Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

প্রেমের কবি হাছন রাজা

Icon

সৈয়দা আঁখি হক

প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২১, ১১:২০

প্রেমের কবি হাছন রাজা

প্রতীকী ছবি

অপ্রেমিকে গান শুনিলে কিছুই মাত্র বুঝবে না

যেমন কানার হাতে সোনা দিলে, লাল ধলা চিনে না

অপ্রেমিকে গান আমার শুনবে না॥

কিরা দেই কসম দেই, আমার বই হাতে নেবে না 

প্রেমের প্রেমিক যেই জনা, এ সংসারে হবে না

অপ্রেমিকে গান আমার শুনবে না॥

এক
বাংলাদেশের তথা বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র মরমি কবি দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী। গানের রাজা বলতেই সামনে আসে তাঁর নামটি। শ্রী চৈতন্যদেব ও হজরত শাহজালাল (র.)-এর পরে সিলেটের সবচেয়ে আলোচিত, আলোকিত ব্যক্তি হাছন রাজা। সুনামগঞ্জ শহরের কাছে সুরমার তীরে লক্ষ্মণশ্রী গ্রামে তাঁর জন্ম। আলো ঝলমলে সে দিনটি ছিল ২১ ডিসেম্বর, ১৮৫৪ সাল, ১২৬১ বাংলা ৭ পৌষ। পিতা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী, মাতা হুরমত জাহান বিবি। চন্দ্রতুল্য রূপ নিয়ে অতি আদর-যত্নে মায়ের কোলে বড় হতে লাগলেন জমিদার পুত্র। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলেও তখনকার জমিদারি রেওয়াজ অনুযায়ী বাড়িতেই ওস্তাদের কাছে বাংলা, উর্দু, আরবি, ফারসি ও ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেন। চঞ্চল, দুরন্ত, চটপটে, শৌখিন হাছন সারাক্ষণ ঘোড়ায় চড়ে ছুটে বেড়াতেন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। পাহাড়ে, নদীতে, সমতলে উপভোগ করতেন প্রকৃতির রূপ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হইচই আর আনন্দে মাতিয়ে তুলতেন পুরো গ্রামসহ বাড়ির মানুষকে। শিকার করা, মাছ ধরা এবং পাখি পালনে ছিলেন পটু। এককথায় মন যা চাইত তা-ই করতেন, জমিদার পুত্র বলে কথা। মনোল্লাসে হাওরে, বন-বাদারে গলা ছেড়ে গেয়ে বেড়াতেন- 

বাউলা কে বানাইল রে

হাছন রাজারে বাউলা কে বানাইল রে।

দুই
রামপাশায় জমিদারি দেখাশোনা করতেন বড় ভাই উবায়দুর রাজা। নৌকা, পালকি কিংবা ঘোড়ায় চড়ে হাছন ছুটে যেতেন ভাইয়ের কাছে। উবায়দুর রাজাও মাঝে মাঝে লক্ষ্মণশ্রীতে এসে দেখে যেতেন ছোট ভাইকে। তবে যতই উড়নচী হোক, হাছনের মধ্যে সৃষ্টিশীল চিন্তা কাজ করত শিশুকাল থেকেই। সকলের দৃষ্টির অগোচরে অদৃশ্য কিছু একটার পিছনে ছুটে তাকে ধরতে চাইতেন। উদার প্রকৃতি, সূর্যের আলো, রাতের আঁধার থেকেই শিক্ষাগ্রহণ করতে লাগলেন দিনে দিনে। সাধক-মহাজনদের গান গাইতেন আপন মনে, প্রকৃতির মাঝেই যেন সুর খুঁজে বেড়াতেন। এই লাগামহীন জীবন বেশিদিন স্থায়ী হলো না। মাত্র ১৬ বছর বয়সে বৈমাত্রেয় বড় ভাই উবায়দুর রাজা বসন্ত রোগে মৃত্যুবরণ করেন। পুত্রশোক কাটিয়ে না উঠতেই, মাত্র চল্লিশ দিনের মাথায় পিতা আলী রাজা চৌধুরীও ইন্তেকাল করেন। রামপাশা, লক্ষ্মণশ্রী, আম্বরখানা, সওদাগর টিলা, টিলাগড় এবং মৌলভীবাজারসহ তিন লাখ বিঘার জমিদারির দায়িত্ব এসে পড়ল কিশোর হাছনের ওপর। অল্প বয়সে রাজ্যভার, পিতা ও ভাইয়ের মৃত্যুতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন চঞ্চলমতি এই কিশোর। 

বাপও মইলা ভাই ওরে মইলা, আরও মইলা মাও

এখনো বুঝলায় হাছন এ সংসারে ভাও,

দিন গেল হেসে গো খেলে রাত্রি গেল নিদে

ফজরে উঠিয়া গো হাছন হায় হায় করে কান্দে॥

তিন
ঘুরে গেল জীবনের মোড়, মায়ের আদেশে সমস্ত রাজ্যের দায়িত্ব নিলেন কঠোর হাতে। আগের মতো উৎসাহ, উদ্যম নেই, নেই কোনো চঞ্চলতা। নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্যকে গুরুত্ব দিয়ে বিচক্ষণতার সঙ্গে রাজ্য পরিচালনায় মনোনিবেশ করলেন। বছর না ঘুরতেই রাজ্যের আয় দ্বিগুণ বেড়ে গেল। তিনি হয়ে উঠলেন দুর্দান্ত, প্রতাপশালী, অত্যন্ত বিচক্ষণ ও শৌখিন জমিদার। অন্যায়কারীর জন্য তিনি ছিলেন কঠোর ও ভয়ংকর; কিন্তু ক্ষমাপ্রার্থীকে সহজেই ক্ষমা করতেন। দয়ালু, চিন্তাশীল ও পরদুঃখে কাতর হাছন চরম শত্রুর দুঃখ-কষ্টে ও মর্মাহত হয়ে সেই পরিবারকে ভরণ-পোষণসহ প্রচুর জমি দান করেছেন। অল্প বয়সে সুন্দরভাবে রাজ্য পরিচালনা করায় ঈর্ষান্বিত হয়ে কিছু প্রজা তাঁর নামে অতিরঞ্জিত এবং কল্পিত নানা গল্প প্রচার করে। এসব গল্পের সঙ্গে তাঁর বাস্তব জীবনের কোনো মিল নেই। অন্যায়, অবিচার, চাটুকারিতা সহ্য করতেন না বলেই তাঁর নামে এত অপপ্রচার। তাইতো নিন্দুকের উদ্দেশে বলেন- 

অপ্রেমিকে গান শুনিলে কিছুই মাত্র বুঝবে না

যেমন কানার হাতে সোনা দিলে, লাল ধলা চিনে না

অপ্রেমিকে গান আমার শুনবে না॥

কিরা দেই কসম দেই, আমার বই হাতে নেবে না 

প্রেমের প্রেমিক যেই জনা, এ সংসারে হবে না

অপ্রেমিকে গান আমার শুনবে না॥ 

জমিদারি পরিচালনার জন্য যেটুকু কঠোর হওয়া প্রয়োজন তিনি তা হয়েছেন। বিচক্ষণ ও দয়ালু এই জমিদার অসংখ্য গরিব-দুঃখীর খাজনা মাফ করেছেন, মন্দির মসজিদ তৈরির জায়গা দান করেছেন। পিঁপড়ের প্রতিও সদয় আচরণ করতেন, বিড়ালসহ পশু-পাখির প্রতি এত মমতা ছিল যে, সকালে ঘুম থেকে উঠে পাখিদের খাবার খাইয়ে নিজে খেতেন। জমিদার হিসেবে বিলাসী হাছন কিন্তু ব্যক্তিজীবনে একেবারে সাদামাটা জীবনযাপন করেছেন। তাঁর চিত্ত ছিল কোমল ও কবিসুলভ। উঁচু-নিচু, জাত-পাতের ঊর্ধ্ব উঠে সকল মানবজাতিকে একই মানদণ্ডে বিচার করেছেন। চিন্তা-চেতনার বিশালতা ও ভাবনার গভীরতায় ক্ষণকালের জীবনটি ছিল তাঁর রহস্যের জালে ঘেরা। তাইতো প্রেমচিত্তে ধ্যানে বসে রূপের মাঝে অরূপের সন্ধান করেছেন এভাবে-

আঁখি মুঞ্জিয়া দেখো রূপ রে

আঁখি মুঞ্জিয়া দেখো রূপ

দিলের চোখে চাইয়া দেখো বন্ধুয়ার স্বরূপ রে

চার
শহরে বাস করার মোহ তাঁকে আকৃষ্ট করেনি। ভালোবাসতেন সবুজ প্রকৃতি, মাটির গন্ধ, জলের কলকল শব্দ, পাখির কিচির-মিচির ও নৌকাবাইচ। গ্রামের মানুষের একান্ত কাছে গিয়ে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতেন। যে কোনো আনন্দ-উৎসব, সামাজিক অনুষ্ঠানে, জারি, সারি, গাজীর গান, যাত্রাপালা, কৃষ্ণলীলা ও থিয়েটারে যেতেন। গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। মানুষের দুঃখ লাঘব করার প্রাণপণ চেষ্টা করতেন। বংশের গৌরব কিংবা সাম্প্রদায়িকতা তাঁকে স্পর্শ করেনি। সহজেই মিশতে পারতেন বেদে সম্প্রদায়ের সঙ্গেও। একবার ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় ঢাকার নবাব আহসান উল্লাহর ঘোড়াকে হারিয়ে বাজিতে জিতেছিল হাছনের ঘোড়া। হাতি, ঘোড়া ও শতাধিক কুড়া পাখি পোষার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন। কেউ একটি ভালো কোড়া পাখি উপহার দিলে হাছন রাজা তাকে এক জোড়া ধুতি, এক জোড়া চাদর ও একশত টাকা দিতেন। নিজ বংশের কয়েকজনের বিয়েতেও প্রিয় হাতি, ঘোড়া দিয়েছেন উপহার হিসেবে। তাঁর শিকার পদ্ধতিও ছিল অত্যন্ত চমৎকার। পাখি হত্যা না করে নিজের পোষা পাখি দিয়েই বনের পাখি শিকার করার কৌশল রপ্ত করে দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন। 

সতেরো বছর বয়স থেকে কঠোর হাতে জমিদারি দায়িত্ব পালন করেছেন, এটা তাঁর কৃতিত্ব। তিন লাখ ৬৪ হাজার বিঘার জমিদার হয়েও অন্তরে ছিলেন প্রকৃত বাউলা। তাইতো গান রচনা করে, সুর দিয়ে ভাবের উন্মত্ততায় নিজেই গাইতেন, এটাই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। ব্যক্তি হাছন ছিলেন জমিদার পুত্র, জমিদার, স্বামী ও পিতা; কিন্তু জমিদার হাছনের ভেতরে ছিল এক বাউল সত্তা, তাইতো নিজের সময়টুকুতে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতেন। এই হলেন হাছন রাজা, এবং এটা তাঁর পক্ষেই সম্ভব। অর্থাৎ জাগতিক সংসার, মায়া-মোহ পরিত্যাগ করে নিজেকে সংস্কারমুক্ত এক পরিবেশে দেখতে চাইতেন বলেই নিজেকে ‘বাউল’ হিসেবে আবিষ্কার করেছেন।

বানাইল বানাইল বাউলা, তার নাম হয় যে মৌলা,

দেখিয়া তার রূপের ছটক, হাছন রাজা হইল আউলা।

বাউলা কে বানাইল রে 

হাছন রাজারে বাউলা কে বানাইল রে॥

পাঁচ
পরিণত বয়সে মায়ের পছন্দমতো কোরাইশী বংশের আজিজা বানুর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। কোনো রাজপ্রাসাদে নয়; হাছন রাজা বসবাস করতেন একটি সুন্দর মাটির মহলে। জমিদার বাড়ির আসবাবপত্র, সিংহাসন কিংবা জৌলুসের চাকচিক্য ছিল না সেই মাটির ঘরে। ভাওয়ালী নৌকা নিয়ে বের হতেন ভ্রমণে। এত বড় জমিদারি থেকেও অন্তরে তিনি ছিলেন একেবারে নিঃসঙ্গ, উদাস, অন্তর্মুখী। লৌকিক ভাষায়, মরমি সুরে প্রকাশ করেছেন নিজের প্রেম, বৈরাগ্য ও পরিণতি। গান রচনার সময় নাওয়া-খাওয়া ভুলে হারিয়ে যেতেন ভাবলোকে। মনের মতো সুর না হওয়া পর্যন্ত কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। মুখে মুখে গান রচনা করে সুর দিয়ে গাইতেন ঢোল বাজিয়ে। নায়েব, গোমস্তা বা সহচরবৃন্দ তা লিখে রাখতেন। এভাবেই গান, সুর ও মরমি হাছনের মহামিলন ঘটে পরমসত্তার সঙ্গে। স্ত্রী, পুত্র, সংসার ও জমিদারি ছিল তাঁর দায়িত্ব-কর্তব্য, এর বাইরে তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ এক প্রেমিক। তাইতো প্রেমিক হাছন বলেছেন, ‘সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টা বিরাজে, তাই আমি-ই সে, সে-ই আমি। অর্থাৎ আমার মাঝে থেকেই সে দেখা দিল আমারই রূপে। চন্দ্র-সূর্য যেই রূপের সমান নয়, আমার সেই রূপ দেখেই আমি ফানা।’ নিজের মাঝে সেই অপরূপ রূপের সন্ধান পেয়ে প্রমোন্মাদনায় গেয়ে ওঠেন-

মুখ চাইয়া হাসে আমার যত আরি-পরি

দেখিয়াছি বন্ধের রূপ ভুলিতে না পারি॥

লোকগানে একজনের সুরের সঙ্গে অন্যের মিল থাকলেও কেবল হাছন রাজার সুর একেবারেই স্বতন্ত্র। তাঁর পূর্বসূরি এবং উত্তরসূরি সাধক কবিগণ গানের শেষাংশে বা মাঝের অন্তরায় ভনিতায় নিজের নাম লিখেছেন; কিন্তু একমাত্র হাছন রাজা অধিকাংশ গানে একাধিকবার ভনিতায় যুক্ত করেছেন নিজের নামটি। এখানেও তিনি ব্যতিক্রম। অচিন পাখিকে ধরতে ব্যাকুল ছিলেন সাঁইজি, কিন্তু হাছন রাজার মনমনিয়া পাখিটি দেহ পিঞ্জরে বন্দি হয়েই যখন কাঁদছে-

মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়া রে

কান্দে হাছন রাজার মন মনিয়ায় রে।

পিঞ্জিরায় সামাইয়া ময়না ছটফট ছটফট করে

মজবুত পিঞ্জিরা ময়না ভাঙিতে না পারে রে॥

ছয়
মানুষের জীবনের প্রধান অবলম্বন হলো প্রেম। ধরন ভিন্ন হলেও প্রেম ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না। মরমি হাছনের প্রেম ছিল স্রষ্টার সঙ্গে। এই প্রেমের প্রকাশ করেছেন তিনি যাপিত জীবন ও গানে। ভোগ-বিলাস, রাজত্ব বা জমিদারিতে নয়; গানের মাঝেই করেছেন পরম সুখের সন্ধান। সুরেই খুঁজেছেন মৌলাকে, নিজেকে উন্মোচিত করেছেন বাণীতে। 

হাছন রাজায় বলে ও আল্লা, ঠেকাইলায় ভবের জঞ্জালে 

বেভুলে মজাইলায় গো মোরে এই ভবের খেলে।

মরমি চেতনায় তাঁর প্রতিটি গানে রয়েছে দার্শনিকতা, সহজিয়া ভাব, ঈশ্বরপ্রেম ও মানবপ্রেম। ভক্তি, বৈরাগ্য, বিলাসিতা, প্রকৃতি, আল্লাহ, ঈশ্বর, রাধাকৃষ্ণ, হরি, কালাচান্দ, দেব-দেবী প্রভৃতি দয়াল বিষয়গুলো গানকে প্রাণবন্ত করেছে। আক্ষেপ ও নিবেদনের গভীর ভাব তুলে ধরেছেন মনোহর পঙ্ক্তি, রূপক ও উপমায়। হিন্দি ভাষায়ও বহু গান রচনা করেছেন। চিন্তা, চেতনা, ভাবদর্শন, গানের ঢং, আঞ্চলিকতা, শব্দ চয়ন এবং বিষয়বস্তু সবই তাঁর নিজস্ব ধারায়। ভাবের গভীরতায় প্রেমের প্রকাশ, প্রার্থনা, আরাধনা যেমন করেছেন তেমনি রসিকতাও করেছেন নিজেকে নিয়ে। জমিদার নয়; আশিক, প্রেমিক, কাঙাল, পাগল ও বাউল হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে প্রেমের দৃষ্টান্ত রেখেছেন তিনি-

হাছন রাজা হইল পাগল লোকের হইল জানা

নাচে নাচে ফালায় ফালায় আর গায় গানা।

সাত
নিজের সমালোচনায় জীবনের অন্ধকার দিকটা যেভাবে গানে তুলে ধরছেন, বাংলা সাহিত্যে এমন দ্বিতীয় কাউকে পাওয়া যাবে না। স্ত্রী-পুত্র, বন্ধু-বান্ধব, দাস-দাসী, গায়ক-গায়িকায় মশগুল থেকেও অন্তরে ছিলেন একেবারে নিঃসঙ্গ, উদাস, একা পথিক। পরমকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় হাছনের মনিয়া পাখিটি অস্থির ছিল। তাঁর অস্থিরতা, ব্যাকুলতা সাধারণ মানুষের বোঝার সাধ্য ছিল না। যাঁর অন্তরিয়া স্বয়ং আল্লাহ, বাইরে তিনি ছিলেন শৌখিন- প্রতাপশালী জমিদার, কিন্তু ভিতরে তিনি প্রেমের ফকির। প্রেমরসে ভাবের তন্ময়তায় হলেন উদাসীন। ভাবগহীনে প্রবেশ করে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলেন ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। এই সত্যান্বেষণে হাছন হলেন দেওয়ানা, উন্মাদ, বাউলা; কিন্তু ব্রহ্মকে জানতে হলে আগে আপনাকে জানতে হয়। নিজেকে জানার সাধনায় ঈশ্বরের সঙ্গে লীন হয়ে বলেছেন- 

রূপ দেখিলাম রে নয়নে, আপনার রূপ দেখিলাম রে

আমার মাঝত বাহির হইয়া দেখা দিল আমারে॥

ভাবনা চিন্তা দূর হইল বন্ধু কোলে লইয়া

নাচে নাচে হাছন রাজা বন্ধুয়ারে পাইয়া॥

আট
লোক দেখানো ধার্মিকতায়, আনুষ্ঠানিকতায় ঈশ্বরের সন্ধান মেলে না। প্রেমে মাতোয়ারা হলেই ঈশ্বর লাভ সম্ভব। বেঁচে থাকার মানুষের একমাত্র অবলম্বন প্রেম। সেই প্রেমের কারণেই যুগে যুগে মানুষ হয়েছেন প্রেমিক, ভাবুক, সাধক, কাঙাল, আউল-বাউল, রাজা। রাজ্য ছেড়ে ভিখারি, কখনো-বা ডুবেছেন অন্ধকারে। হাছন রাজাও গভীর প্রেমে মগ্ন হয়ে সুরে সুরে ডেকেছেন পরমেশ্বরকে। সংসারত্যাগী বাউল না হলেও তিনি বাউল সমধর্মী ছিলেন। অন্তরে ছিল বৈরাগ্য। প্রেম, অধ্যাত্মবাদ, উচ্চানুভূতি ও আক্ষেপ- এই চার ধারায় তিনি গান রচনা করেছেন। জীবনের কামনা-বাসনা, নিজের অস্তিত্ব, ভাব জগতের রহস্যের নানা গুপ্তকথা প্রকাশ করেছেন মরমি সুরে। নিজের মাঝে সৃষ্টিকর্তার লীলা দেখে ব্যাকুল চিত্তে স্রষ্টাপ্রেমের আকুতি প্রকাশ করেছিলেন-

মন্দ সন্দ যা-ই বলো তার লাগিয়া না ডরি

লাজ লজ্জা ছাড়িয়া বন্ধের থাকব চরণ ধরি।

নয়
লোকনিন্দার পুষ্পচন্দন ছিল তাঁর মরমি কপালে তিলক ফোঁটা। তাইতো স্রষ্টাপ্রেমের উন্মাদনায় সুরের পাগল হাছন অধরাকে বাঁধলেন কঠিন প্রেমজালে। এখানেই তাঁর ভাবুকতা ও কবিত্বশক্তি। ধর্ম-কর্মে উদারতা ছিল বংশগত গুণ। সংসার, ধর্ম, জমিদারি থাকা সত্ত্বেও তিনি বৈরাগ্য চিত্তে আকুল করা গানের মোহনিয় সুরে ঠাঁই করে নিয়েছেন ভাবুক হৃদয়ে। জমিদার হিসেবে নয়; মাটির গন্ধ, মাটির সুরে, মাটির মানুষের মতোই সহজ-সরল জীবনযাপনের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে পেতেন। প্রেমের কাঙাল হয়ে সুরের মাঝেই আশ্রয় খুঁজেছেন প্রেমময়ের চরণতলে। যাঁর দৃষ্টিতে আল্লাহ ও কানাইর মাঝে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। আল্লাহ, দয়াল কিংবা খোদার কাছে আকুতি ছাড়াও রূপকের মাধ্যমে রাধাকৃষ্ণের শাশ্বত প্রেমের চিত্র রয়েছে গানে। ঈশ্বরের ভজনা করেছেন আশিক হয়ে, আবার আল্লাহকে ডেকেছেন আকুল করা সুরে। নিজেকে সমর্পণ করেছেন হরি কিংবা দয়ালের চরণে। 

আমার হৃদয়েতে শ্রীহরি

আমি কি যম কে ভয় করি?

দশ
মরমি ইন্দ্রজালের স্পর্শে রিপু শাসিত সম্ভ্রান্ত জমিদার রূপান্তরিত হলেন প্রেমপ্রত্যাশী এক উদাসী সাধকে। দয়াগুণ তাঁর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। জীবনের শেষ সময়ে প্রিয় কুড়া পাখিগুলো শৌখিনদের মাঝে বিলিয়ে দেন। সাধের ভাওয়ালী নৌকা দিলেন পুত্র হাসিনুর রেজাকে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে মুক্তহস্তে দান করতেন। হিন্দু ধর্মের মন্দির, স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা স্থাপনের জন্য অনেক জমি দান করেছিলেন। কেবল মানুষ নয়, পশু-পাখি, বেড়াল বাচ্চা, মাছি, পিঁপড়ার প্রতিও সদয় ব্যবহার করতেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজে না খেয়ে আগে কাক, চিল, চড়–ই পাখিসহ বিভিন্ন পাখিকে ভাত, মাছ, চাল দিতেন। ওদের খাওয়া শেষ হলেই নিজে আহার গ্রহণ করতেন। বিকেলে ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সঙ্গে খেলতেন, হাতে যত টাকা উঠত তাই-ই দিতেন বিজয়ীকে। বাউল কিংবা সাধকগণ আত্মমুক্তির জন্য সহজ পথের সন্ধান করেন। হাছন রাজাও প্রেমের উজ্জ্বল আলোতে পেলেন মুক্ত পথে মুক্তির সন্ধান। তিনি বৈরাগী কিংবা দরবেশ নন, তবু সমাজ সংসারের মাঝে বাস করেও অধ্যাত্মোপলব্ধি জেগেছিল সাধক হাছনের প্রাণে। 

হাছন রাজায় বলে ও আল্লা, ঠেকাইলায় ভবের জঞ্জালে

বেভুলে মজাইলায় গো মোরে, এই ভবের খেলে। 

এগারো
জমিদার হাছন জীবনের প্রথম স্তরে হলেন স্রষ্টাপ্রেমে ‘পাগল।’ মোমিন মুসলমানদের আহ্বান করেন শরিয়তের বিধান মেনে চলতে। দ্বিতীয় স্তরে ‘প্রেমিক হাছন’, প্রেমের মাধ্যমে প্রিয়াকে কাছে পাওয়ার চেষ্টা করেন। তৃতীয় স্তরে ‘সাধক হাছন’, প্রেমময়ের রূপ দেখতে উন্মাদ হলেন, অশান্ত হলেন। চতুর্থ স্তরে ‘দার্শনিক হাছন’, নিজের মাঝেই প্রেমময়ের সন্ধান পেয়ে করলেন আত্মসমালোচনা। পঞ্চম স্তরে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে দয়ালের চরণে সমর্পণ করে অনুশোচনায় কাতর হলেন। সৎ পথে, প্রেমের মাধ্যমে জীবনকে নীরোগ ও সুখময় করার মাঝেই মানবজীবনের প্রধান সার্থকতা খুঁজেছেন। সুরের মাঝেই পেয়েছেন পরম তৃপ্তি। রাজপ্রাসাদ বা রাজ সিংহাসন নয়; মাটির ঘরে সাদা-মাটা চেয়ারে বসে রাজ্য শাসন করেছিলেন গানের রাজা, প্রেমিক রাজা, সাধক রাজা, দার্শনিক এবং মুকুটবিহীন হাছন রাজা। দিনশেষে চিৎকার করে কেঁদেছিলেন অনুশোচনায়- 

আমি না লইলাম আল্লাজির নাম রে, না করলাম তাঁর কাম

বৃথা কাজে পাগল মনা দিন গুয়াইলাম রে

নাম লইমু নাম লইমু করিয়া আয়ু হইল শেষ

এখনো না করলায় হাছন প্রাণ বন্ধের উদ্দেশ রে।

৬ ডিসেম্বর ১৯২২, বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ১৫ মিনিটে প্রেমের কবি হাছন মিশে গেলেন প্রেমাস্পদের প্রাণে প্রাণে, মনে মনে, দেহে দেহে, আত্মায় আত্মায়। উড়ে গেল তাঁর দেহপিঞ্জরে বন্দি মনিয়া পাখিটি। জীবনের শেষ ইচ্ছানুযায়ী মায়ের কবরের পাশে সমাহিত করা হয় তাঁকে। আম গাছের ছায়ায় ২৪ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৮ ফুট প্রস্থ সাদা দেয়ালে ঘেরা তাঁর মাজার। দেয়ালে শ্বেত পাথরে বাঁধানো তাঁরই একটি বিখ্যাত গানের কিছু অংশ-

লোকে বলে বলে রে, ঘরবাড়ি বালা নায় আমার

কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যেরও মাজার॥

বালা করি ঘর বানাইয়া, কয়দিন থাকমু আর

আয়না দিয়া চাইয়া দেখি, পাকনা চুল আমার॥

এই ভাবিয়া হাছন রাজা, ঘর দুয়ার না বান্ধে

কোথায় নিয়া রাখব আল্লা, তার লাগিয়া কান্দে॥

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫