যতম গুরু ছিলেন আবদুর রাজ্জাক, ঢাকার জ্ঞান-চর্চা-জগতে। তবে এর কেন্দ্রে ছিল তার ঢাকা। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এই যে, এক জীবনে ঢাকাকে কেন্দ্র করে তিনটি যুগে সংঘটিত নানান ঘটনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাক্ষী আবদুর রাজ্জাক। সেই ঘটনাগুলোর অভিজ্ঞতা নিজ উপলব্ধিতে যতটা এবং যেভাবে বুঝতে পেরেছিলেন আবদুর রাজ্জাক, তা তিনি বিভিন্নজনের কাছে বর্ণনা করে গেছেন। বিভিন্নজনকে তা লেখার তাগিদ দিয়েছেন। তারা তা লিখেছেন এবং ঋণ স্বীকার করেছেন। যার ফলেই তার চিন্তা খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়।
তিনি এক হিসাবে মফস্বল ধাঁচের ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন- যা ছিল ব্রিটিশ ভারতের এক গুরুত্বহীন প্রান্তিক অঞ্চল। আর নিজ জীবনের একটি অংশ অতিবাহিত করেছিলেন পাকিস্তানের নয়া-ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে। দেখে গিয়েছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং এই আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে। আর মৃত্যুর আগ অবধি বাংলাদেশে, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের নানান আলোড়নগুলো প্রত্যক্ষ করেছিলেন তিনি। এই সময়কালে তিনি নিজ বিদ্যা-বুদ্ধিতে যা উপলব্ধি করেছিলেন, সেই সমস্ত বিষয়ে তিনি কথা বলেছিলেন- নানান সাক্ষাৎকারে, আড্ডায়; অনেককে পরামর্শদানকালে। হয়তো বা তার পরিমাণ নিতান্তই কম; কিন্তু গুরুত্বের দিক থেকে বিশেষ। আবদুর রাজ্জাকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা- সবই এই ঢাকাকে কেন্দ্র করে। তার চিন্তা ও উপলব্ধির একটি নির্দিষ্ট অংশও নির্মিত হয়েছে এই ঢাকাকে কেন্দ্র করে। ঢাকা নিয়ে তার চিন্তা যেমন স্বতন্ত্র; তেমনি তার চিন্তার ওপর ঢাকাকেন্দ্রিক নানান প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ। এক স্বতন্ত্র মফস্বল, তারপর এর ক্রমাগত মেট্রোপলিটন-বৈশিষ্ট্য অর্জন, এবং শেষমেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানী হয়ে ওঠার যে প্রক্রিয়া- তা তিনি গভীর প্রাজ্ঞতায় অনুভব ও উপলব্ধি করেছিলেন যেমন, তেমনি তা দ্বারাও তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। ফলে ঢাকাকে বাদ দিয়ে আবদুর রাজ্জাকের চিন্তা-জগৎ কল্পনা করা যাবে না। আবার ঢাকা সম্পর্কে আবদুর রাজ্জাকের টুকরো টুকরো চিন্তাও নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ- কারণ তার ঢাকাবিষয়ক চিন্তা বাদে বর্তমান ঢাকাকে ঠিকঠাক পাঠ সম্ভব নয়। কারণ তার ঢাকাবিষয়ক টুকরো টুকরো চিন্তাই দীর্ঘদিন গুরুত্বপূর্ণ থিসিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে- ঢাকাকেন্দ্রিক ও ঢাকাবিষয়ক জ্ঞান-চর্চায়।