
ভাষার মাসে আমাদের দেশের তরুণ চিত্র শিল্পীদের মুখোমুখি হয়েছিলাম সাম্প্রতিক দেশকালের শিল্প-সংস্কৃতি বিভাগ থেকে। প্রত্যেক চিত্রশিল্পীর জন্য ছিলো সাতটি প্রশ্ন। সেই সকল প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন তারা। পর্যায়ক্রমে সেইসব সাক্ষাৎকার প্রকাশ হবে। এবার প্রকাশ করা হলো আজিজি ফাওমি খানের সাক্ষাৎকার। যিনি চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা সম্পন্ন করেছেন। সাক্ষাৎকারটি অনুলিখন করেছেন-অলকানন্দা।
১. সাম্প্রতিক সময়ে চিত্রকলায় বর্তমান বাংলাদেশ কিভাবে উঠে আসছে?
বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই সমসাময়িক ঘটনাবলী শিল্পীদের কাজে প্রভাব ফেলেছে। সাম্প্রতিক সময়ও তার ব্যতিক্রম নয়। জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রদর্শনীগুলোতে দেখা যায়, শিল্পীরা সমসাময়িক ইস্যুগুলো নিয়ে কাজ করছেন। সেই শিল্পকর্মগুলোতে সমাজের নানান অসঙ্গতি ও অসামঞ্জস্যতাগুলোকে দেখিয়ে সে সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস দেখি। আবার একই সাথে দেশীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, লোকশিল্প প্রভৃতি নিয়ে অনেকে কাজ করছেন। ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই বিভ্রান্ত হবার যুগে, শেকড়ের খুব কাছে থাকার একটা চেষ্টা রয়েছে।
২. আপনার তুলিতে দেশের মুভমেন্টগুলো কতটা জায়গা নিয়েছে?
আমি নিজের শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে মূলত আমার চারপাশের মানুষগুলোকে নিয়ে কাজ করছি। কিছু মানুষ, বিশেষত নারী- যাদের আমি খুব কাছ থেকে চিনি, কাছ থেকে জানি। যারা সমাজের নানা প্রতিকূলতা বা নিত্যকার যে অসামঞ্জস্যতাগুলোর মুখোমুখি হতে হয়, সেগুলো পেরিয়ে ধীরে ধীরে নিজের পায়ে শক্তভাবে দাঁড়াচ্ছেন। তাদের অবয়বকে আমি নিজের মতন করে প্রকাশ করি। কখনো সেই চিত্রকর্মে আমাদের ঐতিহ্যবাহী রিকশা পেইন্টিংয়ের মোটিফ যোগ হয়, কখনো পটচিত্রের আদলে সেই মানুষটার গল্পগুলো আঁকি।
৩. একজন শিল্পী হিসেবে ‘ভাষা আন্দোলন ও চিত্রকলা’ এই দুই আপনার দৃষ্টিতে কেমন?
আসলে ভাষার লিখিতরূপগুলো, বিভিন্ন বর্ণ বা শব্দ, এগুলো সবই একেকটি চিত্র। চিত্রকলা বা সবমিলিয়ে শিল্পকলা নিজেই একটি ভাষা। ফলে ভাষার প্রতি শিল্পীরা বরাবরই বিশেষভাবে অনুরাগী।
আর ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তীকালের প্রতিটি আন্দোলনে বাংলাদেশের শিল্পীরা সরাসরিভাবে সংযুক্ত থেকে কাজ করেছেন। আন্দোলন পরবর্তীকালেও অনেক শিল্পী এখনো বাংলাভাষাকে নিয়ে শিল্পচর্চা করছেন। শহীদ মিনারের পার্শ্ববর্তী দেয়ালগুলো, সমসাময়িক শিল্পীদের ক্যানভাস বা নানান আর্ট প্রজেক্ট সেই নিদর্শন বহন করে। বাংলাদেশের শিল্পইতিহাসের শুরু থেকেই ভাষাকে নিয়ে অনেকগুলো শিল্প আন্দোলন ঘটেছে; প্রটেস্ট আর্ট, পাবলিক আর্ট প্রভৃতি মাধ্যমে। তাই একজন শিল্পী হিসেবে আমি বোধ করি, আমাদের সকলের শিল্পচর্চায় মাতৃভাষা সম্পর্কে আরো গভীর আলোচনা, গবেষণা করার প্রয়োজন আছে। এই ভাষা আন্দোলনের জের ধরে যে জাতীয়তাবাদের সূচনা, তাকে না জানলে শেকড়ের অনুসন্ধান অপরিণত রয়ে যাবে।
৪. দক্ষিণ এশিয়ার চিত্রকলা সম্পর্কে জানতে চাই- এক্ষেত্রে বাংলাদেশের চিত্রকলার অবস্থা কেমন?
দক্ষিণ এশিয়াতে বরাবরই নিজস্ব একটা আবহে শিল্পচর্চার রেওয়াজ রয়েছে। মাটির কাছাকাছি মানুষগুলোর মৃৎশিল্প, ভাস্কর্য, স্থাপত্যের প্রাচ্যকলার অসামান্য সব নিদর্শন রয়েছে। নানা ঘরানায় নানাভাবে চিত্রকলার চর্চা হয়েছে- দেয়ালে ফ্রেস্কো মাধ্যমে, কখনো টেরাকোটা মাধ্যমে আবার কখনো কাগজে বা কাপড়ে মিনিয়েচার আর্ট রূপে। কখনো পটচিত্রে, দেব-দেবী থেকে শুরু করে আপামর জনমানুষের গল্প বলেছে। আর এখন সমসাময়িক যুগে নানারকম কন্টেম্পোরারি শিল্পচর্চা হচ্ছে। নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী চর্চাগুলোর সাথে আধুনিক মাধ্যমের মিশেলে। প্রাচ্যকলায় বস্তুকে দেখার যে আলাদা একটা পরিপ্রেক্ষিত, সেই চর্চার প্রতিফলন ঘটছে কন্টেম্পোরারি কাজ গুলোতে।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান আমি বলবো খুবই আশাবাদী। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশের শিল্পীরা কাজ করছেন। নানারকম আন্তর্জাতিক কোলাবোরেশন হচ্ছে, বাংলাদেশের শিল্পীরা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বের প্রখ্যাত প্রদর্শনী বা শিল্প প্রকল্পগুলোতে কাজ করছেন। আমাদের দেশ নিজেরাই অনেক বড় পরিসরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানের প্রদর্শনীর আয়োজন করছে। বিশেষ করে তরুণ শিল্পীদের জন্যে এখন কাজ করার অনেকরকমের সুযোগ রয়েছে।
৫. আমাদের চিত্রকলায় পশ্চিমা প্রভাব কেমন, ইজমের ঘেরাটোপে এদেশে চিত্রকলার বর্তমান পরিস্থিতি কেমন?
আমাদের দেশের শিল্পচর্চায় শুরু থেকেই বোধ করি পশ্চিমা প্রভাব ছিলো। নানারকম পশ্চিমা ইজম ঘুরে-ফিরে আমাদের শিল্পীদের কাজে প্রভাব ফেলেছে। তবে এটাকে আমি ঠিক ঘেরাটোপ বলবো না। ব্যক্তিগতভাবে, আমার কাছে শিল্পীসত্ত্বাটাকে বিশ্বজনীন বিষয় বলে বোধহয়। পশ্চিমের কেউ বুদ্ধকে নিয়ে যেমন অনুপ্রাণিত হতে পারেন, তেমনি ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’ আমাদের বিমুগ্ধ ও অনুপ্রাণিত করতে পারে। তবে এও ঠিক যে, শুধুমাত্রই অনুকরণধর্মী হলে সেই শিল্পচর্চাটা ঠিক দাগ কাটে না।
এই অনুকরণধর্মীতা এখনো আছে। প্রায়শই এই বিষয়টা চোখের সামনে আসে। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, একই সাথে অনেক নিজস্ব, স্বকীয় কাজও হচ্ছে। সমসাময়িক শিল্পচর্চায় শিল্পীরা অনেকেই এখন অনেক বেশি স্বাধীনভাবে চর্চা করতে পারেন। শুধুই চিত্র নির্মাণ বা শুধুই ভাস্কর্য নির্মাণের বাধ্যবাধকতা শিল্পচর্চায় আর নেই। নতুন মাধ্যমগুলোতে কাজের গ্রহণযোগ্যতা এবং সুযোগ, দুইই তৈরি হয়েছে।
৬. একটা সময় ছিলো চারুকলার শিক্ষার্থীদের সমাজে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হতো, সে সময় বদলেছে বলা হয়; সত্যিই কী তাই?
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে যদি বলি, আমার কাছে মনে হয় না যে সময় বদলেছে। আগেও গুটিকয়েক প্রগতিশীল মানুষ বিষয়টাকে সমর্থন করতেন, এখনো তাই। আমাদের জীবন ব্যবস্থার আদতে তেমন পরিবর্তন হয়নি। সাধারণ মানুষের কাছে শিল্পকর্ম বিষয়টা তো আসলে বিলাসিতা। তাই শিল্পীকে কিছুটা সমাজের বাইরের লোক বলেই ধরা হয়। শিল্পীকে এই যুগে কেউ ‘কুল’ ভাবছেন, কেউ পাগল ভাবছেন। শিল্পী হিসেবে কেউ সামাজিক অবস্থানে উঁচুতে উঠতে পারলে, তবেই সাধারণে তাকে সম্মান করছেন।
চারুকলা অনুষদের অনেক অনেক শিক্ষার্থীর পরিবারের অমতে শিল্প নিয়ে পড়তে আসার গল্প আছে। যার মূলে থাকে শিল্পীজীবনের ভবিষ্যৎ কি - এ নিয়ে অনিশ্চয়তা, আবার কিছু ক্ষেত্রে ধর্মীয়বিশ্বাসের জায়গাগুলো।
৭. চিত্রকলা একটি শিল্প এই শিল্প সৃষ্টির সাথে শিল্পীর জীবন ধারণের যে সম্পর্ক রয়েছে সেই জায়গাটা দেশীয় প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছে কী?
এই প্রশ্নের উত্তরে আমি আসলে না-ই বলবো। আমি নিজেই চিনি এমন অনেক সম্ভাবনাময় শিল্পী রয়েছেন যারা জীবন ধারণের তাগিদে ধীরে ধীরে শিল্পচর্চা থেকে দূরে সরে গেছেন। বর্তমান যুগে, মেধা ও সৃষ্টিশীলতার পাশাপাশি, প্রচারমুখী ব্যক্তিত্ব- অর্থাৎ শিল্পী শিল্পচর্চা করছেন এবং সেই চর্চাকে ও নিজেকে কিভাবে উপস্থাপন করছেন, দুইই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আর আগেই বলেছি, শিল্প আমাদের দেশে বিলাসিতা। অংশগ্রহণ বেশি হলেও, দেশীয় প্রেক্ষাপটে শিল্পানুরাগী, বিশেষ করে পৃষ্ঠপোষকদের গণ্ডি খুবই ছোট। এর মধ্যে থেকে নিজের জায়গা বের করে নেয়া বা খুব সাধারণভাবে হলেও শিল্পের উপর নির্ভর করে জীবন ধারণ একদমই সহজ নয়। তবে কেউ নিজেকে এই চ্যালেঞ্জের জন্যে প্রস্তুত করে, একাগ্রতা ধরে রেখে নিজের চর্চাটা চালিয়ে গেলে, এটা একেবারে অসম্ভব তা-ও নয়।