ঝিরিঝিরি বাতাস, সুনসান পথ, নিয়ন আলোর কপটতা ঢেকে মাথার ওপর পূর্ণিমা রাতে মস্ত চাঁদের আলোয় ঝকঝক করা পথঘাট, দু’পাশের ঘরবাড়ি, ক্ষেত, মাঠ, গাছপালা। আর রিকশায় চালকের পেছনে বসে গন্তব্যহীন ধীর মন্থরগতিতে চলতে চলতে গান গাইবার বাসনা হয়নি এমন বাঙালি কমই আছে। বাঙালি জীবনের ছোট ছোট সুখের অনেকটাই ধরা পড়েছে এই রিকশায় বসে বসে। কত প্রেম জন্ম নিয়েছে, কত প্রেমিক-প্রেমিকার বিরহবেলা কেটেছে, কত নবদম্পতি নতুন সংসারের স্বপ্ন বুনেছে, কত শিক্ষার্থী রিকশায় বসে বসে বই পড়তে পড়তে পরীক্ষার হলে ঢুকেছে।
কত কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী কথায়, কাব্যে, চিত্রকলার পট এঁকে নিয়েছেন মনে মনে। আর তাই রিকশাময় বাঙালি জীবন বললে ভুল হবে না। রিকশা নিয়ে গল্প করার বাসনা মনে আসতেই চোখে ধরা পড়ল দোমিনিক লাপিয়েরের ‘সিটি অব জয়’ বইটির হাঁসারির কথা। তখন ভারতজুড়ে বইছে আধুনিকত্বের প্রবল হাওয়া। প্রান্তিক মানুষের জীবিকা যাচ্ছে বদলে। মাটি দিয়ে দৈনন্দিন জীবনের তৈজসপত্র গড়েন যে কুমোর প্লাস্টিক সামগ্রী এসে তার জীবনে বইতে থাকে দৈন্যের হাওয়া। এমনি আরও কত জীবিকার পাট তুলে সহায় সম্বল মহাজনের হাতে তুলে দিয়ে হত-দরিদ্র মানুষদের পাড়ি জমাতে হয় শহরে একটু বাঁচার আশায়। ঠাঁই হয় আঁস্তাকুড়ে। হাঁসারিও ছুটে এসেছিল কলকাতা শহরে। শহর তার বুকে দিয়েছিল কষ্টাঘাত, বাঁচার তাড়না হাতে তুলে দিয়েছিল একটি রিকশা। হ্যাঁ, রিকশা। তবে সেই রিকশা আজকের এই রিকশার মতো ছিল না। কেমন ছিল তবে হাঁসারির সেই রিকশা? হাঁসারির সেই রিকশার কথা বলার আগে আরেকটু পেছন থেকে বলা যাক- রিকশার ইতিকথা।
রিকশার গল্প
ইতিহাস মতে রিকশার জন্ম জাপানে ১৮৬৯ সালে। সিমলার মার্কিন মিশনারি জোনাথন স্কোবি এটি উদ্ভাবন করেন। রিকশা শব্দটিও বাংলায় এসেছে জাপানি শব্দ জিনরিকিশা থেকে, যার বুৎপত্তি করলে অর্থ দাঁড়ায় জিন = মানুষ, রিকি= শক্তি, শা= বাহন। অর্থাৎ মানে হলো মানুষবাহিত বাহন। এই মানববাহিত বাহন রিকশার নাম মনে এলেই কিন্তু একটা ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেটা হলো তিনটি চাকা, প্যাডেল, মাথার ওপর একটি গোলাকার হুড যাকে চাইলে তুলে দেওয়া যেতে পারে, নয়তো খুলে বা নামিয়ে রাখা যেতে পারে এবং দুটি সিট একটি বাহকের অন্যটি আরোহীর। কিন্তু জাপানে জন্ম নেওয়া এই রিকশার অবয়ব ঠিক এখনকার মতো ছিল না। সেগুলোর ছিল দুটি চাকা, আরোহীর সিটটা বেশ খানিকটা উঁচু তাতে উঠে বসার জন্য নিচু করে নামিয়ে রাখা হয়। আর চালক বা বাহক পায়ে হেঁটে হেঁটে টেনে টেনে আরোহীর গন্ত্যব্যে পৌঁছে দিত।
হ্যাঁ, ঠিক এই রকম রিকশারই সিটি অব জয়ের অন্যতম চরিত্র হাঁসারিকে রোজ টানতে হতো দুর্বল, ক্লিষ্ট, রোগাসোগা- অনাহারী হাঁসারিকে। রূঢ় বাস্তবতা একদিন কেড়ে নিয়েছিল হাঁসারির জীবন। সাদা থান পরিয়ে দিয়েছিল সরলা বউ অলকাকে। থাকুক পড়ে হাঁসারি তার বউ অলকা রূঢ় বাস্তবতার অপরপাড়ে। দোমিনিক লাপিয়ের নিজেই এই জীবনালেখ্যকে নামকরণ করেছেন- সিটি অব জয়। তো আমরা বাঁক বদল করি। সিটি অব জয় তথা আমাদের আনন্দনগরীতে বাঙালি জীবনে রিকশার আদ্যোপান্ত গল্পটা আরও একটু বাড়িয়ে নিই এবারে।
ইতিহাস বলছে ১৯০০ সালে কলকাতায় হাতে টানা রিকশা চালু হয় তবে তা মানুষ বহনের জন্য না মালপত্র বহনের জন্য। ১৯১৪ সালে এসে কলকাতা পৌরসভা রিকশায় যাত্রী বহনের অনুমতি প্রদান করে। এই সময়ের মধ্যে মিয়ানমারের রেঙ্গুনে রিকশা বেশ জনপ্রিয় বাহনে পরিণত হয়। এই রিকশা ১৯১৯ সালে রেঙ্গুন থেকে প্রথম আসে চট্টগ্রামে। ঢাকায় যে রিকশা আসে সেটা নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহের ইউরোপীয় পাট ব্যবসায়ীরা তাদের নিজস্ব কাজে ব্যবহারের জন্য নিয়ে আসেন কলকাতা থেকে। রিকশার বহুল ব্যবহার এবং নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী কাঠামোর কারণে ঢাকাকে বিশ্বের রিকশার রাজধানী বলা হয়। রিকশা নিয়ে যা কিছু গবেষণা হয়েছে তার মধ্যে প্রকৌশলী বোরহান রিকশার জন্য কিছু সুবিধাজনক সরঞ্জাম উদ্ভাবন করেছেন। তার মধ্যে শক অ্যাবজবিং বাম্পার, যা পেছন থেকে পাওয়া ধাক্কাকে হজম করে যাত্রীকে নিরাপদ রাখে এবং হুইল ক্যাপ যা পাশাপাশি দুটি চলমান রিকশাকে নিরাপদ রাখে এবং কাছাকাছি আসা যাত্রীকে রাখে বিপদমুক্ত। দেশ ভেদে রিকশার আকার-গঠনশৈলীর রয়েছে ভিন্নতা। ভিন্নতা রয়েছে নামেও। যেমন চিনে রিকশাকে- সানলুঞ্চে, কম্বোডিয়ায়- সিক্লো, মালয়েশিয়ায়- বেকো, ফ্রান্সে- স্লাইকো বলে ডাকা হয়। ইরোপের বিভিন্ন দেশে একে পেডিক্যাব বলেও ডাকা হয়ে থাকে।
রিকশা চিত্র
রিকশা চিত্র কবে কোথায় কে শুরু করেছিলেন জানা যায় না। ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের একটি চিত্র বলে ধরা হলেও বিভাজন হয়নি রিকশা চিত্র বা পেইন্টিং আসলে কোন ঘরানার চিত্রকর্ম? রিকশার গায়ের উজ্জ্বল রঙে আঁকা এইসব চিত্রকে জোয়ানা কার্কপ্যাট্রিক তার ‘বাংলাদেশি আর্টস অব দ্য রিকশা’ প্রবন্ধে গণমানুষের চিত্র বলে উল্লেখ করেছেন। অভিজাত শিল্পে রিকশা আর্ট নেই। লোকশিল্পেও এর শেকড় মেলেনি। তবে কীভাবে এলো রিকশা চিত্র?
৬০-৭০-এর দশক হলো রিকশা আর্টের স্বর্ণযুগ। এর জনপ্রীতি তখন তুঙ্গে ঠিক সেই সময়কে সিনেমার উত্তমকাল বললেও ভুল হবে না। শিল্পীরা তখন রিকশার গায়ে আঁকার উপজীব্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সেইসব জনপ্রিয় সিনেমার সাধারণ মানুষের প্রিয় নায়ক নায়িকা যেমন- কবরী, ববিতা, রাজ্জাক, উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেনের ছবি এবং ডায়ালগ। রিকশার গায়ে লাল, নীল, হলুদ, সবুজের ঝলমলে উজ্জ্বল রঙে আঁকা নায়ক-নায়িকাদের ছবি ভিন্নমাত্রা পেতো শিল্পীদের হাতের তুলির ছোঁয়ায়। সেইসব রিকশা চিত্র জোগাত আনন্দের খোরাক। এক একটা রিকশা সওয়ারী নিয়ে পথ চলতে দেখে মনে হতো, যেন এক একটি জীবন্ত গল্প চোখের সামনে দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে মিলিয়ে যাচ্ছে সুদূরে। রিকশার পেছন পেছন ছুটতো শিশুদের দল, তাকিয়ে থাকত ঘোমটা মাথায় মেয়ে-বউ, পুরুষরা। তৎকালীন সিনেমার বিজ্ঞাপনের সঙ্গে রিকশাচিত্রের বেশ মিল রয়েছে। এই যে এক ধরনের সাদৃশ্য এর কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া যায় চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপন যেসব শিল্পীরা আঁকতেন তারাই হয়তো রিকশা চিত্রও আঁকতেন।
রিকশায় সিনেমার চিত্রের বাইরেও শিল্পীরা আঁকতেন- তাজমহল, গাছপালা, গ্রাম বাংলার, নদী, বাড়ি-ঘর, মোরগ, গাভী চরে বেড়ানোর দৃশ্য, কোরআন শরীফ হাতে ছোট্ট শিশু, মোনাজাতরত মা, মসজিদ, আলিফ লায়লা, আরব্য রজনী- পারস্য রজনীর গল্প, পঙ্খীরাজ ঘোড়া। এইসব শিল্পীরা সমসাময়িক বিষয় আঁকতেন, তাদের আঁকায় রিকশার গায়ে অস্ত্র হাতে মুক্তিযোদ্ধা, পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ, স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনারের চিত্রপটও দেখা গিয়েছে। কিংবা সাম্প্রতিক সময়ের উড়োজাহাজ, দুবাই নগর, বারাক ওবামা এবং তার পরিবারও জায়গা করে নিয়েছে এসব চিত্রে। রিকশার গায়ের সমস্ত চিত্র নিয়েই এই রিকশা চিত্র। রিকশার পেছনের টিনের পাতে, দুই পাশের ফলক, খাঁজকাটা কারুকার্যময় হুড, প্লাস্টিক ও কাগজ দিয়ে সাজানো পিতলের ফুলদানি সবই তার অন্তর্ভুক্ত। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে রিকশা আর্টে মানুষের ছবি আঁকার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলে শিল্পীরা তখন ভিন্ন পন্থায় ছবি আঁকতেন। তারা তখন মানুষের বদলে প্রাণীর ছবি আঁকতেন। শেয়াল, বানর, বাঘ, হাতি, মোরগ এরা পিকনিক করছে, রান্নাবান্না করছে ঠিক যেমন মানুষ করে থাকে। সেই ফর্মটাও ছিল বেশ মজার। পরে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে আবার আগের ফর্মেই ফিরে যান শিল্পীরা।
কত কবি, গীতিকার তাদের কবিতায় গানে রিকশাকে ছন্দ সুরে বেঁধেছেন নানা মাত্রায়। ফকির আলমগীর তার কথা ও সুরে গেয়েছেন-
আমি অহন রিশকা চালাই ঢাহা শহরে/ও সখিনা গেছস কিনা ভুইল্লা আমারে.../এবার বানে সোনা ফসফলা মাঠ হইল ছারখার/ দেশ-গেরামে শেষে নামে আকাল হাহাকার। রিকশার চিত্রে কেবল নয়, রিকশা চালকেরও রয়েছে ইতিহাস জীবনের। কত বেদনা, কত ঘাম, হাসিখুশি উচ্ছ্বাস বয়ে চলে রিকশা ঘিরে। রিকশা চিত্র বর্তমান সময়ে একটি বহুলপ্রিয় একটি মাধ্যম। এই চিত্র আজ রিকশার গায়ের জায়গা ছেড়ে ঠাঁই করে নিয়েছে পোশাকে, সাজগোজের অনুষঙ্গে, আসবাবে, নিত্যব্যবহার্য তৈজসপত্রে, অন্দরের দেয়ালে। শাড়ির আঁচল-পাড়ে, টি-শার্টে, চশমার ফ্রেমে, জুতায়, চেয়ার টেবিলে, ফুলদানিতে, নোটবুকে, ফোনের কভারে, চায়ের সরঞ্জামে, হেরিকেনে, ফটোফ্রেমে সর্বত্রই তার কদর। এই কদর ফিরিয়ে আনতে কাজ করেছেন প্রখ্যাত ডিজাইনার বিবি রাসেল। তার হাত ধরেই রিকশা চিত্র জনপ্রিয় ফ্যাশন ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। কাজ করেছেন সংগীত শিল্পী আনুশেহ্ আনাদিল। তার ফ্যাশন হাউস ‘যাত্রা’র নানা রকম পণ্যের গায়ে রিকশা চিত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে।
ঘরের রিকশা আর্ট মোটেই ঘরের কোণে থাকেনি। সে জায়গা করে নিয়েছে জাপানের ‘ফুকুয়োকা এশিয়ান আর্ট মিউজিয়াম’-এর এক বিশাল অংশজুড়ে। প্রদর্শনী হয়েছিল লন্ডনের মিউজিয়াম অব ম্যানকাইন্ডে। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে বাংলাদেশের পাঁচশ’ রিকশা শিল্পীর আঁকা ছবি নিয়ে হয়েছিল বিশাল প্রদর্শনী। বর্তমানে রিকশা চিত্রগুলো বিক্রি করতে গড়ে উঠেছে ‘Rickshaw art in Bangladesh’ নামের ওয়েবসাইট। শিল্পীদের আঁকা ছবিগুলো এখান থেকেই বিক্রি হয় দেশ-বিদেশের নানাপ্রান্তে।