‘রাম বড় সুবোধ।... রাম কখনও কোনও মন্দ কর্ম করে না।‘ বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ে এভাবেই লেখা। তা-ই যদি হবে, রাম ‘ছাগল’ হলো কবে থেকে? ভারতীয় উপমহাদেশে রামের যশোগাথার শেষ নেই। রামের মতো মানুষ-ই হয় না; রাম মানুষ নন- অবতার। রামকে নিয়েই রামায়ণ। রামের মতো পুত্র, ভ্রাতা, স্বামী ও রাজার তুলনা মেলা ভার। রামের নামেই কল্পিত হয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের রামরাজ্য।
রামায়ণের রাম তো আছেনই, আরও আছেন রামমোহন, রামকৃষ্ণ। অথচ রাম-নামের সঙ্গে ছাগল জুড়ে দিয়ে হলো কিনা রাম ছাগল! নিঃসন্দেহে ভাববার বিষয়। ঘটনাটা কী? তার আগে বলা ভালো রাম-নাম-সংশ্লিষ্ট ওপরের মহৎ জনদের সঙ্গে দীর্ঘকর্ণ ও দীর্ঘশৃঙ্গযুক্ত ওই ছাগ-বৎসের কোনো ধরনের কোনো সম্পর্ক নেই।
সংস্কৃত রম থেকে রাম; একই উৎস থেকে রমণ, রমণী, রমণীমোহন, রমণীয়, রমা, রম্য। সৌন্দর্য, যৌনতা ও হাস্যরস মিলেমিশে একাকার। রামের একটি অর্থ সুন্দর, মনোহর; আরও কিছু অর্থ- বড়, সেরা, শ্রেষ্ঠ। তাহলে রামছাগল বলতে কী বুঝব? সুন্দর ছাগল? শ্রেষ্ঠ ছাগল? রমণীয় ছাগল? অভিধানের কান মোচড়ানি খেয়ে বলতে পারি, রামছাগলের সরল অর্থ বৃহৎ আকৃতির ছাগল। এই দিক থেকে ‘বড়’ অর্থে রামদা, রামগরুড় আর রামধনু একই কাতারের।
তবে রামছাগল বলতে আমরা কেবলই বড় আকারের ছাগজাতীয় প্রাণীকেই বুঝি না, বৃহৎ, ক্ষুদ্র, মাঝারি- বিবিধ প্রকৃতির মনুষ্যকেও বুঝে থাকি; কিন্তু সেই মনুষ্যকে অবশ্যই বহুলাংশে বোকারাম বা হাঁদারাম অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ বোকা হতে হবে। এই শর্ত পূরণ করতে সক্ষম প্রতিটি ব্যক্তি আলংকারিকভাবে রামছাগল বলে গণ্য হতে পারেন।
তবে কেউ কেউ রামছাগলের কাজ কেবল ছাগল দিয়েই সেরে নেন। যেমন : ছাগল কোথাকার! ছাগলামি করার জায়গা পাস নাই! যদিও এই কথাও প্রচলিত আছে : ছাগল দিয়ে হাল বাওয়ালে কাজ ঠিক মত হয় না। বলদের কাজ ছাগল দিয়ে করালে হবে না। ছাগল হাল বয়ে নিয়ে যেতে কিংবা চাষাবাদ করতে সক্ষম নয়- এমন একটি ইঙ্গিত আছে। সামগ্রিকভাবে ছাগল ব্যর্থতা, বোকামির মূর্ত প্রতীক। বলদ না হয় হাল টেনে ছাগলের চেয়ে উচ্চাসনে উঠে গেল। তাছাড়া বলদের একটি বলদৃপ্ত নাম আছে : বলীবর্দ। ছাগলের তো তাও নেই। ভাবছি, গাধার সব দায়িত্ব যদি ছাগলই পালন করে থাকে? তাহলে গাধার কাজ কী? এ বিষয়ে গাধার কী মত?
ছাগলের ওপর এত অত্যাচার সত্ত্বেও বলে রাখি, ছাগল কিন্তু অতি অভিজাত ভাষার একটি শব্দ। ভাষাটির নাম সংস্কৃত। সংস্কৃতে ছাগলক, ছাগ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হত। যেমন : ছাগের মতো মুখ- ছাগমুখ; ছাগ যার বাহন- ছাগবাহন; ছাগের মতো মুণ্ডু ছাগমুণ্ডু; ছাগের ছানা- ছাগশিশু; নপুংশক ছাগলের চর্বিজাত ঘি- ছাগলাদ্যঘৃত। ছাগলের আরেক নাম অজ; অজ বা ছাগলের মতো মূর্খ যে, তাকে সংস্কৃতে বলা হয় অজমূর্খ। এ শব্দের ব্যবহার অনেকেই লিখিত ও মৌখিকভাবে করে থাকেন। অজর মতো প্রাণি গিলে ফেলতে পারে বলেই কি অজগরের নাম অজগর? ছাগলের এমনই কপাল, স্কুলপাঠ্য বইয়ে লেখা হল : অ-তে অজ। অজ আসে। অ-তে অলি। অলি হাসে। পড়ানো শেষে শিক্ষক বললেন, অ-তে কী? ছাগল। শিক্ষক যতোই বলেন, অ-তে অজ। নধর বাচ্চাগুলো ততোই বলে, অ-তে ছাগল।
প্রশ্ন হলো ছাগলামি বিষয়টা কী? সহজ করে তো এটাই বুঝি, ছাগল যা করে, তা-ই ছাগলামি। ঘাস-পাতা খায় আর ম্যা ম্যা করে। সমস্যা কোথায়? তবু কথায় কথায় আমরা বলে বসি, ছাগল একটা! আস্ত রামছাগল! রাম ও ছাগলের সহাবস্থানে আলংকারিক রামছাগল তৈরি হবার কারণ সম্ভবত ছাগলের অতিশয় সারল্য। তবে সাবধান, সারল্য দেখেই কাউকে রামছাগল ডেকে হাঁক দেবেন না। নির্ঘাত শিং উঁচিয়ে তেড়ে আসবে।