Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

বঙ্গীয় চিত্রকলায় আত্মপরিচয়ের সংকট

Icon

দ্রাবিড় সৈকত

প্রকাশ: ০৮ জুন ২০২১, ১৫:৫৭

বঙ্গীয় চিত্রকলায় আত্মপরিচয়ের সংকট

প্রতীকী ছবি

শিল্পকলা দৃশ্যজগতের প্রাচীন অধ্যয়নের বিষয়। পুরো পৃথিবীজুড়ে শিল্পকলার রয়েছে নানারকম নির্মাণ, গড়ন, উপকরণ, বৈশিষ্ট্য ও অভিব্যক্তি। মানুষের সৃষ্টি করা এসব শিল্পকর্মের রসাস্বাদন করতে হলে একজন মানুষকে জানতে হয় শিল্প ও সভ্যতার ইতিহাস, সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি, নন্দনতত্ত্ব, প্রযুক্তি ও মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। কেননা শিল্পকর্মের ধরন, গড়ন ও চলন নির্ভর করে অনেক শর্তের ওপর। প্রাগৈতিহাসিক একটি গুহাচিত্রকে উত্তর আধুনিক মানসিকতা দিয়ে পুরোপুরি অনুধাবন করা সম্ভব নয়। সেই শিল্পকর্মের রসাস্বাদন করতে হলে বুঝতে হবে তখনকার শিল্পে ব্যবহৃত উপকরণ, মানুষের খাদ্যাভ্যাস, ভৌগোলিক অবস্থান, আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্য, তৎকালীন পরিবেশে ও পারিপার্শ্বিক অবস্থায় মানুষের মনস্তত্ত্ব; এসব কিছুটা অধিগম্য হলেই সম্ভব একটি গুহাচিত্রকে হৃদয়ঙ্গম করা এবং এর বিষয়ে কোনো একটি মূল্যায়নধর্মী অবস্থান গ্রহণ। চিত্রকলার চরিত্র বৈশ্বিক হলেও এর উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকে স্থানীয় মানস ও সংস্কৃতির নানামুখী অভিঘাত। তাই বৈশ্বিক জ্ঞানের সঙ্গে স্থানিক অধ্যয়নের নির্যাস যুক্ত না হলে চিত্রকর্মের গভীরে প্রবেশ করে তার অর্থ উদ্ধারে বিপর্যয়ের সম্ভাবনা থেকেই যায়। 

ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের সূচনাকাল থেকে সমাজের সর্বস্তরে একটি ব্যাপক পরিবর্তন শুরু হয়। শাসক দল তাদের ক্ষমতার ভিত্তিকে পাকাপোক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য স্থানীয় মানুষের মনঃস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের দিকে দৃষ্টি দেওয়া শুরু করে। তারা স্থানীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের উপযোগী করে সাজিয়ে নেয়। বিজেতার দম্ভ নিয়ে সবকিছুকে তারা অবজ্ঞার চোখে দেখতে থাকে। ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শনকে চরম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে চিহ্নিত করে মেকলে যেমন বলেন : I have never found one among them who could deny that a single shelf of a good European library was worth the whole native literature of India and Arabia.(Macaulay : 1835). 

মেকলে ইউরোপীয় লাইব্রেরির একটি সাধারণ তাকের থেকে নিচুতে তিনি রেখেছের সমগ্র ভারতবর্ষ ও আরবীয় জ্ঞান সমুদ্রকে। এটি শুধু ঔদ্ধত্য নয় একই সঙ্গে চরম মূর্খতা ও অন্ধ আক্রোশের দাম্ভিক বহিঃপ্রকাশ। তারা বিভিন্ন স্তরে সরকারি অর্থ বিনিয়োগ করেছেন ব্রিটিশ শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ ও এই অঞ্চলের মানুষের জ্ঞানতাত্ত্বিক মেরুদণ্ড ও বিশ্বাসকে গুঁড়িয়ে দিতে। শিক্ষা-দীক্ষার সকল স্তরে ঔপনিবেশিক বিকৃতি ও বিচ্ছিন্নতার ফসল আমরা দেখতে পাচ্ছি বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা ও তার চিন্তা-চেতনার অভিঘাতে। দেশজ জ্ঞান ও তার প্রক্রিয়াসমূহ এখন পশ্চাদপদতার নামান্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বঙ্গীয় জ্ঞানকাণ্ডের সব শাখায় এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব সৃষ্টির নিমিত্তে ব্রিটিশ কৌশল ছিল বহুমুখী, এসব প্রয়াসের উদ্দেশ্য ছিল একটাই, আর তা হলো লুণ্ঠন, শোষণ ও শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করা। দখলকৃত এলাকায় ব্রিটিশ শাসকরা সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যমূলক তিনটি প্রকল্প হাতে নেয় ভারতীয় শিল্প, সাহিত্য, জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং দর্শন বিষয়ে। প্রথমটি হলো ভারতীয় প্রজ্ঞাসমূহ সম্পর্কে আপত্তিকর নানা নানাবিধ প্রশ্ন উত্থাপনের মাধ্যমে তাকে হেয়প্রতিপন্ন করা।

দ্বিতীয়টি হলো ভারতবর্ষের প্রাচীন প্রজ্ঞাসমূহ ইউরোপীয়দের হাতে নতুন করে আবিষ্কারের কৃতিত্বের প্রচার। তৃতীয়টি হলো বিজিত ভূমির নানাবিধ ধর্মীয় ও জ্ঞানতাত্ত্বিক সংগঠনসমূহের পৃষ্ঠপোষণার মাধ্যমে নিজেদের বৈধতা ও সম্মান আদায়ের ভিত্তিকে শক্ত করে তোলা (বারনারড কোহন ২০২০ : ১১৫-১১৬)। এভাবে নানা কূটকৌশলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের আধিপত্যের থাবা ক্রমেই দীর্ঘায়িত করে তোলে। দেশীয় বুদ্ধিজীবী মহলে তৈরি হয় তাদের অনুসারি, অনুরাগী ও সমর্থক; ফলত নিজস্ব ঐতিহ্যের প্রতি তৈরি হয় অবজ্ঞা ও অজ্ঞতাজনিত বিচ্ছেদ। জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের দেবেন্দ্রনাথের নাতি, বীরেন্দ্রনাথের ছেলে বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর আঠারোশ তিরানব্বইতে যেমন বলেছিলেন, ‘ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে আমাদের মধ্যে সাহিত্যের যেরূপ অনুশীলন হইয়াছে, কলাবিদ্যার অন্যান্য অঙ্গের তাহার শতাংশের একাংশও আদর হয় নাই। বিশেষত চিত্রকলা এ দেশে তাহার সেই আদিম রঙলেপা বর্বর অবস্থা হইতে অল্পই অগ্রসর হইয়াছে’ (বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৮৬ : ৬০)।

বলেন্দ্রনাথের এই উপলব্ধির পুরোটাই চিত্রকলা সম্পর্কিত নান্দনিক আকাঙ্ক্ষা থেকে উদ্ভূত এমনটি ভাবার অবকাশ নেই, কারণ এদেশের প্রাচীন চিত্রকলাসমূহের যতখানি তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় তাতে করে ‘আদিম রঙলেপা বর্বর অবস্থা’ এমন কল্পনা করাও সম্ভবপর নয়। কেননা অনেক ধ্বংসের পরেও টিকে যাওয়া প্রাচীন গুহাচিত্রসমূহ, গুপ্ত, মুঘল, রাজপুত, পাহাড়ি, পাল চিত্রকলার যে উৎকর্ষ তাকে শুধুই রঙলেপা আদিমতা ভাবার সুযোগ নেই। এর পেছনে বরং রয়ে গেছে অন্য কোনো গুরুতর প্রভাবক। ১৮৬৪ ইংলেন্ডের রয়্যাল একাডেমি মেম্বার, ধ্রুপদি ভাস্কর্যের পণ্ডিত, প্রফেসর ওয়েস্টমেকট তার বিখ্যাত ‘Handbook of Sculpture Ancient and Modern’ গ্রন্থে ভারতীয় ভাস্কর্য সম্পর্কে মন্তব্য করেন :

there is no temptation to dwell at length on the sculpture of hindustan. it affords no assistance in tracing the history of art, and its debased quality deprives it of all interest as a phase of fine art, the point of view from which it would have to be considered. … They usually consist of monstrous combinations of human and brute forms, repulsive form their ugliness and the outrageous defiance of rule and even possibility (Richard Westmacott 1864 : 50-51).

ওয়েস্টমেকটের প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই স্থানীয় শিক্ষিত মহলের শিল্প বিচার পদ্ধতিতে। পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের আলোচনাকে মানদ- ধরে এবং তাদের সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখেই স্থানীয় অনুসারিরা এদেশের শিল্পকলাকে মূল্যায়ন অব্যাহত রেখেছেন। পশ্চিমে শিল্পকলা দুই শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। কারুকলা ও চারুকলা। কারুকলা শিল্প নয়, বরং পণ্য হিসেবে বিবেচিত হতো। সেই সূত্র ধরেই তারা ভারতীয় সকলশ্রেণির শিল্পদ্রব্যকে পণ্য নামে আখ্যায়িত করে একে চারুশিল্প হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয় বলে মতামত প্রকাশ করেছেন; কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় শিল্পকলার অধ্যয়নেও দেখা যায় শিল্পীদের দুই শ্রেণিতে বিভাজনের রীতি। এক শ্রেণি ‘কারু’ বা ‘কারুক’ নামে, আরেক শ্রেণি ‘শিল্পী’ নামে অভিহিত হতো। কারুকের তুলনায় শিল্পীর মর্যাদা ছিল ওপরে। আধুনিক ‘কারিকর’ শব্দটি ‘কারুক’ শব্দের অপভ্রংশ। কারিকর শ্রমজীবী, উদ্ভাবক নন। স্মৃতিশাস্ত্রে উভয়েরই উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন : ‘যন্ত্রাকরে কারুক-শিল্পহস্তে’। বিষ্ণুসংহিতার এই বচন ‘কারুক’ ও ‘শিল্পী’র এই পার্থক্যকে স্পষ্টভাবেই স্বীকৃতি দিচ্ছে। এই দুই শ্রেণির সামাজিক মর্যাদা আলাদা ছিল সেই প্রাচীন কাল থেকেই (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ১৩৮৯ : ২৭)। কাজেই এদেশের শিল্পকলা তার আদিম অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারেনি কিংবা এখানকার শিল্প ‘ফাইন আর্ট’ পদবাচ্য নয় এমন ধারণা অজ্ঞতাপ্রসূত; কিন্তু পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের অনুসরণে স্থানীয় শিক্ষিত মহলেও ভারতীয় শিল্পকলা তার আদিম অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারেনি এমন ধারণা তাদের বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। ভারতীয় শিল্পের অনুরাগী হিসেবে পরিচিত পাশ্চাত্য পণ্ডিতরাও এর বাইরে ছিলেন না।

১৮৮০ সালে জর্জ বার্ডউড তার সুবৃহৎ গবেষণা গ্রন্থ ‘The monstrous shapes of the Puranic deities are unsuitable for the higher forms of artistic representation; and’ this is possibly why sculpture and painting are unknown, a s fine arts, in India. (George C. M.Birdwood,1880 : 125) এভাবেই পশ্চিমা লেখকদের সিদ্ধান্তের প্রভাবে আমরা নিজেদের ক্রমাগত হারিয়ে ফেলতে থাকি। বিবেকানন্দ তার ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ গ্রন্থে বলেছিলেন, ভারতীয়েরা ইউরোপের তুলনায় ছবি আঁকা ও মূর্তিকলায় চিরকালই অপটু এবং ইউরোপের শিল্প এক বিরাট ব্যাপার (শোভন সোম অনিল আচার্য ১৯৮৬ : ৭)। এভাবে সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিবর্গের আত্ম-অবজ্ঞামূলক মন্তব্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ভারতীয় শিল্পের পরম্পরাহীনতা ও ইউরোপের তুলনায় নিকৃষ্ট এমন প্রচারকেই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলেছে। ইংরেজি শিক্ষিত মানুষেরাই ছিল তৎকালীন (অবশ্য এখনো পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি) সমাজের নীতি নির্ধারক। ভালো-মন্দ, রুচিশীল-অরুচিকর, ন্যায়-অন্যায়ের নির্ধারক মহল যাকে স্বীকৃতি দেয় এবং যাকে অস্বীকার করে তার পরিণতিও সেভাবেই নির্ধারিত হয়। শিক্ষিত মানুষের গরিষ্ঠাংশ যখন পরম্পরাগত চিত্রশৈলীকে অবজ্ঞা করতে থাকলো ইংরেজদের প্ররোচনায়, তখন এই স্রোত প্রবাহিত হলো সমাজের সর্বত্র। বাংলার চিত্রকলাও এই চক্রান্তের সুনির্দিষ্ট শিকার। 

ব্রিটিশ সরকারের শাসক কার্য পরিচালনার সুবিধার্থে, মানচিত্র প্রণয়ন, সমীক্ষা ও বিভিন্ন নকশা তৈরির প্রয়োজনে ১৮৫৪ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘স্কুল অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল আটর্’। পরবর্তীকালে ১৮৬৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এবং এর নতুন নামকরণ হয় ‘দি গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস’। আর্ট স্কুলের শিক্ষাদান পদ্ধতিতে ভারতীয় নিজস্ব ধারার কোনো কিছু পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। বরং পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে রৈখিক পরিপ্রেক্ষিত নির্ভর অঙ্কনরীতি চালু ছিল। স্থানীয় রীতি-পদ্ধতির ঐতিহ্যানুসারি চিত্র-প্রকরণকে ফাইন আর্ট হিসেবে মূল্যায়ন করেনি ইংরেজ সরকারের চালু করা চিত্ররীতি। এর ফল ছিল সুদূরপ্রসারী।

কালো চামড়ার মগজের নিচে তৈরি হচ্ছিল সাদা মগজ, যার পুরোটাই বলা যায় মেকলের প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তব প্রতিফলন, ‘We must at present do our best to form a class who may be interpreters between us and the millions whom we govern, --a class of persons Indian in blood and colour, but English in tastes, in opinions, in morals and in intellect. ( Macaulay :1835).  ইংরেজি শিক্ষিত সমালোচক, বোদ্ধা ও শিল্পীদের উৎসাহে আমাদের শিল্পকলা এবং তার চালচলন ক্রমাগত বদলে যেতে থাকে। শিল্পচর্চায় ঐতিহ্য ও ভারতীয় পরম্পরা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দীর্ঘসময় ধরে চর্চার ফলে পরিবর্তিত হতে থাকে আমাদের শিল্পরুচি, নৈতিকতা, মতামত ও জীবনবোধের বিভিন্ন স্তরের চিন্তা-চেতনা। আমরা তাদের মতো করে নিজেদের দেখার যে আকাক্সক্ষা সেটি পূরণের জন্য তাদের মতামত ও বিবেচনাকেই নিজেদের করে তুলেছি। 

দি গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসে ১৯১৫ সালে অধ্যক্ষ পারসি ব্রাউন ফাইন আর্ট বিভাগকে দ্বিখণ্ডিত করে ‘ফাইন আর্ট’ ও ‘ইন্ডিয়ান পেইন্টিং’ দুটি বিভাগে রূপান্তরীত করেন। এই বিভাজনের মাধ্যমে দেশীয় চিত্রকলাকে দ্বিতীয় সারিতে নামিয়ে দেওয়া হয় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। পারসি ব্রাউন পরিকল্পিতভাবে ভারতীয় শিল্পকে একটি প্রথাগত প্রকরণ এবং বিকাশের সম্ভাহীন করে তোলার পেছনে নিজের জোড়ালো অবদান নিশ্চিত করেন। আলাদা বিভাগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্থানীয় চিত্র পরম্পরায় যে গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছিল, সেখান থেকে পচন ছড়িয়ে পড়েছে শিল্পচর্চার প্রায় সব ক্ষেত্রে। ঔপনিবেশিক শক্তি দেশীয় শিল্পী ও বোদ্ধা মহলের মগজে একটি বার্তাই স্থিরভাবে বসিয়ে দিতে চেয়েছেন যে, তোমার চারুশিল্প নেই। শিল্প নামে তোমাদের দেশে যা পরিচিতি পেয়ে আসছে তার সবই মূলত কারিগরের নির্মিত পণ্য। এ কথাই বারবার বলেন, তাদের উপনিবেশের শিল্প আদিম অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারেনি, এবং তাদের নিজেদের শিল্পের তুলনায় 

নিকৃষ্ট। এই নিকৃষ্টতা প্রমাণের সূক্ষ্ম চাল হিসেবেই আর্ট স্কুলে পারসি ব্রাউন দুটি বিভাগ স্থাপন করে বুঝিয়ে দিলেন যে, ভারতীয় চিত্রশিল্প ফাইন আর্টের অন্তর্গত নয়, অন্তর্গত হবার যোগ্যও নয় (শোভন সোম অনিল আচার্য ১৯৮৬ : ১০২-১০৩)। এসব প্ররোচনা এবং প্রচারণায় স্থানীয় শিল্পীদের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতা ও অনুগ্রহ লাভের আশায়ও অনেক শিল্পী তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে থাকেন। নিজেদের শিল্পশৈলীর প্রতি তৈরি হতে থাকে আস্থাহীনতার শক্ত দেয়াল। শিল্পকর্মে অন্তর্দৃষ্টি, জীবনবোধ ও মানবিক গুনাবলিকে পরিত্যাগ করে আঙ্গিক সর্বস্বতাকেই প্রাধান্য দেওয়া হতে থাকে। ইউরোপীয় ধারার বহিরাবরণের চাকচিক্যে মজে গিয়েছিলেন আমাদের শিল্পীদের বড় অংশ। তবে এটাও বাস্তব যে বহিরাগত বিভিন্ন শাসক সম্প্রদায়ে প্রভাবে আমাদের নিজস্ব ধারার শিল্পকর্মের অধঃপতন হয়েছিল ব্যাপক আকারে। বাংলা ভাষায় প্রথম শিল্পসমালোচনা গ্রন্থের লেখক শ্যামাচরণ শ্রীমানী তুলে ধরেছেন তার কিছু চিত্র : ‘অধুনা দেব দেবীর লীলা চরিত প্রদর্শনার্থেই অধিকাংশ পট চিত্রিত হইয়া থাকে, সুতরাং দেবতাদিগের মাহাত্ম্য গৌরবে তৎসমুদয়ের দোষ গুণ সাধারণ ভক্ত মণ্ডলীর চক্ষে আচ্ছন্ন থাকে; কিন্তু পূর্বে চিত্র-কার্য্য এরূপ কেবল পূজার্চ্চনার উদ্দেশ্যেই ক্ষেপিত হইত না; নাটকাদিতে যে সকল চিত্র লেখার উল্লেখ পাওয়া যায়, তাহা আধুনিক সুসভ্য জন-সমাজের রীত্যনুসারে স্বভাবের ভাব সকলকেই প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছে’ (শ্যামাচরণ শ্রীমানী : ৪৯)। সুসভ্য জন-সমাজের শিল্পরীতি পরিবর্তিত হতে হতে ভারতীয় শিল্প তার নিজস্ব সৃষ্টিশীলতার পথ ছেড়ে দিয়ে জাবর কাটার মতো একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তির পথে পতিত হয়েছে। নিজেদের ঐতিহ্য হিসেবে যে শিল্পকর্মের নমুনা সামনে হাজির করা হচ্ছে, তা সবসময়েই রুচিকর নয়, বরং কখনো কখানো রুচিশীল মননের পক্ষে বিরক্তিকর। শিল্পের এই অধঃপতনকেও চিহ্নিত করেছেন শ্যামাচরণ শ্রীমানী :

‘অপিচ, কালিদাস প্রভৃতির নাটকের তুলনায় এক্ষণকার যাত্রা-নাটক যে রূপ, ঐ সময়ের চিত্র রচনার তুলনায় বর্তমান প্রচলিত পট-চিত্রও সেই রূপ দিব্যশ্রী প্রকাশ করিয়া থাকে। অতএব, যে দেশে শকুন্তলা, মালতীমাধব প্রভৃতি নাটক সকল সমূলে উন্মূলিত হইয়া তাহার স্থানে যাত্রা প্রভৃতি সামান্য গীতি-নাটক অবলীলাক্রমে রাজত্ব করিয়া আসিতেছে, সে দেশে পুরাকালের কবিত্বসূচক চিত্রলেখার স্থানে যে এক্ষণকার নির্জীব ও কিম্ভূত চিত্ররচনা সকল পদার্পণ করিতে সাহসী হইবে, তাহাতে আর বিচিত্রতা কী?’ (শ্যামাচরণ শ্রীমানী : ৫৩)। 

সমসাময়িক ধারার স্থানীয় চিত্র পদ্ধতিকে শ্যামাচরণ ‘কিম্ভূত চিত্ররচনা’ বললেও পুরাকালের কবিত্বসূচক অর্থাৎ যেখানে কল্পনা ও নতুত্বের অবাধ বিস্তার তার প্রশস্তি গেয়েছেন। এবং তার আফসোসের বিষয়টিও যৌক্তিক, কেননা চিত্রকলার উজ্জ্বল এবং সমৃদ্ধ পরম্পরার বদলে এদেশে চর্চিত হচ্ছিল এক অবক্ষয়ী প্রকরণ, যাদের সামগ্রিক পরিচিতিমূলক নাম ‘লোকজ চিত্রকলা’। শিল্পকলায় নিজেদের ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে ভুলে গিয়ে কিংবা অবজ্ঞা ও অনাদরের ভেতর দিয়ে দেশীয় ধারার শিল্পচর্চারসমৃদ্ধ শৈলীর সঙ্গে সাধারণ ও শিক্ষিত মহলে তৈরি হয়েছে অলঙ্ঘনীয় ফারাক। সমসাময়িককালে দেশীয় শিল্পের ধারা আমরা বলা যায় পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছি। কেননা দেশীয় শিল্প বলতেই এখন আমরা বুঝি ‘লোকশিল্প’কে যার সম্পর্কে সেই ‘আদিম রঙলেপা’ জাতীয় কটাক্ষটি অনেকখানি মিলে যায়, কেননা এই শিল্পশৈলীতে প্রাচীন শাস্ত্র প্রদর্শিত মাপজোক, পরিমিতি, লাবণ্য, সাদৃশ্যসহ চিত্রকলার জন্য আবশ্যক অনেক গুণের ঘাটতি প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়। অথচ আমাদের গুপ্ত, মুঘল, পাল সময়ের সমৃদ্ধ চিত্রকলার ধারাটি পথ হারিয়েছে, আমরা হারাতে দিয়ে এখন নিজেদের চিত্রিত করছি এক অক্ষম ধারার অনুসারী হিসেবে। 

বাংলার চিত্রকলা নিয়ে আলোচনার সময়ে অনেকেই মনে করেন এখানে মানবদেহের অনুপাত বিষয়ক কোনো জ্ঞানের চর্চা হয়নি; কিন্তু প্রাচীন চিত্রকলা সম্পর্কিত গ্রন্থসমূহ থেকে আমরা জানতে পারি এখানে চিত্রাঙ্কনের সুনির্দিষ্ট বিধিমালা রয়েছে। ‘চিত্রসূত্র’ নামক চিত্রকলা বিষয়ক গ্রন্থে এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গের পরিমাপ। ভারতীয় শিল্পীরা মনে করতেন যে, সমগ্র দেহের সঙ্গে মাথার এমন একটি সম্পর্ক আছে যে মাথার আকারের সঙ্গে পরিমাপের মাধ্যমে অবশিষ্ট দেহের পরিমাণ করা যায়। প্রমাণের এই মাত্রাকে বলা হতো ‘তাল’ (সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ২০০৬ : ২৫)। বারো আঙ্গুলে এক তাল। নবতাল পরিমাণ সাধারণত শিল্পীরা ব্যবহার করেন। ‘উত্তম নবতাল’ অনুসারে সমগ্র মানবদেহ সমান নয় ভাগে বিভক্ত করা হয় এবং এই এক এক ভাগের সমান এক তাল, অর্থাৎ একজন পূর্ণবয়স্ক স্বাভাবিক মানুষের দৈর্ঘ হবে নয়টি মাথার সমান।

চিত্রসূত্রে পাঁচ প্রকার মানুষের কথা উল্লিখিত আছে, হংস, ভদ্র, মালব্য, রুচক ও শশক। হংস দীর্ঘতম এবং শশক হ্রস্বতম। পরবর্তীকালে ইউরোপীয় রেনেসাঁর প্রধানতম পুরুষ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘A Treatise on Painting’ গ্রন্থেও আমরা দেখতে পাই, মাথার মাপের সঙ্গে তুলনা করে তিনি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাপকে আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করছেন : A man has the length of two heads from the extremity of one shoulder to the other, the same from the shoulder to the elbow, and from the elbow to the fingers; (Leonardo Da Vinci Chap. ix: 2014). তাই এমন কথা ভাবার সুযোগ নেই যে, এদেশের শিল্পীদের পরিমাপ, পরিমিতি ইত্যাদি বিষয়ে অজ্ঞতা রয়েছে এবং ইউরোপ এ বিষয়ে আমাদের থেকে অনেক অগ্রগামী। প্রাচীন গ্রন্থসমূহের অধ্যয়নে এ বিষয়ে সংশয় দূরীভূত হতে পারে। 


‘শুক্রনীতিসার বৃহৎসংহিতা প্রভৃতি প্রাচীন গ্রন্থে মূর্তির মান পরিমাণ আকৃতি প্রকৃতি তন্ন তন্ন করিয়া দেওয়া আছে। মূর্তিনির্মাণ সম্বন্ধে শিল্পাচার্যগণের কয়েকটি উপদেশ প্রয়োজনবোধে উদ্ধৃত করা গেল, যথা- 

সেব্যসেবকভাবেষু প্রতিমালক্ষণম্ স্মৃতম্। 

মূর্তি ও প্রতিমার যে-সকল লক্ষণ মান পরিমাণ ইত্যাদি দেওয়া হইল তাহা যে-সকল প্রতিমার সহিত শিল্পীর পূজকের বা প্রকিষ্ঠাতার সেব্য ও সেবক, প্রভু ও দাস, অর্চিত ও অর্চক সম্বন্ধ কেবল তাহাদেও জন্যই নির্দিষ্ট এবং কেবল সেইরূপ মূর্তিই যথাশাস্ত্র সর্বলক্ষণসম্পন্ন করিয়া গঠন করিতে হয়। অন্য সকল মূর্তি, যাহার পূজা কেহ করিবে না, তাহাদের শিল্পী যথা-অভিরুচি গঠন করিতে পারে (অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৪ : ২৯)

অনেকেই হালকা চালে ভাবতে অভ্যস্ত যে, ভারতীয় শিল্প চেতনা অনেক বেশি অবাস্তব, আধ্যাত্মিক, অপার্থিব বিষয়াবলির মিশ্রণে সৃজিত, তুলনায় পশ্চিমের শিল্পচেতনা অনেক বেশি বাস্তবমুখী, জাগতিক এবং প্রকৃতি অনুসারি; কিন্তু সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে ইউরোপীয় গির্জা প্যাগোডায় যেসব কাহিনি চিত্রিত হয়েছে সেসব কি কোনো পার্থিব বিষয়ের চিত্রায়ন? পক্ষান্তরে শাস্ত্রীয় নিয়মানুসারে আমরা দেখতে পাই একজন চিত্রশিল্পীর সাধনা অবশ্যই বাস্তুবানুগ এবং যথাযথ হতে হবে। যাকে তাকে এখানে চিত্রশিল্পী বলার অবকাশ নেই, কেননা চিত্রশিল্পী হিসেবে সেই বিবেচিত হবার যোগ্যতা বর্ণিত আছে বিষ্ণুধর্মোত্তরে : ‘He who paints waves, flames, smoke and streamers fluttering in the air, according to the movement of the wind, should be considered a great painter.’(Stella Kramrisch 1928 : 61) কাজেই শিল্প এবং শিল্পী উভয়ই এখানে সাধনা ও অধ্যয়নের অংশ। শুধুই রঙলেপা দিয়ে এদেশে শিল্পী হয়ে ওঠার কোনো সাক্ষ্য প্রামাণিক গ্রন্থসমূহ সমর্থন করে না।

এদেশীয় শিক্ষার্থীদের ব্রিটিশ পদ্ধতিতে চিত্রদীক্ষার অসারতা যিনি খুব ভালো করে অনুভব করেছিলে এবং গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে যিনি পারসি ব্রাউনের আগে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন সেই ই. বি. হ্যাভেল তার ‘The Ideals of Indian Art’ গ্রন্থে স্পষ্ট ভাষায় বলে গেছেন : : It is only in the East that art still has a philosophy and still remains the great exponent of national faith and race traditions (E. B. Havell 1911 : 5) তাই এদেশের শিল্পকলাকে বোঝার জন্য দেশের জনসাধারণের বিশ্বাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং এর দর্শন ধারার গতি-প্রকৃতিকে অধ্যয়নের বিষয় করতে না পারলে বঙ্গীয় শিল্পকলাকে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভবপর হয়ে উঠবে না। আমাদের শিল্পকলা জীবনের অন্যান্য অংশের সঙ্গে যতখানি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ইউরোপে ঠিক তেমটি নয়। ইউরোপের পৃথিবীকে যেভাবে নিজের থেকে বিযুক্ত করে দেখে বাংলায় তার বিপরীত পদ্ধতি। এখানে ‘আত্মনং বিদ্ধির যে অনুশীলন চিত্রকলা তার থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বঙ্গীয় চিত্রধারাকে তার সঠিক পরিচয় ও সমৃদ্ধ ধারায়, সঠিক আত্ম পরিচয়ে গৌরবান্বিত করার জন্য আমাদের পথ ঔপনিবেশিক শক্তির দেখিয়ে দেয়া রাস্তা নয়। আমাদের পথ সযত্নে লিপিবদ্ধ আছে প্রাচীন শাস্ত্রীসমূহের পরতে পরতে। তাদের সঠিক উপলব্ধি এবং যথাযথ উদ্ধার প্রক্রিয়ার উপরেই নির্ভর করছে বাংলার চিত্রকলার ভবিষ্যৎ।  

তথ্যসূত্র :

১. অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় (১৩৮৯), ভারত শিল্পের কথা, সাহিত্যলোক, কলকাতা

২. অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৪), ভারতশিল্পে মূর্তি, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, কলকাতা

৩. সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত (২০০৬), ভারতীয় প্রাচীন চিত্রকলা, চিরায়ত প্রকাশন, কলকাতা

৪. বারনারড কোহন (২০২০), উপনিবেশিকতাবাদ এবং জ্ঞানচর্চার আঙ্গিক সাম্রাজ্যেও মন ও মান ভারতে ব্রিটিশ, (অনুবাদ : বিশ্বেন্দু নন্দ), ডাকঘর, রংপুর

৫. বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯৮৬),বাংলা শিল্প সমালোচনার ধারা, (সম্পাদক : শোভন সোম অনিল আচার্য), অনুষ্টুপ প্রকাশনী, কলকাতা

৬. শ্যামাচরণ শ্রীমানী (১৯৮৬),বাংলা শিল্প সমালোচনার ধারা, (সম্পাদক : শোভন সোম অনিল আচার্য), অনুষ্টুপ প্রকাশনী, কলকাতা

৭. শোভন সোম অনিল আচার্য (১৯৮৬), বাংলা শিল্প সমালোচনার ধারা, অনুষ্টুপ প্রকাশনী, কলকাতা

8.E. B. Havell (1911), The Ideals of Indian Art, E. P. Dutton and Company, New York

9 Leonardo Da Vinci (2014), A Treatise on Painting, S. Gosnell, London 

10. Stella Kramrisch (1928), Vishnudharmottara, (Part iii), Calcutta University Press, Calcutta

11. Richard Westmacott (1864), Handbook of Sculpture Ancient and Modern, Adam and Charles Black, Edinburgh 

12. George C. M.Birdwood (1880), The Industril Arts of India, Chapman and Hall Limited, Piccadilly, London

13. Macaula (1835) 

14.http://www.columbia.edu/itc/mealac/pritchett/00generallinks/macaulay/txt_minute_education_1835.html (accessed : 14 may 2020)

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫