Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

বাংলা সাহিত্যে কদম ফুল ও বর্ষা

Icon

জোবায়ের মিলন

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২১, ১০:০৮

বাংলা সাহিত্যে কদম ফুল ও বর্ষা

প্রতীকী ছবি

ঋতুবৈচিত্র্যের এ বাংলায় ঋতুর রূপ প্রস্ফুটিত হয় ঋতুতে ঋতুতে। শরতে এক-রূপ হয় তো হেমন্তে আরেক রূপ। শীতে আসে ভিন্ন রূপ তো বসন্তে প্রকৃতি সাজে অনন্য আরেক রূপে। প্রত্যেক রূপের একটি স্বতন্ত্র অবয়ব ফুটে ওঠে যার যার আপন আঙ্গিক নিয়ে। এ রূপ কারও সঙ্গে কারোরটা মিলে না। এটাই ষড়ঋতুর বৈশিষ্ট্য। ঋতুতে ঋতুতে যে রূপ ফুটে ওঠে, সে রূপের আলো পড়ে সারা বাংলার কোণে কোণে। নদীতে-নালাতে, খালে-বিলে, ঝিলে তা-থৈ তা-থৈ নাচে যার যার নূপুর। প্রকৃতির গায়ে ভাসে বিচিত্র অলংকার। আর সে অলংকারের ঝিলিক লাগে বাংলার মানব মনেও। তখন সে মন উদ্বেলিত হয়ে ওঠে তার মনের মতো। 

এখন বর্ষা। বর্ষায় গাছে গাছে ফোটে কদম ফুল। অন্য অনেক ফুলের মতো কদম ফুলও যে বাঙালির নয়ন-চিত্তকে নাড়িয়ে দেয়, ভাব-ভাবনাকে তাড়িয়ে বেড়ায় তার প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলা সাহিত্যের দিকে তাকালে। বাংলা সাহিত্যের একটি অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে বর্ষার কদমফুল। অত্যাধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির যান্ত্রিক সময়ে সাহিত্যে প্রকৃতির বর্ণনা আহামরি চোখে না পড়লেও প্রাচীন সাহিত্য থেকে মধ্যযুগ, মধ্যযুগ থেকে পরবর্তী আধুনিক সাহিত্যের সকল শাখায়ই কদম ফুলের উপস্থিতি পাওয়া যায়। 

বৈষ্ণব সাহিত্যের দিকে তাকালে আমরা দেখি রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের আকুতিতে যেমন রয়েছে (নির্জন যমুনার কূলে/বসিয়া কদম্ব তলে/বাজায় বাঁশি বন্ধু শ্যামরায়।/বাঁশিতে কি মধু ভরা/ আমারে করিল সারা/আমি নারী ঘরে থাকা দায়/কালার বাঁশি হলো বাম/বলে শুধু রাধা নাম/কুলবধূর কুলমান মজায়।) 

তেমনি রবীন্দ্র সাহিত্যেও (কদম্বেরি কানন ঘেরি আষাঢ় মেঘের ছায়া খেলে/পিয়ালগুলি নাটের ঠাটে হাওয়ায় হেলে/বরষণের পরশনে/শিহর লাগে বনে বনে/বিরহী এই মন-যে আমার সুদূর পানে পাখা মেলে।) রয়েছে কদমফুলের কথা। তার গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে, জীবনকথায়ও ঋতুর সঙ্গে কদম ফুলের উপমা পাওয়া যায় বিস্তৃতভাবে। 

ক্ষ্যাপা নজরুলও তার সাহিত্যে কদমফুলকে এড়িয়ে যেতে পারেননি (রিমঝিম রিমঝিম ওই নামিল দেয়া/শুনি শিহরে কদম, বিদরে কেয়া/ঝিলে শাপলা কমল ওই মেলিল দল/মেঘ-অন্ধ গগন, বন্ধ খেয়া।); ‘বউ কথা কও পাখি’ কবিতায় এই কদমের কথাই তিনি আবার বলেন আরেকভাবে, ‘উড়ে গেছে কোথা, বাতায়নে বৃথা/বউ করে ডাকাডাকি।/চাঁপার গেলাস গিয়াছে ভাঙ্গিয়া, পিয়াসী মধুপ এসে/কাঁদিয়া কখন গিয়াছে উড়িয়া কমল-কুমদী দেশে।’ 

পল্লী কবি জসীমউদ্দীন নিবিড় মনে গ্রাম্য মেয়ের কদমফুল নিয়ে খেলার কথা বা তার বিস্ময়ের কথা কি ছেড়ে গেছেন তার সাহিত্য থেকে? না যাননি। তার ‘পল্লী বর্ষা’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘কাহার ঝিয়ারি কদম্ব শাখে নিঝুম নিরালায়/ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!/ বাদলের জলে নাহিয়া সে মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়/সে হাসি তাহার অধর নিঙড়ি লুটাইছে বনময়।’ 

তারও অনেক পরে এসে সোনালি কাবিনের কবি আল মাহমুদ লিখেছেন, ‘আমি তোমাকে কতবার বলেছি/ আমি বৃক্ষের মতো অনড় নই/তুমি যতবার ফিরে এসেছ ততবারই ভেবেছ/আমি কদমবৃক্ষ হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকব/কিন্তু এখন দেখ/আমি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকলেও/হয়ে গিয়েছে বৃক্ষের অধিক এক কম্পমান সত্তা।’ (কদম ফুলের ইতিবৃত্ত)। 

যে কবির নামে নাগরিক কবির তকমা জড়িয়ে রয়েছে, যে কবিকে বলা হচ্ছে শহরের চৌহদ্দি ছেড়ে, গলিঘুপচি ছেড়ে রচনা করেননি এর অধিক কোনো রচনা সে কবির কবিতায়ও আমরা পেয়ে যাই বর্ষা, উপমা হিসেবে কদম ফুল, তার বুনো ঘ্রাণ। শামসুর রাহমানের ‘এমন বর্ষার দিনে’ কবিতাটি আমাদেরকে নিয়ে যায় সেই আঠারো বছরের চুমু- সেই বাদল দিনের ফুল কদমের বুনো ঘ্রাণের কাছে, ‘এখন দেখছি আমি/কবেকার তোমার আঠারো বছরকে চুমু খাচ্ছে আনন্দে/নিভৃতে খোলা ছাদে কাচের গুঁড়োর মতো বৃষ্টি।/বাদল দিনের ফুল কদমের বুনো ঘ্রাণে শিহরিত তুমি ক্ষণে ক্ষণে।/এমন বর্ষার দিনে তোমার কি সাধ জাগে/কেউ নিরিবিলি টেলিফোনে ‘রাধা’ বলে ডাকুক তোমাকে?’

বর্ষায় তো আরও আরও কত ফুল ফোটে কিন্তু কদমফুল আর বর্ষা আলিঙ্গন করে রয়েছে। কদমফুল সাহিত্যে উঠে এসেছে চমৎকারভাবে। ঋতু যেমন বর্ষা ঋতুকে ফেলে আর পাঁচ ঋতুকে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে না, অপূর্ণতা থেকে যায় তেমনি বর্ষাও কদমফুলকে ছেড়ে যেতে পারে না। নগরায়নের কঠিন এ সময়ে গাছ নিধনের যখন মহোৎসব তখনো কদমগাছ কিছুটা চোখে পড়ে। গাঁয়ে-গঞ্জে, বনে-বাদাড়ে অনেক না হলেও কদমগাছ আছে। অন্য ঋতুতে মলিন থাকলেও বর্ষায় কদমগাছ যৌবন পায়। পাতার ফাঁকে ফাঁকে প্রকাশ্যে প্রকাশ করে সবুজের মাথায় হলুদ টোপর। মার্বেল বলের মতো অপরূপ একটা রূপ নিয়ে ফুটে থাকে কখনো হাতের কাছে কখনো উঁচু ডালে। বালকেরা বালিকারা তবু কি রেহাই দেয়? দেয় না। গাঁয়ের চঞ্চল কিশোরটি যেমন ঝুড়ি ভরে কদম ফুল পেড়ে খেলতে খেলতে বিলের পথ থেকে বাড়ি ফিরে তেমনি নগরে দূরন্ত বালিকা হাতে একগোছা কদম নিয়ে বাসে বাসে ফেরি করে অথবা পার্কের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সাধে একে ওকে, কদম নেবেন স্যার, কদম? কোনো কোনো যুগল হাত বাড়িয়ে নেয়, কোনো কোনো যুগল হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় রমনায় বা ভিক্টোরিয়ার আশপাশে। কেউ কেউ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে খোঁপায় গুঁজে নেয় কদম, আনন্দে। এমন দৃশ্য যখন অবলোকন করে কোনো কবি, কোনো সাহিত্যিক সে কি আর বাধ মানে! মনের মাধুরিতে সে তখন আঁকে রাজ্যের শত ছবি। বাদল আর বর্ষা, বর্ষা আর কদমফুলের ছবিতে ভাসায় খাতার পর খাতা। কারও কারও হাতে খাতার সে রচনা হয়ে ওঠে অমৃত সাহিত্য। কালের পিঠে তা উজ্জ্বল হয়ে ফুটে থাকে কদমেরই মতো। 

ত্রিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ পেরিয়ে আধুনিকের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের কালে এসেও তার এক জনপ্রিয় কাব্যগীতে পাই কদমফুল- যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো/চলে এসো এক বরষায়/যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরী/কদমগুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি/কদমগুচ্ছ খোঁপায় জড়ায়ে দিয়ে/জলভরা মাঠে নাচিব তোমায় নিয়ে/তুমি চলে এসো, চলে এসো এক বরষায়)। আরও পাই তার আস্ত উপন্যাস (বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল)। ‘অন্য আলো’য় প্রকাশিত তার এক ক্ষুদ্র কলামেও আমার দেখি উঠে এসেছে বর্ষায় বিমোহিতকর কদম ফুলের কথা। ‘কদম ফুল হাতে ক্ষুধার্ত বালক’ নামে কলামটির এক অংশে তিনি লিখেছেন, (রেসকোর্সের পাশের রাস্তা ধরে হাঁটছি। হঠাৎ চোখে পড়ল, একটি ছেলে একগাদা কদম ফুল হাতে নিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে একপশলা বৃষ্টি হয়েছে। মেঘমেদুর আকাশ। এক কোণে অন্ধকার জমাট বাঁধছে, হয়তো আবার বৃষ্টি হবে। চমৎকার বর্ষার ছবি। এই ছবির সঙ্গে কদম ফুলগুলো এত সুন্দর মানিয়েছে, আমার ইচ্ছে করল কিছু কদম ফুল নিয়ে বাসায় ফিরতে। আমি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই, আমার কাছে বিক্রি করবি?’)। এরকম বহু গল্পে, বহু প্রবন্ধে, বহু ভ্রমণ গদ্যেও আমরা কদম ফুলের ছোঁয়া পেয়ে যাই বাংলা সাহিত্যের বহু পৃষ্ঠাজুড়ে। 

কিন্তু সাহিত্যের শাখে এখন যেমন প্রকৃতি হারিয়ে পাচ্ছে তেমনি হারিয়ে যাচ্ছে তার উপমায় ফুল পাখি ফল লতা পাতা বসত-ভিটা। এই সময়ের গীতে, কাব্যে, গল্পে, উপন্যাসে, ভ্রমণে প্রকৃতির উল্লেখ প্রায় হয়ই না। আবহসংগীতের মতো ঋতুর ব্যঞ্জনা বাজে কম। ঘাস নদী আসে না বললেই চলে। সাহিত্যে এখন অধিক অনুরণিত হয় সময়ের হাহাকার, প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা, ধুলি-ধূসরতা। চাওয়া-পাওয়ার, ব্যথা-বেদনার ক্রন্দন। ধারাবর্ণনায় ঘটনা প্রবাহিত হয়। আশপাশ, পরিবেশ, পরিস্থিতি বর্ণিত হয় না। অসাধু এক প্রতিযোগীতা সাহিত্যের বাজারেও অসুস্থ অস্থিরতা তৈরি করে ডাক আর নামের কাঙ্গালে পরিণত হয়েছে। এ হয়তো প্রকৃতি নিধনের ফল, না হয় হয়তো অতি নগরায়নের ফলে মনোবৃত্তিতে শহুরে ও পাশ্চাত্যের কৃষ্টি অনুপ্রবেশের ফল- না হয় নষ্ট মানবিক আর মানসিকতা চর্চার শ্রীহীন রূপ।

নব সভ্যতায় প্রকৃতিতে এখন কদম ফুল কম পাওয়া যায়, ভবিষ্যতে আরও কমে হয়তো এ ফুলটি মিথ হয়ে দাঁড়াবে একসময়। অতি আদুরে কারও যদি মনে পড়ে তারা হয়তো তখন চিত্রকলার কোনো ফ্রেম এনে বাঁধিয়ে রাখবেন ঘরের দেয়ালে, না হয় পিতলের কাঠামো বানিয়ে সাজাবেন টেবিলে! সে কথার ইঙ্গিতই তো পাই প্রকৃতিপ্রেমী, প্রকৃতি লেখক দ্বিজেন শর্মার ‘শ্যামলী নিসর্গ’ গ্রন্থে, ‘ ঢাকা শহরে কদম পাওয়া বেশ দুষ্কর। রমনা উদ্যানের পূর্ব পাশে, শিল্পকলা একাডেমির পাশের রাস্তার ধারে কিংবা বকশীবাজার এলাকায় চলতে গেলে এখন বৃষ্টি ভেজা হাওয়ায় কদমের সৌরভ নাকে ঝাপটা দিতে পারে। তবে বর্ষা কি শীতে, ষড়ঋতুতে একটি বিশালাকার কদম অবশ্য নাগরিক দৃষ্টিতে পড়বে জাতীয় ঈদগাহের সামনের পথের মোড়ে। শিল্পী নিতুন কুণ্ডু ফুটিয়েছেন এই কদম ধাতব ভাস্কর্য।’

বর্ষা ছাড়া কদম ফুল অলিক। বর্ষা এলে কদম আসে। মুখ উঁচিয়ে হাসে। বাংলা সাহিত্যে বর্ষা ঋতু যেভাবে এসেছে অন্য ঋতু তেমন প্রখরভাবে আসেনি। এক রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের দিকে তাকালে দেখি রবীঠাকুর যেন বর্ষাময়। বর্ষাই যেন তার সাহিত্যের অধিক অংশজুড়ে রয়েছে স্বমহিমায়। কালের দিক বদলের সঙ্গে, রচনার ভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গে, বিষয়ে-উপমায়-উৎপ্রেক্ষায় সাহিত্যের অন্য কুলমণিদের রচনায়ও বর্ষা এসেছে পাড় ভেঙে, সেই পাড়ে এসেছে অন্য অনেক উপসঙ্গের মতো কদম ফুলও। সাহিত্যে এই ফুলটির ব্যাখ্যা-বর্ণনা-উপমার নিরিখে দেখা যায় প্রকৃতিতে কদম ফুলের বিভা কম নয়, বর্ষায় অরূপ রূপেই উদ্ভাসিত হয় এই কদম ফুল। তাই বাংলা সাহিত্যে তার এত গর্বিত প্রভাব।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫