Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী

স্বদেশ প্রেমের আদর্শ মানুষ

Icon

মাহফুজ রহমান

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০১৯, ১৮:২২

স্বদেশ প্রেমের আদর্শ মানুষ

মওলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী।

মওলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী ছিলেন- একাধারে শিক্ষক, সাংবাদিক, সংগঠক, বিপ্লবী, সমাজ সংস্কারক ও লেখক। ১৮৭৫ সালের ২২ আগস্ট মাসে তিনি চট্টগ্রামের চন্দনাইশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মুনশী মতিউল্লা ছিলেন আরবি-ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত। তিনি তাঁর পিতার কাছেই পারিবারিক পরিমণ্ডলে শিখে নেন প্রাথমিক শিক্ষা। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতা যান, ১৮৯৫ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি সরকারি মাদ্রাসা থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। আরবি আর ফারসি ভাষায় তিনি জ্ঞান অর্জন করলেও বাংলা ভাষার প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ মমতা। এ ভাষার প্রতি বিশেষ ভালোবাসা থাকার কারণেই তিনি- বাংলা ভাষা শেখেন নিজের ইচ্ছায়, নিজের মনের সমস্ত কথাগুলো বলার প্রবল তাড়নায়। যে সময়ে আরবি-ফারসিই ছিল এ বাংলার ধর্মীয় জ্ঞানচর্চার একমাত্র মাধ্যম, তখন তিনি বাংলা শেখেন আর লেখার প্রথম ভাষা হিসেবেই তিনি বেছে নেন এই বাংলা ভাষাকে। 

শিক্ষাজীবনের সমাপ্তির পর তিনি কর্মজীবনে যুক্ত হন। অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নেন রংপুর হারাগাছ সিনিয়র মাদ্রাসার। এরপর যোগ দেন সীতাকুণ্ডের সিনিয়র মাদ্রাসার অধ্যক্ষ রূপে। এই সময় থেকেই শুরু হয় তাঁর লেখালেখির জীবন। শুরুতেই চট্টগ্রামে প্রকাশ করেন পত্রিকা ‘মাসিক ইসলামাবাদ’। প্রাচীন চট্টগ্রামের নাম এছলামাবাদের অনুসারে নামের শেষে ‘এছলামাবাদী’ শব্দ গ্রহণ করেন। তিনি লেখার প্রতি মনোনিবেশ করেন, সমাজের মানুষের মাঝে তাঁর চিন্তা প্রকাশের জন্য তিনি নিয়মিত লেখার প্রতি মনোযোগী হয়ে ওঠেন। কেবলমাত্র লেখা নয়, সাংবাদিকতার সঙ্গেও যুক্ত হন তিনি। সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত পত্র-পত্রিকায় তিনি লিখতেন। মওলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী লেখালেখি ও সাংবাদিকতার সূত্রে সে সময়ে- সোলতান (১৯০১), হাবলুল মতিন (১৯১২), মুহাম্মদী (১৯০৩), কোহিনূর (১৯১১), বাসনা (১৯০৪) ও আল-এসলাম (১৯১৩) পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বাংলা, আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষায় লেখালেখি করতেন। এ ছাড়া মিসর থেকে প্রকাশিত আল মিনার, আল-আহরাম, আল-বিলাদেও তার লেখা প্রকাশিত হয়। তিনি ফারসি দৈনিক পত্রিকা হাবলুল মতিনের বাংলা সংস্করণ সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীকে নিয়ে কলকাতা থেকে সাপ্তাহিক সোলতান পত্রিকাও প্রকাশ করেন তিনি। তিনি স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মুসলিম জাগরণের কাজ করেন। অন্যদিকে নওয়াব আদুল লতিফের মতো ব্যক্তিত্বের আদর্শে শিক্ষা বিস্তারেও ব্রতী হন। সে সময় বাংলা-আসামে বিভিন্ন স্কুল, মাদ্রাসা স্থাপনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। জামাল উদ্দিন আফগানির ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধেও প্রভাবিত হন। তিনি ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের বঙ্গীয় প্রাদেশিক শাখার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম কনফারেন্সের আয়োজন করেন। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ‘মুসলিম সাহিত্য সমিতি’ প্রতিষ্ঠায়ও অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে মওলানা এছলামাবাদী ও অন্য বিখ্যাত ব্যক্তিদের প্রচেষ্টায় আঞ্জুমানে উলামায়ে বাংলা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। 

মওলানা মনিরুজ্জামান রাজনৈতিকভাবে প্রথম দিকে কংগ্রেসে সম্পৃক্ত থাকলেও ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে খেলাফত আন্দোলনে যুক্ত হন। তিনি ১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাক্টের অন্যতম স্থপতিও। ১৯২৯ সালে মাদ্রাসা ছাত্রদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত আসাম-বেঙ্গল জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান সম্পাদক ছিলেন মওলানা মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে কৃষক প্রজা পার্টির মনোনয়নে বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য মওলানা এছলামাবাদী মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে দিল্লির লাল কেল্লায় বন্দি ছিলেন। তিনি ব্রিটিশমুক্ত দেশ চাইতেন, যে কোনো মূল্যে স্বদেশের স্বাধীনতা অর্জনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। এ কারণে পরে কংগ্রেসের ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করেন। দেশের আজাদীর জন্য সশস্ত্র সংগ্রামেরও পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নেতাজী সুভাষ বসুর নেতৃত্বে যখন আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠিত হয় তখন তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করেও সে ফৌজকে সম্ভাব্য সর্বপ্রকার সাহায্য করেছিলেন। তিনি চট্টগ্রামের সীতাকু- এলাকায় বিপুল পরিমাণ জায়গা জমি নিয়ে বৃটিশ খেদাও আন্দোলনের একটি গোপন দুর্গ তৈরি করেন। এখানে স্থাপিত হয়েছিল একটি খামার বাড়ি। এ বাড়ি থেকেই তিনি নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতা ও কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং তাঁদেরকে আর্থিক সাহায্য করতেন। স্বয়ং নেতাজী সুভাষ চন্দ্রেরও এ খামার বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। আরেকটি ঘাঁটি স্থাপনের উদ্দেশ্যে কিছু আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতায় কক্সবাজারের চকরিয়া থানার বদরখালী মৌজায় সমুদ্র সংলগ্ন অঞ্চলে তিনি আরেকটি খামার স্থাপন করেছিলেন। এ খামার স্থাপনের মাধ্যমে তিনি চেয়েছিলেন স্বল্প সময়ে যোগাযোগ রক্ষা এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু ব্রিটিশ গুপ্তচরেরা তখন মওলানাকে গ্রেফতার করে লাল কেল্লায় নিয়ে অত্যাচার করে। সে সময়ে তাঁর বয়স ছিল ৬৫ বছর। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে তিনি বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো সমর্থন ব্যক্ত করেন, যা পরবর্তী সময়ে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারীদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়েছিল।

লেখক হিসেবে মওলানা এছলামাবাদী একজন ইসলামি জাগরণের প্রাথমিক সময়ের অগ্রপথিক। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ হলো- ভারতে মুসলিম সভ্যতা, সমাজ সংস্কার, ভূগোল শাস্ত্রে মুসলমান, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমানদের অবদান প্রভৃতি। মহান এই স্বদেশপ্রেমী রাজনৈতিক, লেখক, সাংবাদিক এ সময়ের আদর্শ এক প্রাণ। তিনি ১৯৫০ সালের ২৪ অক্টোবর চিরবিদায় নেন পৃথিবী থেকে। তাঁর কর্মমুখর জীবন ও সংগ্রামী দিনগুলো সময়ের সচেতন মানুষদের প্রেরণা হয়ে রবে।


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫