১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসের বিকেলটা হঠাৎ করে বদলে যায় আমাদের জামশা গ্রামে। আমাদের গ্রামটা সিংগাইর উপজেলায়। কালীগঙ্গা নদী আমাদের গ্রামকে দুটি ভাগ করে দিয়েছে। একটির নাম উত্তর জামশা ও অন্যটি দক্ষিণ জামশা। আমার গ্রাম উত্তর জামশা। সেদিন শেষ বিকেলে আমাদের গ্রামের আকাশটা হঠাৎ করে কেমন কমলা বরণের আগুনরঙা হয়ে ওঠে। শেষ বিকেলের সূর্য ডোবার যে কোমল লাল আভা থাকে তা ক্রমাগত বদলে যেতে থাকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার দাদি বললেন- ‘আসমানের অবস্থা ভালো না রে। তোরা কেউ বাইরে যাইস না।’
সেদিন ছিল হাটবার। গ্রামের লোকেরা হাটে যাচ্ছে। কালীগঙ্গা নদীর ওপারে দক্ষিণ জামশার হাট বসত। দূর-দূরান্ত থেকে হাটুরেরা আসতো সওদা করতে। গ্রামের মানুষের প্রাত্যহিক জিনিসপত্র কেনার জন্য এই হাটের গুরুত্ব ছিল অনেক। সবাই তাই অপেক্ষা করতো হাটবারের। নদী পারাপারের উপায় খেয়া-নৌকা। সেদিনের বিকেলে আমরা যারা ছোট আমাদের বাড়ির পাশে বড় আমগাছটার নিচে এসে দাঁড়াই। ঝড় এলে আম পড়বে। আমরা আম কুড়াব; কিন্তু আকাশের লাল রঙ ক্রমশ ভীতিকর হয়ে ওঠে। সহসা চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায়। বাতাস স্তব্ধ হয়ে থাকে খানিকক্ষণ। সে এক ভয়াবহ স্তব্ধতা নেমে আসে। গাছের পাতারাও নড়ছিল না। আমার দাদির চিল চিৎকারে আমরা ঘরে চলে গেলাম। আর তখনি শুরু হলো বাতাসের তাণ্ডব। আমাদের ঘরের টিনের বেড়া থরথর কাঁপছে। আমার দাদি দোয়াদরুদ পড়ছেন। আধাঘণ্টা কেটে যায় আমাদের আতঙ্কে। শোঁ শোঁ বাতাস ঘরের চালে তখনও দাপট দেখাচ্ছে। ঝড় থেমে গেলে অতঃপর ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসে সেই সন্ধ্যায়। আমরা ঘর থেকে বের হই। এরপর খবর আসতে থাকে দক্ষিণ জামশা তছনছ করে দিয়ে গেছে ঘূর্ণিঝড়। শতশত লোক মরেছে। অনেকে নিখোঁজ রয়েছে।
টিউবওয়েল তুলে নিয়ে সুউচ্চ তেঁতুল গাছের ডালে পেঁচিয়ে রেখেছে। সাজানো গোছানো দক্ষিণ জামশা, বালুর চর একেবারে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আহতের আর্তনাদ বাতাস ভারী করছে। মৃতের স্বজনের চিৎকার এ পাড়েও ভেসে আসছে। সেই সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাই আবুল কালাম ছুটে চলে যান নদীর পাড়ে। সেই রাতেই মানিকগঞ্জ শহর থেকে ছুটে আসেন মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল হোসেন খান। তারা ত্রাণকার্যক্রম শুরু করেন স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে। তখনকার সময় আজকের দিনের মতো যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। ঘূর্ণিঝড়ের পরের দিন সমস্ত সংবাদপত্র, বিবিসিতে জামশা গ্রামের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের সংবাদ প্রচারিত হয়। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ওপর এটি ছিল মারাত্মক আঘাত। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু হয়।
আহতদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো হয় সুচিকিৎসার জন্য। আজ যেখানে কালীগঙ্গা সেতুর মাথাটি দক্ষিণ জামশার ঘাট ছুঁয়েছে সেইখানে এবং বালুর চরের আশেপাশে রেডক্রসের ক্যাম্প তৈরি হয়। তরুণ সমাজ দিনরাত নিহতদের কবর দেওয়ায় আর আহতদের সেবায় ব্যস্ত থাকতো। আমরা যারা কিশোর তারা ঝড়ের পরদিন পৌঁছে যাই নদীর ওপারে। নদীর উত্তর পাড়ের আমাদের গ্রামের বাড়িঘরের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে হাটফেরত অনেকেই নিখোঁজ, মৃত ও আহত হয়েছেন। তাই মৃত স্বজনের খোঁজে, আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য আমাদের গ্রামের মানুষ নদীর ওপারে ভিড় করেছে। ঘূর্ণিঝড়ের পরদিন একটি হেলিকপ্টার এসে নামে নদীর দক্ষিণ পাড়ে। আমরা হেলিকপ্টারের দিকে ছুটে যাই। ভোরেই জেনেছি বঙ্গবন্ধু আসবেন।
হেলিকপ্টার থামলো। পাখা ঘুরছে। পাখার বাতাসের ঝাপটায় আমরা স্থির থাকতে পারছি না। পাখা বন্ধ হলে নেমে আসলেন দীর্ঘদেহী বঙ্গবন্ধু। মুখে পাইপ। পরণে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর কালো কোট। আমার কাছে মনে হয়েছিল দুর্গত এই মানুষগুলোর কাছে আকাশ থেকে দেবদূত নেমে এসেছে। তাঁকে দেখে আমাদের গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত আর্ত নারী-পুরুষ বঙ্গবন্ধুর জয়ধ্বনিতে ফেটে পড়ে। তাদের কোনো শোক নেই। এত যে মৃত্যুর বেদনা, স্বজনের জন্য আর্তনাদ- গৃহহারা সেই মানুষগুলো মুহূর্তে শোক ভুলে যায়। যেন এই মানুষটি থাকলে কোনো অভাব যন্ত্রণা শোক কিছুই থাকে না। বঙ্গবন্ধু চারপাশ দেখলেন। চোখ মুছলেন। তার কোনো প্রোটেকশন নেই। সিংগাইর থানার কয়েকজন পুলিশ এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আসা মানুষগুলো দাঁড়িয়ে আছে। সেই আমার বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখা। তিনি দ্রুত ঘরবাড়ি মেরামতের জন্য সাহায্যের নির্দেশ দিলেন। তারপর তিনি বললেন- ‘ভায়েরা আমি সান্ত¡না দিতে আসি নি। আমি এসেছি আমার আপনজনদের দুঃখ ভাগ করে নিতে। পাকিস্তানিরা আমাদের নিঃস্ব করে রেখে গেছে। আমি তো আপনাদের মানুষ। মুজিবুররে আপনারা যখন চাইবেন তখনই পাবেন।’
তিনি ঘুরে ঘুরে দেখলেন। বালুরচর গেলেন। তার পেছনে হাজার মানুষের স্রোত। বাঙালির প্রিয় নেতা, নেতা চলেছেন। এই মানুষগুলো বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার মানব ঢাল হয়ে ওঠে। আশপাশে কোনো পুলিশ নেই। বঙ্গবন্ধু হেঁটে চলেছেন। চোখ মোছেন। আমিও সেই মিছিলে ছিলাম। তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। এত কাছে থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখার স্মৃতি আমাকে আজও আবেগতাড়িত করে।
গ্রামের মানুষদের অবাক করে দিয়ে, সরকারি লোকজন কমিয়ে হেলিকপ্টারে আহত মানুষদের তুলে নিয়ে ঢাকার পথে উড়ে গেলেন বাংলাদেশের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের অঞ্চলের সহস্র মানুষের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। আমি এই সময়ে, এই এত বছর পরেও চোখের সামনে দেখি চোখ মুছতে মুছতে জাতির জনক হেলিকপ্টারে উঠছেন। যেন ফেলে যাচ্ছেন তাঁর স্বজনদের কালীগঙ্গার পাড়ে। বঙ্গবন্ধুর চোখের জল মিশেছে বলে আজও কি আমাদের কালীগঙ্গার জল এত স্বচ্ছ ও নির্মল। মুজিববর্ষে, বাংলাদেশের স্থপতিকে শ্রদ্ধা জানাই। আকাশের দিকে তাকিয়ে, এই বাংলাদেশের রচয়িতা বঙ্গবন্ধুকে বলি-‘ধন্যবাদ বঙ্গবন্ধু। আপনি এনে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আপনাকে ধন্যবাদ।’
লেখক: অধ্যাপক, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।