
প্রতীকী ছবি
বেড়াল- অনেকের কাছে ভয়াবহ আতঙ্কের নাম, আবার অনেকের কাছে পেঁজা তুলোর ভালোবাসা! আমি যখন অনেক ছোট, তখন থেকেই এই অবলা প্রাণগুলোর প্রতি আমার ছিল এক দুর্নিবার আকর্ষণ! ফুড়ুৎ করে উড়ে যাওয়া চড়ুই পাখিকে ধরবার অদম্য বাসনা আমায় সবসময় তাড়িয়ে বেড়াতো। আম্মা বলতো- এই, তুই বেড়াল নাকি? অমন করিস কেন পাখি দেখলে? আমি নাকি হেসে কুটিকুটি হতাম আর বলতাম- আমি মিউ!
প্রথম জীবনে পাখি পালতাম। খাঁচাভর্তি হরেক রকম পাখি! লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, ছাই- কত রঙ। কত কত নাম- বায়না করে ছাদে গিরিবাজ কবুতরও বসিয়েছিলাম একপাল। পড়াশোনা মাথায় উঠল আর আম্মার হাতে বেত! তবুও দুপুর হলে কে আটকায় আমাকে- কত স্বপ্ন চোখে আমি ছুটে বেড়াতাম এদের মাঝে! কিন্তু ওই- বুকে চেপে তো আর আদর করা যায় না! অব্যক্ত এক বেদনা কুড়ে কুড়ে খেতো আমায় অহর্নিশি! ভালোবাসা খুঁজতে খুঁজতে কখনো বুঝিনি- আমি আসলেও বেড়াল! সকালে যখন স্কুলে যেতাম, তখন একটা কুকুর প্রতিদিন পিছু নিতো; কিন্তু কখনো গলির শেষ মাথায় এসে সে আর স্কুলভ্যানের পেছনে আসতো না। সকালে নাস্তার রুটি চুরি করে তাই পকেটে নিতাম, ওকে দেবো বলে। বেশ ন্যাওটা হয়ে গেলো ক’দিনের মাঝেই! নাম দিলাম- গুণ্ডা। আমার জীবনের প্রথম প্রেম। প্রতিদিন সে আমাকে এগিয়ে দিতো আবার স্কুল শেষে ফিরবার পথে বসে থাকত। বিকেলে যখন মাঠে যেতাম খেলতে, আস্তে আস্তে সাহস করে সেও যাওয়া শুরু করল। তারপর- বাকিটা ইতিহাস! আমি আর আমার গুন্ডা সারাপাড়া মাতিয়ে বেড়াতাম; কিন্তু দিন শেষে যেমন রাত আসে খুশির পরও বেদনা, তেমনি গুণ্ডাও একদিন আমাকে ছেড়ে চলে গেল। উহ্! কী সে কষ্ট! মেডিকেলে পড়বার সময় আবার পাখি পালা শুরু করলাম। বাড়ি ভর্তি লোকজন নানা কথা বলতো। একান্নবর্তী পরিবার না হলেও সারা বছর মামা, খালা, ফুপু, চাচা ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরে ঘুরে আসতেই থাকত! কিন্তু আমার আবার কানের ফুটো ছিল বরাবর- কথা ঢুকে সোজা বেরিয়ে যেত! গুন্ডার ভালোবাসা ম্লান হলেও মুছে যায়নি আমার মন থেকে। এরই মধ্যে মেডিকেলে পড়া শেষ- বিয়ে ঠিক! অগত্যা পাখিগুলোকে পালক দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না আমার হাতে! আবার হারালাম আমার ভালোবাসা- সেই কষ্ট, সেই পুরনো বেদনা।
বিয়ের পর সব ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু হয়তো পারিনি অবচেতন মনের কষ্টগুলো লুকোতে। একদিন রাতে ডিউটি থেকে এসে দেখি খাঁচাভর্তি পাখি! এত আনন্দ, এত আনন্দ! সময় গড়িয়ে চলল- সাহেব চলে গেলেন দেশের বাইরে। মন খারাপের দিনগুলো কেবল বাড়তেই থাকল! একদিন বিকেলে ছোট্ট একটা ঝুড়িতে করে এলো আমার- টিএনটি! কাল বৈশাখীর ঘন ছাই রাঙা মেঘের মতো এক টুকরো ভালোবাসা! যিনি দিয়ে গেলেন- বললাম কে পাঠিয়েছে ওকে? মৃদু হেসে জবাব দিলেন- স্যার! আমি আনন্দে কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। ফোন করে বললাম- বেড়াল পাঠিয়েছো? ও বললো- না, লোমওয়ালা রুমি পাঠিয়েছি! ২৩ শে নভেম্বর ২০১৬- আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিনের একটি। মানুষ যেমন নতুন বাচ্চার জন্ম হলে রাতদিন একাকার করে ফেলে, তেমনি আমিও টিনটিনকে পেয়ে আমার নাওয়া-খাওয়া ভুলে দিনরাত ওর পেছনে পড়ে রইলাম! হাসপাতালে ডিউটিতে মন টিকতো না আমার। সারাক্ষণ শুধু মনে হতো- কখন বাড়ি যাব, টিনটিনকে কোলে নেব একটু? রোগী দেখা শেষ হলে পড়িমরি করে ছুটতাম বাসে ওঠার জন্য। মায়ের পর এই একটা জীবন আমার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকতো! কলিং বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে টিনটিন দৌড়ে ছুটে আসতো আমার কাছে। সে সময় থেকে একটু একটু করে বোঝা শুরু করলাম সন্তান আর মায়ের স্বার্থহীন ভালোবাসা! একটু একটু করে টিনটিন আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হলো! আস্তে আস্তে বেড়ে উঠতে লাগল আমার বৈশাখের মেঘের ভেলা! কিন্তু সারাক্ষণ মনমরা হয়ে পড়ে থাকত- বুঝলাম ছেলের এবার বউ লাগবে! মামুন ভাইকে বলাতে একসঙ্গে তিন তিনটি পাত্রীসহ উপস্থিত! সব থেকে সুন্দর বেড়ালের পাশে গিয়ে বসে রইলো আমার পাজি ছেলে! বুঝলাম এই মেয়ে ছাড়া তার চলবে না! এইভাবে বউমার আবির্ভাব আমার জীবনে।
দিন বয়ে চলল তার নিজের মতো করে। একদিন সকালে আমার আম্মা বলল- উমার মনে হয় বাবু হবে! আমি বলি- যাও, ধ্যাত! কীভাবে সম্ভব এটা? এত ছোট্ট বেড়াল! ৮ মার্চ ২০১৭ আমাদের ঘর আলো করে এলো- পিপিন, গ্র্যানডাফ, ইভা, একেলিস, নোরা, জিউস! উফ্! ঘরভর্তি মেঘের খেলা! অফিসে মন টেকানো দায় হয়ে গেলো! চড়ুই পাখির মতো শুধুই ছটফট করি- কখন রোগী শেষ হবে? কখন বাড়ি যাব? বাড়ির দারোয়ানরা বলে- আপার সৈন্যবাহিনী! জীবন সত্যিই সুন্দর! মন খারাপের দিনে আমাকে আর মেঘ খুঁজে বেড়াতে হয় না! খুঁজতে হয় না পাশে বসে গল্প করার মানুষ! শুধু আমি আর আমার বেড়াল বাহিনী!