বাংলাদেশের সাহিত্য বিষয়ক পত্রপত্রিকার জগতে দীর্ঘ ২০ বছর যাবৎ কাজ করে চলেছেন কবি ও সম্পাদক আলী আফজাল খান। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘ভিন্নচোখ’ পত্রিকার কর্মপদ্ধতি ও বিষয় বৈচিত্র বরাবরই ভিন্ন। পত্রিকা প্রকাশনায় মান রক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, সেটি বোধহয় ‘ভিন্নচোখ’ পত্রিকা দেখেই ঠাওর করা যায়। বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা তিনি প্রকাশ করেছেন বিগত দিনে। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তার সম্পাদনায় সুবিশাল ‘বাংলাবিশ্ব কবিতা সংখ্যা-মার্চ ২০২১’। সম্প্রতি সাম্প্রতিক দেশকাল পত্রিকার শিল্প-সংস্কৃতি বিভাগের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি, কথা বলেছেন- শিল্প, সংস্কৃতির সমকালিন চর্চা নিয়ে।
সৎ, মেরুদন্ডী এবং ব্যক্তিত্ববান সাহিত্যিকের জন্য সাহিত্য চর্চা সব সময়ই জটিল। জেমস জয়েস, লিও টলস্টয়, আন্তন চেকভ কিংবা বোর্হেসের মতন সাহিত্যিকরা নোবেল পাননি। জীবনানন্দ কিংবা রবীন্দ্রনাথও কিন্তু তাদের সময়ে এখানে অনেক প্রতিকূলতা, বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে এটাই কিন্তু পরিণতি, পুঁজি সব সময়ই সর্বগ্রাসী, খাইতে খাইতে কিছু না পাইলে শেষ পর্যন্ত সে নিজেরেও খায়। আগেও বলছি আমি এটা মহানায়কদের সময়কাল না, এটা পাতি নায়কদের কাল। দুর্বৃত্তায়নও চাটুকারিতা সব সময়ই ছিল, আছে, থাকবে।
‘ভিন্নচোখ’- সম্পাদনা করছেন কত দিন যাবৎ এবং এর শুরুর দিকটি যদি গুছিয়ে বলতেনআলী আফজাল: ভিন্নচোখের প্রথম সংখ্যা প্রকাশ হয় আগস্ট ২০০১ সালে, ২০ বছর হচ্ছে ভিন্নচোখের আগস্টে। প্রথম সংখ্যা ট্যাবলয়েড আকারে ছিল, নিউজপ্রিন্টে। তখন আমি এবং টিম ভিন্নচোখের সবাই স্টুডেন্ট। এখনকার মতো এত পরিকল্পিত সংখ্যা ছিল না সেটা, তবে নতুন চিন্তার ছাপ ঠিকই ছিল বলে মনে হয়। সব ধরনের লেখাই ছাপা হচ্ছিল তখন ভিন্নচোখে, তবে শিল্প-সাহিত্য-দর্শন এবং সমসাময়িক বিষয়গুলো আমরা শুরু থেকেই রাখতাম। পোস্টমডার্ন ভাবুকদের প্রচুর অনুবাদ তখন ছাপা হয়েছে ভিন্নচোখে, নতুন লেখকদের প্রচুর লেখাও। আর বোধনের পর থেকেই ভিন্নচোখের সাথে শিল্পীদের একটা নিবিড় সম্পর্ক বরাবর। খুব অল্প সংখ্যক বিজ্ঞাপন আর বন্ধুদের চাঁদা দিয়েই মূলত: সংখ্যা বের করতাম তখন। এখনও কারও কারও কাছে এসব পুরনো সংখ্যা আছে, মাঝে মাঝে ফোন পাই বা ইনবক্স করেন কেউ কেউ। জানতে চান এই ভিন্নচোখ সেই ভিন্নচোখ কিনা। প্রথম সংখ্যার পর থেকেই ভিন্নচোখ ম্যাগাজিন সাইজে বের হচ্ছে। ২০০৪ সাল পর্যন্ত নিউজপ্রিন্টেই প্রকাশ হয়েছে, তারপর তো ২০১৩ সাল পর্যন্ত ভিন্নচোখের কার্যক্রম বন্ধই ছিল, দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ২০১৩ সালে। শুরুতে যারা কাজ করতো তাদের অধিকাংশ এখন আর নাই, দেবাশীষ সিকদার দেবু আর নকিব বিয়াই এখনও রয়েছেন। বাকিদের কেউ কেউ মানসিকভাবে থাকলেও সময় দিতে পারেন না আগের মতো।
ছোটকাগজ এবং পত্রিকার মধ্যে একটি বিশেষ তফাৎ রয়েছে, ছোটকাগজগুলোতে যে ধরনের লেখা প্রকাশ করা হয়- সে সকল লেখা বাজারের পত্রিকাগুলো প্রকাশ করতে পারে না, এক ধরনের বাঁধার সৃষ্টি হয়। সেই দিক থেকে ‘ভিন্নচোখ’- ঠিক কীভাবে সাহিত্য চর্চায় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন?
আলী আফজাল: ছোট কাগজ আর বড় কাগজ এইসব বাইনারী অপজিশনগুলো খুব সমস্যাজনক মনে হয় আমার কাছে, তদুপরি সাম্প্রতিক সময়ে এদের চেহারা চরিত্রের খুব পার্থক্য আমার চোখে পড়ে না। ছোট কাগজ বলেন আর বড় কাগজ বলেন- লেখা ছাপা হলেই সেটা সবাই ফেসবুকে নিজের ওয়ালে সেটে দিচ্ছেন, পাঠক পড়ে নিচ্ছেন। বাজারের পত্রিকাগুলোও আগের রূপে নাই, তেমনি ছোট কাগজ যাদের বলছেন তারা নিজেদের আলাদা করতে পারছে না আর। নব্বইয়ের পর গত দুই দশকে বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারী কোনো লিটলম্যাগের নাম আপনি বলতে পারবেন না। আপনার প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশে আসি এবারে, সাহিত্য চর্চায় ভিন্নচোখ কি ভূমিকা রাখছে সেটা আসলে সময় বলবে; তবে দু-একটা উদাহরণ দিচ্ছি আমি। উন্নয়ন, উন্নয়ন বলে এখন আপনারা অনেক চিৎকার, চিল্লাচিল্লি শুনেন। এটা শুরু হয়েছে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর, মানে ২০০৯ সালের পরের ঘটনা। অথচ ভিন্নচোখ ২০০৪ সালে যে সংখ্যা করছে সেটা ছিল ‘উন্নয়ন ও রাজনীতির সংলাপ’ নিয়ে। সংখ্যাটা পড়লেই আপনি বুঝবেন এইসব আলাপ আরও ২০/৩০ বছর প্রাসঙ্গিক থাকবে। ২০১৭ সালে অনুর্ধ্ব ৩০ বছরের ৫০ জন প্রতিশ্রুতিশীল কবিকে নিয়ে হয়েছে ‘প্রজন্মের কবিতাসংখ্যা’। ধারণা করি বাংলাদেশের কবিতাজগৎ আগামি সময়ে এরাই দাপিয়ে বেড়াবে। আর বর্তমান ‘বাংলাবিশ্ব কবিতাসংখ্যা’ তো আগামি একশ বছর কবিতাপ্রেমীদের আশ্রয় হয়ে থাকবে বলে আমি মনে করি।
‘ভিন্নচোখ’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেই আপনাকে প্রশ্ন করছি- পূর্বে বেশ কয়েকটি বৃহৎ সংখ্যা প্রকাশ করেছেন; যেমন বলা যাবে- ভাষা সংখ্যা, কবিতা সংখ্যা, শিল্প ও শিল্পী সংখ্যা- বৃহৎ আয়তনের এই সংখ্যাগুলোর ইমপ্যাক্ট কেমন ছিল আর এর প্রতিচর্চা কিংবা একই আদলে পরবর্তীকালে আর কোনো চর্চা কী দেখা গিয়েছে?
আলী আফজাল: সাম্প্রতিককালে ভিন্নচোখ হয়ে উঠছে বাংলা ভাষায় একমাত্র আন্তর্জাতিক মানের পত্রিকা, একই কাতারে দাঁড়াতে পারবে এমন আর একটা পত্রিকাও আপনি দেখাতে পারবেন না। ফলে অনুসরণকারী বলেন আর অনুকরণকারী বলেন এসব তো কিছু তৈরি হয়েছেই। কেউ কেউ ভিন্নচোখের মতোই সংখ্যা করার চেষ্টা করছেন। প্রজন্মের কবিতাসংখ্যা যখন করি বেশ কয়েকটি লিটলম্যাগ একইভাবে তরুণদের নিয়ে সংখ্যা করেছে, বাংলাবিশ্ব কবিতাসংখ্যার মতো একশ কবি নিয়ে কেউ কেউ কাজ করছে, ভাষা সংখ্যা আরও অনেকেই করছে। তারা এগুলো ঈর্ষায় করুক আর প্রতিযোগীতা করে করুক বা আইডিয়া চুরি কইরা করুক, সে যাইহোক, এগুলো পজিটিভ ইমপ্যাক্ট বা প্রতিচর্চা বলতে পারেন।
বর্তমান সংখ্যাটি ‘বিশ্ববাংলা কবিতা’ সংখ্যা- এ সংখ্যাটির বিষয়ে বিস্তারিত বলবেন, কিভাবে এই কর্ম প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলো?আলী আফজাল: বাংলাদেশের ৪০ জন প্রতিনিধিত্বশীল জীবিত কবি নিয়ে ২০১৪ সালের বইমেলায় ভিন্নচোখ প্রকাশ করে ‘বাংলাদেশের কবিতাসংখ্যা’। তখন থেকেই পরিকল্পনা ছিল ভারত ও বাংলাদেশের কবিদের নিয়ে ইংরেজি অনুবাদসহ আরেকটা সংখ্যা করার। ২০১৪ সালের বইমেলার পর ভারতের কবি প্রবাল কুমার বসুর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। প্রবালদা বাংলাদেশের কবিতাসংখ্যা দেখে চমকে ওঠেন। দুই বাংলা মিলিয়ে একটা সংখ্যা করার প্রস্তাব দেন। কেন তিনি সংখ্যাটা দেখে চমকে উঠেছিলেন, তা বুঝতে পারি ২০১৮ সালে যখন আমি কলকাতায় তাঁর যাপনচিত্র অফিসে যাই, আর তিনি তাঁর সম্পাদিত ‘Signposts’ সংকলনটি দেন। কৌতূহলী পাঠকও সহজে বুঝবেন, দুটি সংকলন হাতে নিলে দুই ভূগোলে দুই পরস্পরবিচ্ছিন্ন সম্পাদক কতটা চিন্তার কাছাকাছি। প্রবালদাকে প্রস্তাব দিই প্রজেক্ট শুরু করার। ২০১৯ সাল থেকে আসলে ‘বাংলাবিশ্ব কবিতাসংখ্যা’র কাজ শুরু হয়।
এই সংখ্যা ভিন্নচোখের ২০ বছর পূর্তি সংখ্যা। বাংলা ভাষার জীবিত প্রতিনিধিত্বশীল কবি যাঁদের আছে বাংলা কবিতায় নিজস্ব কণ্ঠস্বর ও স্বাক্ষর, তাঁদের মধ্যে ১০০ জন কবির জীবনী, কবিতাভাবনা ও একগুচ্ছ কবিতা নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘বাংলাবিশ্ব কবিতাসংখ্যা’। এতে প্রতিটি কবির কবিতাজগৎ অনেকখানি পরিষ্কার হয়ে উঠবে এবং বাংলা কবিতার প্রবহমান রক্তস্রোতের পালস ধরা পড়বে। বলতে পারি, সংখ্যাটা বাংলা কবিতার ভং, ভঙ্গি ও ভাস্বরতার নানামুখী চলতি প্রবণতার হাইলাইটস অথবা ফ্যাশন, ফেইথ অ্যান্ড ফ্যান্টাসি। এ সংকলনের কালসীমা আমরা নির্ধারণ করছি শূন্য দশক পর্যন্ত। কারণ, এর পরবর্তী সময়ের কবিতা এখনো আকার পাওয়ার পথে। যুগলবন্দিতে কবিদের পোর্ট্রেট আঁকছেন ৬টি দেশের বরেণ্য ৭৫ জন চিত্রশিল্পী। অধিকাংশ কবিই তাঁদের স্বনির্বাচিত সেরা/পছন্দের কবিতাগুলো দিয়েছেন, অগ্রজদের কেউ কেউ সময় দিতে পারেননি, অনুমতিক্রমে তাঁদের কবিতাসমগ্র বা শ্রেষ্ঠ কবিতা থেকে কবিতা বেছে নেওয়া হয়েছে। অনেকে সময়ের অভাবে, আবার কেউ কেউ মনে করেন, তাঁদের কবিতাই কবিতাভাবনা, তাঁরা কবিতাভাবনা পাঠাননি। কবিদের ক্রমবিন্যাস করা হয়েছে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে।
বাংলাদেশের অনেক বিখ্যাত শিল্পী রয়েছেন, যেমন ধরেন জয়নুল আবেদীন, শাহাবুদ্দীন বা মনিরুল ইসলামসহ অনেকে, কিন্তু এদের কারও পেইন্টিংস ব্যবহার না করে এই সংকলনের প্রচ্ছদে কেন এস এম সুলতানের পেইন্টিংস ব্যবহার করেছেন? আপনাদের এ বিষয়ে বিশেষ কোনো দৃষ্টিভঙ্গি আছে কিনা?
আলী আফজাল: খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই সুলতানের ছবি ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট দার্শনিক কারণ রয়েছে। ভিন্নচোখ মনে করে এই অঞ্চলের শিল্পের পাওনিয়ার কন্ঠস্বর হচ্ছেন সুলতান। পশ্চিমের শিল্পীদের শিল্প দর্শন আর পূর্বের শিল্পীদের শিল্প দর্শন এক নয়। ওয়েস্টার্ন আর্টে দেখবেন বস্তু বা ব্যক্তিই মুখ্য, বিশাল বিশাল ফিগার। কিন্তু ভারত অঞ্চলে যে শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল তা ভাব প্রধান, এ অঞ্চলের শিল্পের সাথে প্রতিবেশ পরিবেশের সাথে মানুষের আন্তঃসম্পর্কগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু উপনিবেশায়নের ফলে ভারত শিল্পকলায় পশ্চিম ঢুকে পড়ে, ভারত শিল্পকলার শিকড়ের সাথে এখানকার শিল্পীদের আত্মার বিচ্ছেদ ঘটে যায়। সুলতান শুধু বিউপনিবেশায়ন নিয়ে ভাবেন নাই, ওই যে আত্মার সাথে বিচ্ছেদ হলো সেই আত্মার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে আধুনিক ভারতকলা চর্চার একটা পথ তৈরি করেছেন। সুলতানের ছবিতে দেখবেন বিশাল বিশাল ফিগারের সাথে পরিবেশও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভারত কলার আত্মার সাথে বিচ্ছেদ হওয়া শিকড় তিনি পেয়েছেন অজন্তা ইলোরার শিল্প কৌশল থেকে। তো বাংলাবিশ্বের আইকন শিল্পী ভিন্নচোখের কাছে মনে হয়েছে এস এম সুলতান, এজন্যই প্রচ্ছদে তাঁর-ই পিইন্টিংস।
আপনার নিজস্ব সম্পাদনা চিন্তার সঙ্গে অন্যান্য পত্রিকাগুলির তফাৎ কি ধরনের বলে মনে করেন?
আলী আফজাল: পার্থক্য চিহ্নিত করা আসলে আমার কাজ না। শুধু এটুকু বলি, লেখা আহ্বান করলাম, সবাই গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ পাঠাইলো আর সেগুলো কম্পাইল করে, সাথে দু’একজন সিনিয়রের লেখা জোগাড় করে একটা পত্রিকা প্রকাশ করে ফেললাম, ভিন্নচোখের যেকোনো সংখ্যা দেখলেই বুঝবেন এসব থেকে একদম আলাদা ভিন্নচোখ। প্রতিটি সংখ্যার লেখা আমন্ত্রিত, সংখ্যার প্রয়োজনে লেখকদের দিয়ে লেখা তৈরি করাও। ভাষা সংখ্যার লিড আর্টিক্যাল লিখেছিলেন সলিমুল্লাহ খান, তো এই লেখার জন্য টানা ছয় মাস উনার পিছনে লেগে থাকতে হয়েছে আমাকে, সাক্ষাৎকার সংখ্যায় প্রকাশিত গায়ত্রী স্পিভাকের সাক্ষাৎকার অনুবাদের জন্য কবি জুয়েল মাজহারকে টানা ৪ মাস জ্বালাইছি রাত-দিন। বাংলাবিশ্ব কবিতাসংখ্যা টানা তিন বছর কাজ করে শেষ করলাম, প্রায় ২০০ কন্ট্রিবিউটর ছাড়াও এই সংখ্যা করতে গিয়ে প্রায় ৫০০ মানুষের সাথে আমার কাজ করতে হয়েছে। অপরিসীম প্রেম এবং ধৈর্য্য না থাকলে এগুলো আসলে অসম্ভব, আর মাথাটাও-তো ভিন্নই, সেকেন্ড কপি পাবেন না।
আপনার সাহিত্য চর্চার সময়কাল নব্বই দশক সম্ভবত যদি ভুল না করে থাকি, সেই সময় আর এই সময়ের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের পরিবর্তন এবং চর্চার ক্ষেত্রগুলোকে যদি বলি ব্যাখ্যা করুন- সঙ্গে এ-ও বলি সাহিত্যের ‘পিওর প্রাকটিস’-এর জায়গা থেকে বোধহয় অনেকখানি সরে এসেছে একাল। এখন মিডিয়াতে নিজেকে তুলে ধরবার একটা বিশেষ আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় লেখক-শিল্পীদের, এবং সেটি নিজের কাজ ছাড়াই হয়ে থাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। এই বিষয়গুলো যদি বলতেন...
আলী আফজাল: সাহিত্য চর্চার দশকের হিসাবে আমি বিশ্বাসী না, এইগুলো ছোটরে বড় করে দেখানোর কৌশল মাত্র বা সাহিত্য রাজনীতির আরেকটা রূপ, তবু যদি দশক হিসাব করেন আমি নব্বই না, শূন্য দশকের। আগে বলে রাখি, ‘পিওর’টির কনসেপ্টাই সমস্যাজনক। অরিজিন্যাল, পিউর, মৌলিক- এসব আসছে পশ্চিম থেকে, ভারতীয় দর্শন পিউরিটিকে কখনও ভাল বলে নাই, খারাপই ছিল এসব আমাদের এখানে। শিল্প-সাহিত্যে মৌলিক বলে কিছু হয়?
আপনি বলছিলেন পরিবর্তনের কথা। গত দুই দশকে যে পরিবর্তনগুলো ঘটেছে তা গত দুইশ বছরেও ঘটেনি আসলে, আমি বলছি সাম্প্রতিক সময়ে পরিবর্তনগুলো খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছে। বন্ধুদের আমি প্রায়ই বলি, আসলে আমরা একটা ট্রানজিশন জেনারেশন, এনালগ থেকে ডিজিটালের ট্রানজিশন পিরিয়ডটার সাহিত্যিক আমরা। আমরা সাহিত্য চর্চা শুরু করছিলাম পাঠচক্র দিয়ে, নিয়মিত আজিজে যেতাম তখন, নানা পাঠচক্রের তৎপরতা ছিল নতুনকে জানার, অনেক হিউম্যান ইন্টার্যাকশ ছিল তখন। এগুলো এখন ফেসবুক গ্রুপে পরিণত হয়েছে, ইন্টার্যাকশনগুলো ইমোতে পরিণত হয়েছে। সবকিছুই এখন খুব ভোলাটাইল, ভাসা ভাসা, গভীরে গেলে কিছু পাবেন না আপনি, আমি বলি কাগুজে বাঘ। সোস্যাল মিডিয়ার বিশাল বাঘটারে বাস্তবে দেখলে বুঝবেন সেটা আসলে একটা মেনী বিলাই। যেটা আপনি বললেন, কাজ না করেই কথার বাহাদুরী, পরিচিতি সিন্ডিকেট এসব দিয়ে মিডিয়াতে নিজেকে ফুলায়া এমন বড় করে যেন অলঙ্ঘ্য পাহাড় মনে হয়। এগুলো আসলে বেলুন, কাজের সূঁচ পড়লেই ফাইটা আকাশে উড়াল দেয়। কথা বেশি বলা আমার স্বভাবেই নাই, নিজের কাজ দিয়েই পরিচয় দিতে পছন্দ করি, বন্ধুরা এজন্য নাম দিছে আমারে ‘সাইলেন্ট কিলার’। সোনার খনি থেকে মানুষ সোনা আহরণ করতে কিন্তু ৩ হাজার ফুট মাটির গভীরেও চলে যায়, কাজেই যেগুলো কালের ধোঁয়া সেগুলো এমনিতেই সময়ের বাতাসে মিলিয়ে যাবে। আবার এত এত মিডিয়া হয়ে গেছে যে আসলেই কে শুনে বা দেখে কার কথা? আমি বলি একালে মহানায়ক হবে না, এটা পাতি নায়কদের কাল।
সমকালে সাহিত্যের দুর্বৃত্তায়ন, চাটুকারিতা, ভাঁড়ামো এই বিশেষ তিনটি বিষয় বেশ জেঁকে বসেছে। আমলাতান্ত্রিক সাহিত্য চর্চা একালে একটি বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। এটি পূর্বেও ছিল, কিন্তু সেটা ছিল গুণীদের কদরের কাল, জ্ঞানীদের সম্মান করবার সময়- এখনকার সময়টি আপনার মুখে শুনতে চাই?
আলী আফজাল: সৎ, মেরুদন্ডী এবং ব্যক্তিত্ববান সাহিত্যিকের জন্য সাহিত্য চর্চা সব সময়ই জটিল। জেমস জয়েস, লিও টলস্টয়, আন্তন চেকভ কিংবা বোর্হেসের মতন সাহিত্যিকরা নোবেল পাননি। জীবনানন্দ কিংবা রবীন্দ্রনাথও কিন্তু তাদের সময়ে এখানে অনেক প্রতিকূলতা, বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে এটাই কিন্তু পরিণতি, পুঁজি সব সময়ই সর্বগ্রাসী, খাইতে খাইতে কিছু না পাইলে শেষ পর্যন্ত সে নিজেরেও খায়। আগেও বলছি আমি এটা মহানায়কদের সময়কাল না, এটা পাতি নায়কদের কাল। দুর্বৃত্তায়নও চাটুকারিতা সব সময়ই ছিল, আছে, থাকবে। তবে ভাঁড়ামোকে বিশেষ মর্যাদা দান এই সময়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্য, হিরো আলম, টিকটক অপু বা মোটিভেশনাল সাজিদ- এদের প্রত্যাখান না করে বরং আমাদের সময়টাকে বোঝার আছে। আমি মনে করি সমাজে বিদ্যমান অসাম্য এবং অবিচারের প্রতি এসব বিশেষ বার্তা। স্ল্যাং ব্যবহার করে বা ধর্মীয় অনুষঙ্গ ব্যবহার করে কেউ কেউ কেন জনপ্রিয় তার সমালোচনার আগে এই সমাজ এবং পাঠক সাইকোলজি বোঝা দরকার। যে বিষফোঁড়া সমাজ দেহে লালন করে চলতেছিলাম আমরা সেগুলো ফাইটা যাইতেছে, শ্লেষ-বিদ্রুপ রূপে ছড়াইতেছে। কেন একজন এলএসডি বিক্রেতার উপর তরুণীরা ক্রাস খাচ্ছে সেটা না বুঝে এড়িয়ে বা প্রত্যাখ্যান করে গেলে বিষ থেকেই যাবে। এমন একটা সময় এখন যখন খল নায়কই নায়ক। আগে তো চুরি হতো, এখন হয় ডাকাতি। একজন অসৎ মানুষ আগে চোরের মতো পলায়া থাকতো, এখন দেখেন তারা বুক ফুলায়া হাটে, মঞ্চে ওঠে। সবাই হাত তালি দিচ্ছে। যে মানুষটা সৎ, মেরুদন্ডী এবং ব্যক্তিত্ববান, সে-ই এই সময়ের অযোগ্য।
ভিন্নচোখ- কোনো বিশেষ মতকে সমর্থন করে কী, ভবিষ্যতে এর কর্ম পরিকল্পনা কেমন হবে?
আলী আফজাল: সেই অর্থে কোনো বিশেষ মতকে সমর্থন করে না ভিন্নচোখ, তবে টিম ভিন্নচোখের আমরা সবাই স্বাধীন দেশে জন্ম নেওয়া জেনারেশন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী কোনো কিছুকে আমরা সমর্থন করি না এবং যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী তাদের কাছ থেকেও দূরে থাকতে চাই। যেমন ধরেন, ২০১৪ সালে বাংলাদেশের ৪০জন জীবিত কবিকে নিয়ে ভিন্নচোখ প্রকাশ করে ‘বাংলাদেশের কবিতাসংখ্যা’, তখন আল মাহমুদ জীবিত, কিন্তু এই সংখ্যায় ভিন্নচোখ আল মাহমুদকে আন্তর্ভুক্ত করেনি। এছাড়া মত বা পথ তো আসলে সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল, সেসবে স্থির ঈমান রাখা মুশকিল।
বাংলাবিশ্ব কবিতাসংখ্যায় লিখছি, ভিন্নচোখের রজতজয়ন্তী উদ্যাপন করার ইচ্ছা ইংরেজি অনুবাদসহ ‘বাংলাবিশ্ব কবিতাসংখ্যা’ প্রকাশ করে, আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছে বাংলা কবিতার বহমান স্রোত পৌঁছে দিতে চাই। খুব দ্রুতই বাইলিঙ্গুয়াল সংখ্যাটির কাজ শুরু হবে, আগের মতই কিছু পরিবর্তনও অবশ্যই থাকবে, কিছু সংশোধন বা যোজন-বিয়োজন হবে কবি তালিকায়।
বর্তমান সংখ্যার প্রচার-প্রসারে আপনার ভাবনা কী, যেটির মাধ্যমে আরও কিছু কর্মযোগ হতে পারে ‘ভিন্নচোখ’-এর; আর এ সংখ্যাটি কেন পাঠক সংগ্রহ করবেন সে বিষয়ে আপনার ভাবনাটি বলবেন কী?আলী আফজাল: প্রচার-প্রসারে ভিন্নচোখ খুব পটু না, আর যেহেতু কোনো চাক বা ছাঁচে আমরা বিশ্বাসী না ফলে কেউ আমাদের তাদের দলের মনে করে না, সবারই প্রতিপক্ষ ভিন্নচোখ, অথচ বিপরীত হওয়ার কথা ছিল। মেরুদন্ড ভেঙে তোষামদ বা চাটুকারীতাও যেহেতু করতে পারি না ফলে মিডিয়া এই সংখ্যা প্রকাশের দুই মাস অতিক্রান্ত হলেও তেমন কোনো সংবাদ বা আলোচনা এখনও প্রকাশ করে নাই। মাঝে মাঝে আমার মনে প্রশ্ন জাগে এই যে এত এত মিডিয়া তাদের কাজ কি আসলে? বইমেলা চলাকালীন সময়েই বাংলাবিশ্ব কবিতাসংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে, আর মেলা চলাকালীন শয়ে শয়ে মিডিয়া থাকে সেখানে, হাজার হাজার মিডিয়া কনটেন্ট উৎপাদন করে তারা, রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়ার পর বাংলা কবিতার সবচেয়ে বড় ঘটনা ভিন্নচোখের ‘বাংলাবিশ্ব কবিতাসংখ্যা’, সেটা নিয়ে কোথাও কোনো আওয়াজ নাই। আমাদের যেটুকু ক্ষমতা আছে সেটুকু দিয়ে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, নিয়মিত ফেসবুক পোস্ট হচ্ছে আমার প্রোফাইল থেকে, ভিন্নচোখের পেইজ এবং গ্রুপ থেকে। মেলা চলাকালীন সময়ে আমরা একটা কুইজের আয়োজন করছিলাম, মেলার আগে ২৫টা লাইভ করছি ভিন্নচোখের পেজ থেকে। আরও কিছু লাইভ করার ইচ্ছা আছে, পাশাপাশি বিভাগীয় শহরগুলোতে টিম ভিন্নচোখ যাবে সংখ্যাটার প্রচার ও প্রসারের জন্য। অনেকেই রিভিউ করতে চাইছেন, সেগুলা প্রিন্ট এবং অনলাইনে আস্তে আস্তে প্রকাশ হবে, এটা তো একশ মিটির স্প্রিন্ট না, ম্যারাথন রেস, আস্তে আস্তে হবে।
এখন আসি আপনার প্রশ্নে দ্বিতীয় অংশে, বাংলা কবিতা নিয়ে এত বড় কাজ বাংলাদেশ বা ভারত কোথাও হয়েছে বলে আমাদের জানা নাই। কেবল জীবিত কবিদের নিয়ে সংকলনটি করায় পাঠক এই সংখ্যায় বাংলা কবিতার প্রবহমান রক্ত¯্রােতের পালস ধরতে পারবে, বাংলা কবিতার একটা রূপরেখা পাবেন। সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং কবিতাভাবনাসহ প্রত্যেক কবির এক ফর্মা করে কবিতা আছে এখানে, এতে পাঠকের কাছে প্রতিটি কবির কবিতাজগৎ অনেকখানি পরিষ্কার হয়ে উঠবে। সংখ্যাটা বাংলা কবিতার ভং, ভঙ্গি ও ভাস্বরতার নানামুখী চলতি প্রবণতার হাইলাইটস অথবা ফ্যাশন, ফেইথ অ্যান্ড ফ্যান্টাসি। ফলে বাংলা কবিতার এই আকরগ্রন্থটি কবিতাপ্রেমীদের কাছে তো বটেই কবিতা নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের কাছেও অনিবার্য আশ্রয়স্থল হয়ে থাকবে আগামী অন্তত: একশ বছর এটা ভিন্নচোখ বিশ্বাস করে।
এখনকার সময়ে ভাষার চর্চা, প্রতিষ্ঠানের জ্ঞান চর্র্চা, সৃজনশীলতা, ছোটকাগজের নতুন ভাবনা- কেন যেন হারিয়ে গিয়েছে- এই বিষয়গুলো সম্পর্কে বলুন-
আলী আফজাল: কোনো কিছু হারিয়ে যায় না আসলে, রূপান্তর ঘটে কেবল। আপনার চেনা চেহারায় দেখছেন না বলে মনে হচ্ছে হারিয়ে গেছে। ভাষার চর্চা আগের চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে এখন, আমি বলব সোস্যাল মিডিয়া আসার পর বাংলা ভাষা চর্চার রীতিমত বিপ্লব ঘটে গেছে, খুব কম ভাষায়ই এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে আপনি সাইবার ওয়ার্ল্ডে পাবেন। জ্ঞান চর্চা আর সৃজনশীলতা আগে যে রূপে দেখতাম আমরা তা বদলে গেছে, ছোটকাগজগুলোর সৃজনশীল ভার্সন আসলে ওয়েবজিন, ব্লগজিন- এগুলো। গত দুই দশকে বাংলাদেশে প্রভাবশালী কোনো লিটলম্যাগের নাম বলতে পারবেন? তার মানে আমি এটা বলছি না প্রিন্ট মিডিয়া হারিয়ে যাবে, বরং আমি ডিজিটাল মিডিয়াকে প্রিন্ট মিডিয়ার সম্পূরক মনে করি। নেটিজেনরা কাজের ধরন এবং লাইফস্টাইলে এত দ্রুত বদল নিয়ে আসছে যে আমরা তাতে আত্মস্থ হওয়ারও সময় পাচ্ছি না। প্রশ্নহীনভাবে এক তরফা গ্রহণও সমস্যাজনক, কোনো একটা জিনিসের ভাল মন্দ আসলে কিছুটা সময় না গেলে বোঝাও যায় না। চালচিত্র, খড়িমাটি, দ্রষ্টব্য, শালুক, জলধি, লোক, অণুপ্রাণনসহ আরও বেশকিছু লিটলম্যাগ এখনও চেষ্টা করছে ভাল কাজ করার। আমি পজিটিভ মানুষ, তাই আশা রাখি বাংলায়, বাংলা ভাষায়।