
ফাইল ছবি
স্টিভেন মিলোসার। নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন। পেশায় ছিলেন শিক্ষক। একাধারে ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্পকার। তার গল্প অবলম্বনে সিনেমাও বানানো হয়েছে। তার লেখা মূলত কল্পনাপ্রবণ। ‘এডউয়িন হাউস’ নামক একটি বিখ্যাত উপন্যাসের জন্য তিনি পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন। ভাষান্তর : মাইশা তাবাসসুম
এক
বার্নাম মিউজিয়াম, এটা প্রধান অর্থনৈতিক শহর থেকে দুই ব্লক উত্তরে, নগরের একদম হৃদমাঝারে অবস্থিত। এর রোমানেস্ক আর গোথিক প্রবেশ পথে একজোড়া স্ফিংস (সিংহের ধরে মানুষের মাথাওয়ালা প্রাণী) আর গ্রিফিন (সিংহের ধরে ঈগলের মাথাওয়ালা প্রাণী), পেঁয়াজের মতো দেখতে পিচ্ছিল গম্বুজ, খুঁটি দেওয়া চূড়া, দুই ঢালবিশিষ্ট টাওয়ার, অষ্টভূজি গম্বুজ, শিখরে খাঁজকাটা নকশা, এই সবকিছু মিলে এক অদ্ভুত অধরা কাঠামো; এমন হিসেব মাফিক তৈরি করা, যা এক নিমিষে দেখে ফেলা অসম্ভব। প্রতিটি পয়েন্ট দর্শকদের দৃষ্টি ও মনোযোগ আকর্ষণ করার মতো। এর গঠনশৈলী এত জটিল যে, এটি আদৌ অসংখ্য বিভাগ, চূড়া ও বর্ধিতাংশ সহকারে একটি ভবন; নাকি অসংখ্য ভবনকে ছাদওয়ালা রাস্তা, ব্রিজ, তোরণ, স্তম্ভ ও ফুলগাছ দিয়ে সংযুক্ত করা, সেটা বুঝে ওঠাই মুশকিল হয়ে যায়।
দুই
বার্নাম মিউজিয়ামে আশ্চর্যজনক এবং ধারণাতীতসংখ্যক কক্ষ আছে, আর এদের প্রতিটির আবার অন্তত দুই থেকে শুরু করে ১২/১৪টি করে দরজা আছে। প্রতিটি দরজা দিয়ে আরও অসংখ্য কক্ষ দেখা যায়। ছোট-বড় আকারের, কোনোটিতে মাত্র একটি প্রদর্শনী, আবার কোনোটি আস্ত একটা পাঁচতলা ভবনের সমান। একটা কক্ষও সহজ সরল স্বাভাবিক কোনো কক্ষের মতো না। তাক, কুলুক্ষি, দড়ি দিয়ে ঘেরাও করা আবার ঘেরাও ছাড়া আনাচে কানাচে তে আছেই; বড় হলঘরগুলোতে আবার রঙ-বেরঙের তাঁবু ও ছাউনিও আছে। যদিও কাগজে-কলমে বলা আছে যে, পিরামিডের মতো শিখর থেকে শুরু করে তৃতীয় ভাগের অন্ধকার গুহা পর্যন্ত সবটুকু জাদুঘর একদিনে দেখে ফেলা সম্ভব; কিন্তু বাস্তবে তা অসম্ভব, যেহেতু আমরা বারবার কোনো বন্ধ দরজা, নীল ভেলভেটের দড়ি ঘেরা সিঁড়ি, যেটার সামনে সবুজ পোশাকে একজন গার্ড বসে থাকে, ঘুরেফিরে এসবের সামনে এসে উপস্থিত হই। সচরাচর খোলা জায়গায়গুলোতে প্রবেশের বাধার এই পুনরাবৃত্তি আমাদের ওই জায়গাগুলোর প্রতি আগ্রহ আরও বাড়িয়ে চলে। ব্যাপারটা কি আসলে জাদুঘর পরিচালকদের পরিকল্পিত ভাবে সাজানো? এটা অবশ্য সত্য যে, সার্বক্ষণিক ভাবে পুরনো কক্ষগুলো ভাঙা ও নতুন করে তৈরি করা হয়। কখনো কোনো ছোট কক্ষের মাঝের দেয়াল ভেঙে ফেলা হয়, কখনো বা বড় হলঘরগুলোতে একাধিক ছোট কক্ষে পরিণত করা হয়, আবার কখনো বাগান পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। এ জন্য সার্বক্ষণিক মানুষের কথাবার্তা, বাচ্চাদের চেঁচামেচি, বাদাম বিক্রেতাদের চিৎকারের মাঝেও একনাগারে ঠুকঠাক পুনঃসংস্কারের শব্দ শোনা যায়। লোক মুখে প্রচলিত আছে যে, কেউ যদি দুপুরে প্রবেশ পথ দিয়ে প্রবেশ করে আবার তিনটি নাগাদ সেখানে ফিরে যায়, তাহলে সেখানে বের হবার কোনো দরজা তো পাবেই না বরং পাবে অন্যান্য কক্ষের অসংখ্য দরজা।
তিন
মৎস্যকন্যাদের হলঘরটি বলতে গেলে অন্ধকারই, শুধু কতগুলো পোস্টের ওপরে হারিকেনের আলো জ্বলে। হলটির বেশিরভাগ অংশই একটি কালো লেক বা পুকুর, যার সবচেয়ে চওড়া অংশের মাপ প্রায় শ’ খানেক ইয়ার্ড, আর লেকটি পুরোটাই নুড়ি পাথরে ঘেরা। ঠিক মধ্যখানে উঁচুনিচু একটা ছায়ায় দ্বীপ। লেকের চারপাশে যেই নুড়ি পাথর, তারও চারপাশে একটি কাঠের তৈরি প্ল্যাটফর্ম আছে, যেটার তিন ধাপ ওপরে উঠে আমরা লেকের মাঝের দৃশ্য দেখতে পাই। সেই প্ল্যাটফর্মটিতে প্রতি ছয় ফিট পর পর একটি করে পোস্ট এবং সেগুলো ভেলভেটের দড়ি দিয়ে যুক্ত করা, আর প্রতি তৃতীয় পোস্টে হয়তো লাল না হয় হলুদ লণ্ঠন জ্বলে। সেই হলুদ-লাল আলোর প্রতিফলনে পুকুরের ভেতরে চিকচিক করা নুড়ি পাথর দেখা যায়, আর সময়-অসময়ে পানির ছাটের শব্দ পাওয়া যায়, এবং ভাগ্য ভালো হলে হঠাৎ এক ঝলক গাঢ় মাছের আঁশের ক্ষীণ আলো বা হলদে চুলও দেখতে পাওয়া যায়। প্ল্যাটফর্মটি সার্বক্ষণিকভাবে দু’জন গার্ড পাহারা দেয়, তা সত্ত্বেও কেউনা কেউ কখনো না কখনো লেকে বাদাম বা পপকর্ন ছুঁড়ে মারে। বলা হয় যে লেকে তিনটা মাত্র মৎস্যকন্যা আছে, আর তা দেখার জন্যই ঘণ্টার পর ঘণ্টা অস্যংখ মাথা অধির আগ্রহে ভেলেভেট দড়ির ওপর দিয়ে ঝুঁকে থাকে।
চার
বার্নাম মিউজিয়ামের শত্রুরা বলে যে এখানকার প্রদর্শনীগুলো নাকি প্রতারণাপূর্ণ, শিশুদের জন্য ক্ষতিকর। এগুলো নাকি শিশুদের প্রকৃতি থেকে দূরে সরিয়ে এক চমৎকার মিথ্যার রাজ্যে নিয়ে যায়, যেই রাজ্যের অনেক অংশই উত্তেজক, কামদ ও অসৎ। এই জাদুঘর নাকি এক বিস্ময়কর মন্দির, যা শিশুদের সূর্য ও স্বাস্থ্যকর সাধনা থেকে দূরে সরে যেতে প্রলুব্ধ করে আর বিনিময়ে নিত্যদিনের জীবনে অতৃপ্তি এনে দেয়। জাদুঘরটি নাকি জ্যোতিষ, গণক, জুয়াচোর এইসব প্রতারণাপূর্ণ জিনিস দিয়ে সাধারণ মানুষদের প্রলুব্ধ করে। এর অদ্ভুত চক্ষুশূল অস্তিত্ব ও বিরক্তিকর অঙ্গবিকৃত সংগ্রহ নাকি তাদের প্রশান্তি নষ্ট করে, শক্তির ক্ষতিসাধন এবং গোপনে দুর্বলতা ও বিভ্রান্তি সঞ্চার করে। কেউ কেউ বলে যে এই কুৎসাগুলো নাকি জাদুঘর পরিচালকরাই আবিষ্কার করেছে, যাদের ধারণা বিতর্ক দর্শকদের উপস্থিতি বাড়ায়।
পাঁচ
একটি হলঘরের প্ল্যাটফর্ম মার্বেল পাথরে তৈরি, যেটি লাল ভেলভেটের দড়ি দিয়ে ঘেরাও করা। প্ল্যাটফর্মের ঠিক মাঝখানে একজন কৃষ্ণকায় লোক উজ্জ্বল সাদা পাগড়ি পরে, সামনে একটি মোড়ানো কার্পেট নিয়ে, দুই পা গুটিয়ে বসে থাকে। ঠিক সময় হলে সে হালকা সামনের দিকে ঝুঁকে তার সরু-লম্বা আঙ্গুল দিয়ে কার্পেটটি খোলে। গাঢ় নীল রঙের কার্পেটটির দৈর্ঘ্য ৬ ও প্রস্থ ৪ ফিট, গায়ে গাঢ় লাল ও সবুজ রঙের জটিল আরবীয় নকশা ও দুই ধারে ছোট সাদা পাড়। শারদীয় লোকটি কার্পেট খুলে তার যে কোনো একটি পাড়ের দিকে মুখ করে বসে ও তার লম্বা কালো হাত পায়ের ওপর রাখে। এরপর সে জাদুমন্ত্রের মতো দুটি অক্ষর উচ্চারণ করে, যা শুনতে কিছুটা ‘আহ্-লেক্’ বা ‘আঘ্-লেহ’ এর মতো। আর তারপরই শুরু হয় জাদু, কার্পেটটি আস্তে করে হওয়ায় ভেসে ওঠে। মৎস্যকন্যাদের হলঘরটি থেকে এটি সম্পূর্ণ আলাদা, প্রচুর আলোয় আলোকিত। আমাদের বিশদ পর্যবেক্ষণকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য সে প্রথমে মেঝে থেকে ত্রিশ ফিট উঁচুতে সামনে-পিছে উড়ে বেড়ায়; তারপর ঝাড়বাতিগুলোর ভেতর দিয়ে, জানালার তাকে ওপর গিয়ে বসে কিছুক্ষণ, আবার হুটহাট মানুষের ভিড়ের আস্তরনের ওপরও নেমে আসে। কার্পেট টাকে উড়ন্ত অবস্থায় দেখে কখনো শক্ত মনে হয় না; বরং কেমন একটা তরঙ্গের সৃষ্টি করে, লোকটির দেহের ওজন কার্পেট একটা গর্তও সৃষ্টি করে। কোনো কোনো দিন বিকেলজুড়েই সে শূন্যে ভেসে বেড়ায়। আর যেহেতু এতক্ষণ ঘার উঁচিয়ে রাখা আমাদের জন্য কষ্টকর, সেহেতু খুব সহজেই সে হুট করে আমাদের চোখে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে।
ছয়
বার্নাম মিউজিয়ামের কক্ষ আর হলঘরগুলোতে কখনো কখনো এক আনন্দমেলার আবহাওয়া বিরাজ করে। বাজিকররা ঘুরে বেড়ায় ও তাদের রঙিন বলগুলো ওপরে ছুড়ে খেলা করে, সঙগুলো লাফিয়ে গড়াগড়ি খায়, লাল-নীল টুপি পরা বাদাম বিক্রেতাদের চেঁচামেচিতে জাদুঘর মুখর হয়ে থাকে। একেক জায়গায় দেখা যায় শিল্পীরা ইজেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তারা পাখির ছবি আঁকে, এমন পাখির ছবি আঁকে যা ক্যানভাস থেকে বের হয়ে উড়ে গিয়ে জানালার ধারে বসে। জাদুকরদের দেখা যায় টুপি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে, যেখান থেকে বের হয়ে আসে এক টুকরো সবুজ ঘাসের জমি, যেখানে দেখা যায় সাদা রঙের টেবিল-চেয়ার এবং ওক কাঠের লণ্ঠন। এরকম আনন্দমুখর হলে কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবো তা ঠিক করা কঠিন; আর খুব স্বাভাবিকভাবেই দেখা যায় যে, কেউ নীল-হলুদ খাঁচায় পাখার ভারে নুয়ে পড়া ক্লান্ত গ্রিফিনটিকে (সিংহ+ঈগল) খেয়ালই করে না।
সাত
দর্শকদের মাঝে এমন একদল আছে যারা ভেবেচিন্তে জাদুঘর প্রদর্শনীগুলোর কার্যকারিতার যান্ত্রিক ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে, আর এই ব্যাখ্যাগুলো আমাদের এমন মাত্রায় সন্তুষ্ট করে, যা আগ্রহ ও বিস্ময় আরও বাড়িয়ে দেয়। কেউ কেউ বলে যে উড়ন্ত কার্পেটটি অদৃশ্য তারের মাধ্যমে চলে, অন্যদের মতে এতে নাকি লুকানো মোটর আছে, আবার কেউ কেউ বলে যে মার্বেল প্ল্যাটফর্মের ভেতর থেকে বৈদ্যুতিকভাবে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যারা এর ব্যাখ্যা প্রদান করে তাদের মাঝেই আরেকটা দল জাহির করে যে, যদি সত্যি সত্যি কোন কার্পেটটির কার্যকারিতা যান্ত্রিক হয়, তাহলে সেই যান্ত্রিকতা নাকি স্বয়ং জাদুর থেকেও অবিশ্বাস্য, অসাধারণ। অপরদিকে মৎস্যকন্যাদের দেখলে হুট করে মনে হতেই পারে যে আসল মানুষের নিচে নকল মাছের লেজ লাগিয়ে দিয়েছে; কিন্তু এখন পর্যন্ত এই ধারণার কোনো প্রমাণ মেলেনি। এমনকি প্রতি রোববার বেলা ৩-৫টা পর্যন্ত ছবি তোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে শুধু মানুষের এ ধরনের সন্দেহের জন্য। তবুও প্রতিটি ফটোগ্রাফে ওই মাছের লেজের অবিশ্বাস বস্তু ঘনত্ব আর হুবহু মাছের শরীরের আচরণের আড়ালে কখনোই মানুষের পায়ের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ছবিগুলো বরং মানুষের শরীর ও মাছের লেজের এক আশ্চর্য মিলনের নির্ভুল দলিল। আমাদের মাঝে অনেকেই আছে যারা ওই মৎস্যকন্যাদের অনাবৃত স্তন দেখার লোভে ওই হলঘরটিতে যায়; কিন্তু শিগগিরই তাদের মনোযোগ নিচের অর্ধেকের ওপর চলে যায়, যা মুহূর্তের জন্য রহস্যজনক ভাবে জ্বলে উঠেই আবার পুকুরে মিশে যায়।
আট
বার্নাম মিউজিয়ামে ভূগর্ভস্থ ভাগ তিনটি। প্রথম ভাগ যে কোনো ওপর তলার মতোই, শুধু ব্যতিক্রম ব্যাপার হচ্ছে এই যে এখানে কোনো ধরনের জানালা নেই আর কোনো প্রকার সূর্যের আলো ছাদের আলোর সঙ্গে মিশ্রিত হতে পারে না। দ্বিতীয় ভাগ আরও অন্ধকার আর অমসৃণ, ওল্ড-ফ্যাশন কাচের বাতি বাতাসে হিসহিস করে, ঘোর-পাক খাওয়া করিডোর আমাদের এক গোলকধাঁধায় নিয়ে যায় আবার ফিরিয়ে আনে। তৃতীয় ভাগে যাওয়ার সিঁড়ি পাথরের আবার মেঝেতে পাথর ছড়ানো-ছিটানো, টর্চের আলো ভেজা স্যাঁতসেঁতে দেয়ালে চড়চড় করে, কালো বামুনের দল হুট-হাট করে হাজির হয় আর লাফ-ঝাঁপ শুরু করে অন্ধকারের মাঝে। এই ভাগের সমস্তই গুহা আর এই গুহা গুলোতে চলাফেরা করার জন্য যেই সংকেত সেগুলো প্রায়ই নষ্ট, অল্প কিছু বর্ণ মাত্র স্পষ্ট। কেউ কেউ এই ঘুটঘুটে অন্ধকার গুহার মুখ থেকে কয়েক কদম ভেতরে ঢোকার ঝুঁকি নেয়, আর এমন কিছু অদ্ভুত প্রাণীর সংকেত পেয়ে ফিরে আসে যেগুলো নাকি হাজার বছর ধরে ঐসব গুহায় বসবাস করে, যেগুলোর দিকে তাকানো বিপজ্জনক। অনেকেই বিশ্বাস করে যে এই গুহাগুলো জাদুঘরের আসল সীমানা ছাড়িয়ে মাটির নিচ দিয়ে সমস্ত শহরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে। কোনো কোনো গুহার মুখে দেখা যায় নিচে নেমে যাওয়া সিঁড়ি। এই সিঁড়িগুলোর গন্তব্য সম্বন্ধে কারু ধারণা নেই। তবু কেউ কেউ বলে যে নিচেও নাকি আরেকটি ভাগ আছে, পিচের মতো কালো আর ভয়ানক, যেখানে যাওয়া শুরু করলে পাগল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আবার অনেকের ধারণা নিচে আর কোনো ভাগ নেই, এই সিঁড়িগুলো বরং গভীর থেকে গভীরে যেতে যেতে পৃথিবীর একদম কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে যায়।
নয়
এটা ধরা যেতে পারে যে বার্নাম মিউজিয়াম ছোটদের জাদুঘর এবং এটা অবশ্যই সত্য যে, ছোটরা উড়ন্ত কার্পেট, খাঁচা বন্দি গ্রিফিন (সিংহ+ঈগল), পঙ্খিরাজ ঘোড়া, যারে বন্দি বামুন, গ্রেলিং (বর্বর প্যারাডক্স), লোর্যাক্স (গাছেদের হিরো), টাওয়ারের দৈত্য, ক্ষুদে পরী, অদৃশ্য মানব, নারীর চেহারা ও স্তনওয়ালা পাখি, স্বচ্ছ মানুষ, লেকের মাঝের শহর, পিতলের মানবী এসব খুবই উপভোগ করে; কিন্তু বাস্তবে প্রাপ্তবয়স্করাও এসব দারুণ উপভোগ করে। এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত যে বার্নাম মিউজিয়াম কেবলমাত্র কেন, প্রাথমিকভাবেও ছোটদের জাদুঘর নয়। যদিও এর হলঘরগুলোতে সব সময়ই ছোটদের দেখা যায়; কিন্তু তাদের ছাড়াও প্রাপ্তবয়স্ক যুগল, টিনেজার, বিজনেস স্যুট পরা পুরুষ, নীল জিন্স আর স্যান্ডেল পরা ছিপছিপে নারী, হাত ধরে ঘুরে বেড়ানো প্রেমিক-প্রেমিকা, এক কথায় সব ধরনের প্রাপ্তবয়স্কদেরই দেখা যায়, যারা ঘুরে ফিরে বারবার জাদুঘর পরিদর্শনের জন্য আসে। যদি কেউ বলে যে এখানকার কিছু কিছু প্রদর্শনী ছোটদেরই সবচেয়ে বেশি আবেদন করে, তখন আমি বলবো যে এমনও অনেক প্রদর্শনী আছে যা ছোটদের একেবারেই হতবুদ্ধ করে দেয়; তাছাড়া ছোটদের তৃতীয় ভাগে নামায় ও কিছু কিছু তাঁবুতে প্রবেশ করায় স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা আছে। আসলে জাদুঘর নিয়ে ছোটদের সম্পর্কে এই ধারণা করায় একটা বিরাট ভুল আছে, তা হলো ওদের এমন এক সাধারণ প্রজাতির ভাবা যাদের মাত্র একটি দুটি বিমূর্ত মানসিক বৈশিষ্ট্য আছে, যেমন সরলতা ও বিস্ময়। বাস্তবে এই ছোটরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিচক্ষণ ও সন্দেহপ্রবণ, বিস্মিত হওয়া সত্ত্বেও প্রশ্ন করে, যান্ত্রিক ব্যাখ্যার জন্য সহজেই অধৈর্য হয়ে পড়ে। ছোটদের বার্নাম মিউজিয়ামে নিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা সব সময় আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে না। আর অনেক পিতা-মাতা চায় কামদ হলগুলোতে একা ঘুরে বেড়াতে, প্রাপ্ত বয়স্ক লিপ্সা, একঘেয়েমি ও পুলকের মাঝে স্বাধীন হয়ে ঘুরে বেড়াতে।
দশ
একটা হল আছে যেখানে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায় ঘন জঙ্গল। আমাদের হাঁটার জন্য লাল মখমলের দড়ি দিয়ে ঘোর প্যাঁচ দেওয়া পথ তৈরি করা। সময় অসময়ে হুটহাট পেঁচার ডাকের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। এই হলটির ছাদ রাতের আকাশের মতো করে রঙ করা আর একটি নকল চাঁদ দিয়ে সমস্ত হলঘরটি আলোকিত করা, যেন পুরো জায়গাটি একটি চাঁদনী শ্যামল ডাঙা। হাঁটার রাস্তার দুইপাশের গাছপালাগুলো ভেলভেটের দড়ি দিয়ে আবৃত করা, কিছু কিছু জাগায় দড়ি ছাড়া পথ, যেগুলো গাছের মধ্যে এক অন্ধকার পথের দিক নির্দেশ দেয়। এটাই সেই জায়গা যেখানে অদৃশ্য মানবরা তাদের অস্তিত্বের জানান দেয়। তারা আস্তে করে আমাদের হাতে হাত বোলায়, হাঁটার সময় ঘাসগুলো নিয়ে দেয়, আমাদের চোখের কাছে হালকা করে নিঃশ্বাস ছাড়ে, পায়ের পাতায় পা রাখে। এসব ঘটনায় ছোটরা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, স্ত্রীরা ভয়ে স্বামীর দেহে লেপ্টে যায়, বাবারা অপ্রত্যাশিত হাসি দিয়ে আশেপাশে তাকায়। হঠাৎ কেউ একজন ভয়ে কেঁদে উঠলে গার্ডরা তাদের হলের বাহিরে নিয়ে যায়। যখন দেখা যায় যে কোনো দর্শক অধৈর্য হয়ে বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে, বিরক্ত হচ্ছে, আবার কোনো এক অন্ধকার পথের দিকে এগুচ্ছে চুলে হালকা অদৃশ্য স্পর্শ পাওয়ার আশায়; তখন নিশ্চিত ধরে নিতে হবে যে তাদের কাছে অদৃশ্য মানবরা নিজেদের প্রকাশ করবে না।
এগারো
এটা সম্ভব যে, এই শহরের প্রতিটা মানুষ তার জন্ম-মৃত্যুর মাঝে অন্তত একবার হলেও একসঙ্গে বার্নাম মিউজিয়ামে আসবে। আর এটাও অসম্ভব নয় যে, কোনো একটা সময় পৃথিবীর সকল অধিবাসীরা নিজেদের এই জাদুঘরে আবিষ্কার করবে। মায়েরা তাদের বাচ্চাদের বগি টানতে টানতে, বৃদ্ধরা বোতলের ওপর ঝুঁকে থাকতে থাকতে, মেয়েদের দল, পুলিশ, ফাস্ট ফুড রাঁধুনী, ছোটখাটো দলের অধিনায়ক, সবাই, একসঙ্গে। কোনো একটা মুহূর্তে শহরটা একদম জনশূন্য হয়ে উঠবে। আমাদের সমষ্টিগত মনোযোগই (প্রদর্শনীর প্রতি) জাদুঘরের হলগুলোতে নিখুঁতভাবে ফুলে-ফেঁপে ওঠার ব্যবস্থা করে দেবে। বাহিরের রাস্তাঘাট আর দালানগুলো তখন অস্পষ্ট হয়ে উঠবে, অলিগলি বিলীন হতে শুরু করবে, অগোচরে কোনো এক ময়লার বাক্সের ঢাকনা বাতাসে উড়তে উড়তে পৃথিবীর কোনাটায় চলে যাবে।
বারো
একটা কক্ষের নাম ‘অবাস্তব কক্ষ’। সেখানে আছে গার্ডদের মোমের মূর্তি, থ্রি ডাইমেনশনের ভ্রান্ত দরজা, নকল দাড়ি-মোচ ও হাফপ্যান্ট, কৃত্রিম গোলাপ ফুল, নকল চিত্রকর্ম, ঠগ ওষুধ, ভণ্ড জীবাশ্ম, সিনেমায় ব্যবহার করার তুষার, নকল কালি ছুড়ে মারার যন্ত্র, ভূতের কথাবার্তা, মঙ্গল গ্রহের মাছি, ভৌতিক ছায়া, এলিয়েনদের পায়ের ছাপ, অধ্যাপক রিকার্ডো ও তার কথা বলতে পারা ঘোড়া বোবো, নকল নাক, কাচের চোখ, মোমের আঙ্গুর, গোপনাঙ্গের নকল চুল, ফাঁপা উপন্যাস, উইস্কির ফ্লাস্ক, কাল্পনিক জায়গার জিনিসপত্র, আটলান্টিক মহাসাগরের রঙিন পাথর, এল-ডোরাডোর সোনার পেয়ারা, যৌবনের ঝরনার পানি। এই প্রদর্শনীগুলোর উদ্দেশ্য আসলে স্পষ্ট নয়। এটা কি সম্ভব যে অন্যান্য হলের প্রদর্শনীগুলোকে একটু বাস্তব করে দেখানোর জন্য এই কক্ষটি এত অবাস্তব জিনিসপত্রে ঠাসা? নাকি পরিচালকরা রসিকতা করে এই একটা কক্ষের সম্পূর্ণ জাদুঘরের প্রকৃতি তুলে ধরেছে? আরেকটা ব্যাপারও হতে পারে, এটা আসলে একটা টোপ, আমাদের আরও গভীর চিন্তায় ফেলার টোপ, আগ্রহকে খেপানো ও উৎসাহকে চেতানোর টোপ।
তেরো
আমরা এই জাদুঘরে ঘুরতে আসি, ঘুরে বেড়াই, যখন খুশি তখন বের হয়ে যাই; কিন্তু যারা এই জাদুঘর ছেড়ে কখনো বের হতে পারে না তারা আমাদের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করে। এই যে জাদুঘরের কর্মচারীরা, যাদের মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হলো সবুজ পোশাকে ও ঝকঝকে পলিশ করা জুতা পায়ে গার্ডরা, এরাই আমাদের অবাক করা জাদুঘরের চির বাসিন্দা। জাদুঘরটি কঠোরভাবে কর্মী নিয়োগ করা আর তাদের কাছ থেকে অবিরাম কাজ, আদর্শ ও ভক্তি আদায় করার জন্য বিখ্যাত। আর এর জন্যই এরা দর্শকদের প্রশ্নের প্রতি সর্বদা মনোযোগী, অবিচলিতভাবে সভ্য, সতর্ক ও আনন্দময়। শুনেছি এসব গার্ডদের জাদুঘরের সবচেয়ে ওপর তলায় বাসা ভাড়া দেওয়া হয়। সুতরাং তাদের জীবনের অধিকাংশ সময়ই এই জাদুঘরের দেয়ালের মাঝে অতিবাহিত করতে হয়। গার্ড ছাড়াও আমরা আরও যাদের দেখতে পাই তারা হলো, ঢিলে বাদামি পোশাকে পরিচারিকা, বাদাম বিক্রেতা, গিফট্ শপের দোকান, টিকিট বিক্রেতা, কোট চেক করার মহিলা, মেরুন পোশাক পরা গাইড, খাঁচার গ্রিফিনদের রক্ষক, কাঠের পাহাড়ে ইউনিকর্নদের রক্ষক, গুহার গ্রেলিংদের রক্ষক, সং আর বাজিকর, বেলুনওয়ালা, দীপ ও মশাল প্রজ্বলক, ইলেকট্রিশিয়ান, এরা সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত সার্বক্ষণিক কাজ করে যায়। এসব কর্মচারীদের আমরা চোখেই দেখতে পাই; কিন্তু আরও কিছু কর্মী এখানে আছে যাদের কথা আমরা শুধু কারণেই শুনি আর মনেই ধারণা করি। ওপরতলার ছোট দূরবর্তী করিডোরের ছোট কক্ষগুলো প্রশাসক, গবেষক ও ঐতিহাসিক, মহাফেজখানার সংরক্ষক, টাইপ রাইটার, বার্তাবাহক, হিসাব রক্ষক, বৈধ উপদেষ্টা ও পরিচালক। আশ্চর্যের বিষয় এটা নয় যে কর্মীরা সংখ্যায় প্রচুর; বরং এটা যে এরা জীবনের অধিকাংশ সময়ই জাদুঘরে কর্মরত থাকে। অদ্ভুত আর আশ্চর্যের এই জগতে নিমগ্ন হয়ে তারা যেন ভিন্ন এক জাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে, যারা সাধারণ বিশ্বে অস্বাচ্ছন্দ্য, মৃত্যু থেকে ফেরত আসা কিংবা জিন-পরীদের মতো।
চৌদ্দ
হ্যানা গুডউইন নামে হাইস্কুলের জুনিয়র ক্লাসের এক ছাত্রী ছিল। সে খুবই সাধারণ, চুপচাপ একটা মেয়ে। ক্ষীণ-ম্লান বাদামি চুল মাঝ বরাবর সিঁথি কাটা; আর সেই বিস্ফোরিত সাদা মাথা, যা সে মাংসের রঙের এক মলম দিয়ে ঢেকে রাখতো, আর তাকে আরও বিশ্রী দেখাতো। খুব সাধারণ সাজ-সজ্জা, পরিষ্কার প্লেইন শার্ট আর পায়জামা। স্কুলে সবসময় একা একা চলতো, কারু সঙ্গে কথা বলতো না, সারাক্ষণ নত চোখ, আর কেউ প্রশ্ন করলেও অন্য দিকে ফিরে খুব দ্রুত উত্তর দিতো। ব্যক্তিগত জীবনে সে অনেক কর্মঠ, কখনো কোনো ছেলের সঙ্গে বাহিরে যেত না, একজন মাত্র বান্ধবী ছিল তার, যে বছরের মাঝখানে শহর ছেড়ে চলে যায়। হ্যানার সেই বান্ধবী চলে যাওয়ায় ও অনেক হতাশ হয়ে পড়ে। আর সেই সময় থেকেই সে প্রতিদিন স্কুল শেষে বার্নাম মিউজিয়ামে যেতে শুরু করে। যতই দিন যেতে থাকে ততই তার জাদুঘর পরিদর্শনের সময় বাড়তে থাকে, আর শিগগিরই সে রাত করে বাড়ি ফেরা শুরু করে। তার ভেতর একটা অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা গেল; যদিও সে এখনো একাই চলাফেরা করে আর ক্লাসে কিছুই বলে না, তবু তার মধ্যে একটা নতুন উদ্দীপনা দেখা দিল, তার ধূসর চুলে, পান্ডুর ঠোঁটে আর সাদা ঘাড়ে দেখা দিল প্রবলতা। এমনকি তার হাঁটার ধরনও রদবদল হয়ে গেল, যেন এক রুক্ষতা আর বাধ্যবাধকতা তাকে ছেড়ে চলে গেল। একদিন এক ছেলে তাকে সিনেমায় যাওয়ার প্রস্তাব দিলে সে খুবই বিরক্তির সঙ্গে না করে দেয়। এসবে তার ক্লাসের কাজে কোনোই বাধা পড়লো না, কেননা নিয়মানুবর্তিতা তার পুরনো স্বভাব; কিন্তু চোখের সামনে সে তার নিত্য রুটিনে অসহ্য হয়ে উঠলো। আর যতই তার পদক্ষেপ দৃঢ়, দৃষ্টি নিশ্চিত আর চোখ জ্বলন্ত প্রত্যাশায় সবুজ বোর্ডের ওপর ঘড়ির দিকে তাকাত, তখন এটা স্পষ্ট বোঝা যেত যে সে এক প্রকার অন্তরের বাধা থেকে মুক্ত হয়েছে। এক প্রেমে পড়া নারীর মতো সে উঁচু টাওয়ার, ঘোর-পাক খাওয়া সুড়ঙ্গ, সর্বদা লোভনীয় দরজাওয়ালা বার্নাম মিউজিয়ামের দিকে স্প্রে দিল।
পনেরো
বার্নাম মিউজিয়ামে বাহিরের এবং ভেতরের দিকে, দুই ভাবেই ব্রিজ আছে। বাহিরের ব্রিজগুলো উঠান থেকে শুরু করে, স্ট্যাচু ঘেরা বাগান, বাহিরের ছাতাওয়ালা ক্যাফে পর্যন্ত বিস্তৃত; এতে করে দর্শকরা বাহির দিক দিয়েই জাদুঘরের একপাশে থেকে আরেকপাশে যেতে পারে। এই ব্রিজের নিচেই বেলুনওয়ালা গ্রিফিন আকৃতির লাল-নীল বেলুন নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, বাদকরা হার্ডি-গার্ডি বাজায়, বাদামি প্যান্ট পরা বালক তার হাতে জুসের গ্লাসে ব্রিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে, হলুদ লম্বা চুলওয়ালা তরুণী হাস্যরত মূর্তির ছায়ায় বিশ্রাম করে। ভেতর দিকের ব্রিজগুলো আবার ওপরতলার হল পর্যন্ত বিস্তৃত। দেখা যায় যে নিচতলার কোনো এক কক্ষ থেকে একটা দরজা দিয়ে ঢুকে আমরা আমাদের পাশের কক্ষে না পেয়ে বরং আবিষ্কার করি পাঁচতলায় উঠে যাওয়া কোনো এক ব্রিজের মুখে। কিছু কিছু ব্রিজ বলিষ্ঠ কাঠের আর পাশ দিয়ে লোহার রেলিং দেওয়া, যেগুলো থেকে বিভিন্ন কক্ষের দরজা ও নিচতলার মেঝেও দেখা যায়। আবার কিছু কিছু ব্রিজ চওড়া, মার্বেল পাথরের, যার দুইপাশে বিভিন্ন দোকান; কয়েন টসের বুথ, পুতুল নাচের ঘর, জ্যাক ইন দ্য বক্স, চকলেট তৈরি সার্কাসের পশু, স্বচ্ছ মার্বেল, ছোট মৎস্যকন্যা, পঙ্খীরাজ ঘোড়া আর পূর্ণিমার জঙ্গল, এসব বিক্রির দোকান। এসব দোকানের ফাঁক দিয়ে কখনো কখনো ভেলকিওয়ালার বল, তাঁবুর চূড়া আর কোনো কক্ষের বাঁকা দরজার ঝলক পাই।
ষোলো
কিছু কিছু সময় থাকে, যখন আমরা জাদুঘরটি উপভোগ করি না। প্রদর্শনীগুলো আমাদের আশ্চর্য করে না। এত এত দরজা আর হল আমাদের ভেতর বিরক্তি আর বমির উদ্রেক করে। গ্রিফিনগুলোর চোখে আমরা বিষন্নতার ছাপ দেখতে পাই। ঘৃণা নিয়ে আমরা একেকটা হলে ঘুরতে থাকি আর ভাবি যেন জাদুঘরটা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এরকম সময়গুলোয় আসলে পেছনে না ফিরে বরং নিজেদের নির্জনতায় ছেড়ে দেওয়া উচিত। সন্দেহজনক এই হলগুলোতে হতাশাগ্রস্ত চোখ, হীন বিভ্রম, বোকা বোকা চেহারা, মোহমুক্তি, এসব ধর্মা দ্রোহীতা জাদুঘরের ধৈর্যের কাছে টিকে যাবে; আর এগুলো বরং আমাদের জাদুঘরের সঙ্গে একটু ভিন্নভাবে জড়িত করবে।
সতেরো
বার্নাম মিউজিয়ামের উড়ন্ত পাটি, জাদুর ল্যাম্প, মৎস্যকন্যা ও গ্রেলিংস, এসব উল্লসিত কক্ষগুলো থেকে বের হয়ে আমরা কখনো কখনো ভিন্ন এক ধরনের কক্ষে এসে হাজির হই। সেখানে আমরা খুঁজে পাই পুরনো রঙের কৌটা ও তেলপাত্র, ভাঙা বালতিতে সবুজ রঙ লাগানো দস্তানা, দেয়ালে হেলানো জং ধরা বাইসাইকেল, পুরনো মনপলি খেলার কোর্ট, দুঃখ আর বিপদ, ৭৮টি রেকর্ডের গাদা ও একটি কুকুরের সঙ্গে ভিক্ট্রোলার পেইন্টিং, পশুর চার নখরে দাড় করানো ওক কাঠের পুরনো টেবিল ইত্যাদি। এই কক্ষগুলোকে ভুল ও ত্রুটিপূর্ণ মনে হয়, অথবা এমন কক্ষ যা সংস্কারের অপেক্ষায় পড়ে থাকা কক্ষ, যা কর্মচারীদের প্রত্যাখ্যান জিনিসপত্রে ভরে উঠছে। তবুও এইসব কক্ষে আমরা গভীর কোনো অর্থ খুঁজতে থাকি। বার্নাম মিউজিয়াম একটি আশ্চর্যের রাজ্য, কিন্তু এত এত আশ্চর্য থেকে আমাদের কি কখনো বিরতির দরকার হয় না? বিক্ষিপ্ত ভাবে পড়ে থাকা এই অতিসাধারন কক্ষগুলো আমাদের বিস্ময় এর অত্যাচার থেকে মুক্তি দেয়। এই হলো কক্ষগুলোর সাধারণ ব্যাখ্যা; কিন্তু তা সত্ত্বেও এর মাঝে আরও গভীর অর্থ বের করা সম্ভব। এত সব বিস্ময় থেকে হুট করে যখন আমরা এই নিত্য নৈতিক এই দৃশ্যগুলোর মধ্যে ফিরে আসি, তখন এই অদ্ভুতুরে ভাবটাই আমাদের অবাক করে দেয়। তাই এই সাধারণ কক্ষগুলো জাদুঘরের পরিবেশের কোনো ব্যাঘাত তো ঘটায়ই না, বরং এর বিস্ময়কে দ্বিগুণ করে দেয়।
আঠারো
এটা অবশ্যই স্বীকার করা দরকার যে, বার্নাম মিউজিয়ামের এতসব গুণাবলি থাকা সত্ত্বেও একটা দৃঢ় রুক্ষতা আছে। আর এই রুক্ষতা প্রকাশ পায় জাদুঘর স্থাপত্যের কর্কশতায়, কিছু প্রদর্শনীর কামুকতায়, হলগুলোর বেপরোয়া প্রাচুর্যে, এমনকি মানুষদের আকর্ষণ করা ছোটখাটো বিষয়েও। কিছু হলের এবং রাস্তার পেছন দিকের অংশের মেঝেতে প্রচুর বাতাসের নল গোপন করা আছে। অনিশ্চিতভাবে দিনের যে কোনো সময় সেগুলো থেকে বাতাস ফিনকি মেরে ওপরে ওঠে, আর কখনো কখনো দর্শকদের স্কার্ট, জামা ওপরে উঠিয়ে দেয়। ফান হাউসের এই অমার্জিত বিষয়টা নিয়ে জাদুঘরের শত্রুরা অনেক তীক্ষ্ণ সমালোচনা করেছে। আসলে এই নলগুলো অনেক আগের আমলে স্থাপিত, যখন জাদুঘরে আসা সব মহিলা অনেক লম্বা বিশদ জামা পরতো; এই সত্য কথাটি কোনো প্রতিরক্ষা হিসেবে বলছি না, কেননা তখনকার ফটোগ্রাফগুলোতেও দেখা যায় যে, সুন্দর পোশাক ও কানায় কানায় পরিপূর্ণ টুপি পরা মহিলারা বিস্মিত হয়ে তাদের হাঁটুর ওপরে উঠে যাওয়া স্কার্ট ও পেটিকোট হাত দিয়ে সামলাচ্ছে। বর্তমানে প্যান্টের যুগে এই বাতাসের নলগুলো আপাত দৃষ্টিতে অর্থহীন। তা সত্ত্বেও, এখনো আমরা প্রচুর এমন নারী দেখতে পাই যারা ডোরাকাটা সুতি জামা, মনরোর সাদা স্কার্ট, কালো ছাটা স্যুট, কোমরে বেল্ট বাঁধা রেশমের জামা, জঙ্গল প্রিন্টের পোশাক, ফুলের ছাপওয়ালা পোশাক, পোলকা ডট ড্রিন্ডল্, এলো সোয়েটার ইত্যাদি পরে জাদুঘর পরিদর্শনে আসে। আর তার সঙ্গে এও দেখা যায় যে হুটহাট তাদের পোশাক উড়ে যাচ্ছে আর উঁকি দিচ্ছে গোলাপী-সবুজ প্যান্ট, থাইয়ের মোজা, ফিতা ছাঁটা সাদা স্লিপ, নাইলনের মোজার ফিতা, আর ডোরাকাটা জাঙ্গিয়া। এক একবার নলগুলো থেকে বাতাস বের হয় আর তীব্র হাসি ও উগ্র বাঁশির মধ্যে প্রকাশিত হয় এই চিত্ত উত্তেজক রঙিন দৃশ্য। আমাদের শহরের নারীগণ কিন্তু চাইলেই ফুল প্যান্ট পরে এই নলগুলোকে পরাজিত করতে পারে, তা না করে বরং নলগুলো থেকে তারা এক প্রকার উৎসাহ পায় ছোট স্কার্ট ও সুসজ্জিত প্যান্ট পরার জন্য। এর মাধ্যমে তারা হয়তো কিছু বিদ্রোহ বা আত্মসমর্পণ প্রকাশ করে। আর এই ক্ষ্যাপামি মূলত হাই স্কুলে পরা মেয়েদের মধ্যে বেশি প্রচলিত। বার-তের বছরের মেয়েরা উজ্জ্বল লাল-সবুজ লিপস্টিক দিয়ে, চোখে নকল পাপড়ি লাগিয়ে, ঝিকিমিকি লেদারের পকেট বই হাতে, চকচকে প্লাস্টিক বুটের ওপর স্কার্ট পরে জাদুঘরে ঘুরতে আসে; আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অদৃশ্য বাতাসে প্রকাশিত হয়ে যায় দামি-জাঁকাল জাংগিয়া, গোলাপি অন্তর্বাস, গোলাপওয়ালা ক্যান্ডি রঙের প্যান্টি, লাল জাংগিয়ার নিচে কালো কার্টারে আটকানো জালের মোজা ইত্যাদি। এসব অন্তর্বাসের ডিসপ্লেকে আমরা যাই ভাবি না কেন, ফান হাউসের এসব বাতাসের নলগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। এগুলো প্রতিঘাত করা মানে এর অসঙ্গতিকে জাহির করা নয়, বরং এই জোর খাটানো যে এটা অমূলক, শিশুসুলভ, উত্তেজক ও দায়িত্বহীন। আসলে এটা কোনো দায়িত্বহীনতা না, কেননা এটা জাদুঘরের গাম্ভীর্য থেকে মুক্তি দেয়, একঘেয়ে জাগতিকতা থেকে পালাতে দেয় আর জাদুঘরের সবচেয়ে সাহসী প্রদর্শনীর সৌন্দর্য আয়ত্ব করতে দেয়।
উনিশ
জাদুঘর গবেষকরা সবচেয়ে ওপর তলার ছোট কক্ষগুলোর দরজার আড়ালে কাজ করে। সাধারণ মানুষের সেখানে প্রবেশ নিষেধ; কিন্তু কিছু দর্শক দাবি করে যে তারা ওপর তলায় ঘুরতে ঘুরতে সেসব কক্ষের দরজা খোলা দেখেছে, আর সেই দরজা দিয়ে দেখেছে ভেতরে ধুল পড়া বই ঠাসা, যা মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বিস্তৃত। যদিও এই গবেষকদের অস্তিত্ব অনিশ্চিত, তবু আমরা এই সম্ভাবনাকে সন্দেহ করি না; যদিও তাদের কাজ সম্পর্কে আমরা অনিশ্চিত; কিন্তু এর প্রয়োজনীয়তাকে আমরা সন্দেহ করি না। আসলে এই গবেষকদের দূরবর্তী কক্ষগুলোর জন্যই জাদুঘরটি নিজের ওপর সচেতন হয়ে ওঠে, নিজের প্রতিফলন ঘটায়, আর নিজের কথা বলে ওঠে এমন স্বরে যা কেউ শুনতে পায় না। লোকে বলে, গবেষণার ফলাফল নাকি কদাচিৎ প্রকাশিত হয়, তাও অনেক মোটা ভলিউমে যা কিনা আবার বিশদ মাল্টিভলিউমের অংশ বিশেষ; এগুলো ওপর তলার কক্ষগুলোতেই সংরক্ষণ করা হয় আর শুধু অন্যান্য গবেষকদের মাঝেই আলোচিত হয়। কখনো কখনো সেই সরু করিডোরের কোনো কক্ষের দরজা খুলে চকের মতো সাদা মলিন কাউকে হয়তো বের হয়ে আসতে দেখা যায়। আর সেই লোক এই দ্রুত বিলীন হয়ে যায় যে, আমরা কখনোই নিশ্চিত হতে পারি না; আসলে সে পরীদের মতো অধরা, কিংবদন্তি কোনো গবেষক, নাকি আমাদের দৃষ্টি বিভ্রম। এমনটিও হতে পারে যে সেই করিডোরের শূন্যতা সহ্য করতে না পেরে আমাদের শিহরিত চোখের মাংসপেশী, রড আর কোনো, ভিজুয়াল করটেক্স ইত্যাদি ফটোকেমিক্যাল রিঅ্যাকশনের মাধ্যমে একজন গবেষকদের অস্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে আনে।
বিশ
বার্নাম মিউজিয়ামের গিফট্ শপ থেকে আমরা কিনতে পারি মৎস্যকন্যা ও ড্রাগনের ছবিওয়ালা পুরনো সেপিয়া রঙের পোস্টকার্ড, জাদুর কার্পেট ওঠানো ফ্লিপ-বই, পিপ-শো কলম যার গায়ে জাদুঘরের বিভিন্ন হলের মিনিয়েচার পেইন্টিং, আরব দেশের রহস্যজনক রাবারের বল যা মেঝেতে বাড়ি খেয়ে একবার উঠলে বাতাসে ভেসে থাকে, গাঢ় নীল তরল যা দিয়ে বাঘ, সিংহ, হাতি, ভাল্লুক আর জিরাফ আকৃতির বাবল্ ফুলানো যায়, চাইনিজ বিচিত্রদৃক যা অবিচলিতভাবে ড্রাগনের ধরন পাল্টাতে দেখায়, রঙের বক্স যা দিয়ে এমন ছবি আঁকা যায় যা নড়াচড়া করে, প্রেনিস্কোপস্ আর ফ্যান্টাট্রপস্, কালো জঙ্গলের কাঠের বল যা একবার গড়াতে শুরু করলে আর থামে না, যার সামনে রাখা হবে তার আকৃতি ধারন করতে পারা রঙিন জেলি, সূর্যের আলোতে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া চকচকে লাল বাক্স, জাপানি কাগজের প্লেইন যা হাত থেকে উড়ে বাগান পেরিয়ে ছাদে উঠে যায়, ফিনল্যান্ডের গল্পের বই যা টিস্যু পেপারে অলংকৃত ও প্রতিবার বই খোলার সময় পাল্টে যায়, বিশেষ ধরনের জল রঙ যা দিয়ে বাতাসে ছবি আঁকা যায়, আরও অনেক কিছু। এইসব খেলনা ও উপহার সামগ্রী আমাদের বিস্মিত করে ও শিশুদের আনন্দিত করে; কিন্তু আমাদের ঘরে আর হলে, ফার্নিচার পলিশ ও আলু সেদ্ধর গন্ধে ভারি হওয়া বাতাসে এই খেলনা-উপহারগুলো সহজেই কমনীয়তা হারায়, আর শীঘ্রই ক্লসেটের অন্ধকার কোনটায় ভেঙে যাওয়া পুতুলের সঙ্গে পড়ে থাকে। যারা বার্নাম মিউজিয়াম সমর্থন করে না, তারা এসব গিফট্ শপে যায় না, তাদের মতে এগুলো ভয়ানক। তারা বলে যে, এই জাদুঘর প্রকৃতিগতভাবেই আমাদের বাস্তব জগৎকে অবজ্ঞা করে, আর এই জিনিসগুলো আমাদের এক অবাস্তব জগতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে দেয়, যেই অবাস্তব জগত প্রকৃতিকে কটাক্ষ করে নিষ্পাপ শিশুদের পকেটে পকেটে ঘুরে।
একুশ
বার্নাম মিউজিয়ামে সব সময় কিছু সন্ন্যাসী বসবাস করে। এরা সে সব যাযাবর ও ভিখারীদের থেকে আলাদা, যারা প্রায়ই জাদুঘরের ভেতরে আসা গাড়িতে ওঠার চেষ্টা করে, অন্ধকার তাকগুলোতে লুকিয়ে থাকে, দর্শকদের বিরক্ত করে আর নিচতলার রাস্তাগুলোতে ঘুমায়। গার্ডরা সার্বক্ষণিক এই অনধিকার-প্রবেশকারীদের ব্যাপারে সাবধানে থাকে আর এদের কাউকে খুঁজে পেলেই বুদ্ধি করে, কাউকে কিছু না বুঝতে দিয়ে বের করে দেয়। এদিকে জাদুঘরের সন্ন্যাসীরা এদের বিপরীত। তারা বেটে আর অক্ষরে অক্ষরে বিনম্র জাতি, যাদের জাদুঘরে স্থায়ীভাবে বসবাস করার অনুমোদন আছে। এদের চুল ছোট করে ছাঁটা, গাঢ় পোশাক সাধারণ ও পরিচ্ছন্ন, আর মৌনব্রত অলঙ্ঘনীয়। তারা ক্যাফেগুলোর উচ্ছিষ্ট রোল খায়, পানি পান করে আর নির্দিষ্ট কিছু হলের যেখানে দর্শকরা যায় না সেখানে ঘুমায়। লোকে বলে যে এই সন্ন্যাসীগুলোর বিশ্বাস, জাদুঘরের ভেতরের জগৎই সত্য, দরজার বাহিরের জগৎ এক বিরাট বিভ্রম। অবশ্য এই বিশ্বাস তাদের সম্মতি ছাড়াই তাদের ওপর আরোপিত, নিজ থেকে কেউই এরকম কিছু কখনো বলেনি। এই বিশেষ মানুষগুলোর বয়স বিশ থেকে ত্রিশ এর মধ্যে হবে, এরা বিদেশি নয় বরং আমাদের শহর আর শহরতলিতেই জন্মগ্রহণ করেছে, এরা আমাদেরই সন্তান। দিনের বেশিরভাগ সসময়ই তারা পা গুটিয়ে, দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে, হাঁটুর ওপর হাত রেখে, ধ্যান করার মতো করে বসে চুপচাপ সামনে তাকিয়ে থাকে। এসব সন্ন্যাসীদের নিয়ে আমাদের মাঝে দুইটি মনোভাব প্রচলিত। একদিকে আমরা ওদের জাদুঘরের প্রতি উৎসর্গ দেখে মুগ্ধ হই, আর তাদের এই কঠিন জীবনের প্রশংসা করি। অপরদিকে তাদের বহির্জগৎ সম্পর্কে অজ্ঞানতাকে ভর্ৎসনা করি, তাদের জীবনের অত্যুক্তিকে অবজ্ঞা করি। কখনো কখনো তাদের মাঝে আমরা অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি; হয়তো এর জন্য যে জাদুঘরের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নিয়ে এরা প্রশ্ন তুলবে, আর নাহলে এমন কোনো ব্যাখ্যা চাইবে যা আমরা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত নই। বেশিরভাগ সময়ই আমরা উত্তেজনায় কঠিন হওয়া ঠোঁট আর টলমান চোখ নিয়ে এদের পাশ কাটিয়ে চলে যাই।
বাইশ
বার্নাম মিউজিয়ামের অসংখ্য হল আর কক্ষগুলোর মাঝে এমন একটি কক্ষ আছে দেখতে অবিকল অন্যান্য কক্ষগুলোর মতোই, কিন্তু আমরা যখন নীল ভেলভেটের দড়ির ওপর হাত রাখি তখন আমাদের হাত নিচে পড়ে যায়। এই কক্ষটি তে আমরা বেশ আরামেই ঘুরে বেড়াই, পেইন্ট করা পর্দা, কাচের ডিসপ্লে, স্তম্ভ আর স্তম্ভমূল, গাঢ় ওক কাঠের চেয়ার টেবিল, এসবের মাঝে স্বাচ্ছন্দ্যেই হেঁটে যাই, গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখি, হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে গল্প করি, আঙ্গুল ফুটাই। আমাদের অনুপ্রবেশ ছবিগুলো নির্বিঘ্নই থাকে। কখনো কখনো কোনো পুরুষ বা মহিলার পাশ দিয়ে হাঁটার সময় দেখা যায় আমাদের হাত তাদের হাতের সঙ্গে লেগে যাচ্ছে। যেখানে সেখানে এত মানুষের ভিড় হুট করে দেখা যায় কোনো সুন্দরী চকচকে পোস্টকার্ড দিয়ে নিজেকে বাতাস করছে। কাজটা খুব স্বাভাবিক হলেও সেই তরুণী কাজটি এমনভাবে করতে থাকে, যা তাকে কক্ষটি অন্য সবার থেকে আলাদা করে দেয়। আর এক পর্যায়ে মনে হয় সে নিজেই সেই কক্ষের একটি প্রদর্শনী।
তেইশ
যারা আমাদের বোঝেনা তারা বলে যে, বার্নাম মিউজিয়াম আমাদের পরিত্রাণের একটা মাধ্যম। অগভীরভাবে এই কথাটাকে সত্যি বলা যায়। যখন আমরা জাদুঘরে প্রবেশ করি তখন আমরা শারীরিকভাবে মুক্ত হয়ে যাই সেসব থেকে যা আমাদের বাহিরের জগতে আবদ্ধ করে, আবদ্ধ করে সূর্যরশ্মির আর মৃত্যুর রাজত্বে; আর কদাচিৎ হয়তো আমরা এখানে দুঃখ-কষ্ট থেকে রেহাই খুঁজি; কিন্তু এটা ভাবা ভুল যে, আমরা বহির্জগৎ থেকে পরিত্রাণ পেতে বার্নাম মিউজিয়ামে আসি। আমরা তো আর শিশু নই, যেখানেই যাই না কেন আমাদের নিজের বোঝা নিজেদেরই বইতে হয়; কিন্তু এই না ভুলে যাওয়ার ব্যাপারটা ছাড়াও, দেখা যায় যে, আমরা শুধু আনন্দিত বা অসন্তুষ্ট হলেই এখানে আসি, ব্যাপারটা এমন না, বরঞ্চ তার চেয়েও বেশি আমরা আসি আমাদের আত্মার শান্তি আর উদ্দীপনার সময়। জাদুঘরের শাখাবিন্যাসে আমরা সাধারণ জগৎকে কখনোই ভুলে থাকি না, কেননা ওই জগৎ সম্পর্কে সচেতনতাই আমাদের এই জগৎকে উপভোগ করতে দেয়। আমি দাবি করতে পারি যে, যখন আমরা বার্নাম মিউজিয়ামে থাকি তখনই আমরা আমাদের শহর নিয়ে সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকি; জাদুঘর ছাড়াই বরং আমাদের দিনগুলো ধাঁধা আর স্বপ্নের মধ্যে কাটতো।
চব্বিশ
কোনো কোনো দর্শকের জন্য বার্নাম মিউজিয়ামের সেই সময়টাই সবচেয়ে আনন্দের ঠিক যে মুহূর্তে জাদুঘরে প্রবেশ করা হয়, সেই প্রবেশ পথের ডাক যেন আমোদের দুনিয়ায় এক হঠাৎ নিমজ্জন। অন্যদের জন্য আবার ক্রমে রাস্তা হারিয়ে ফেলা, আর কক্ষের পর কক্ষের গোলকধাঁধায় ঘুরে বেড়ানো বেশি আনন্দের। এটা নিশ্চিত যে, এই আনন্দগুলো সতর্কভাবে কল্পিত, কারণ জাদুঘরের অলিগলি প্যাঁচানো হলেও, কেউ যদি হারিয়ে যায় সে খুব সহজেই কোনো গার্ডের সহযোগিতায় রাস্তা খুঁজে পেতে পারে। এসব সত্ত্বেও যা হৃদয়ে ভেদ করে তা হলো, বাহিরের দিকে বের হওয়া; হঠাৎ দরজা খুলে যাওয়া, উজ্জ্বল সূর্যের আলো, দোকানের ঝলসানো জানালা, ওপরতলার ক্ষণিক ধন্দ।
পঁচিশ
আমরা যারা না জাদুঘরের সন্ন্যাসী, না শত্রু, বার বার বার্নাম মিউজিয়ামে ফিরে আসি, আমরা আসলে কিছুই জানি না; শুধুমাত্র তা ছাড়া যা আমাদের একান্তই জানা উচিত। আমরা এই পরিচিত আর সর্বদা পরিবর্তনশীল হলগুলোতে পরিতৃপ্তি নিয়ে ঘুরে বেড়াই, আবার সংশয় নিয়েও; কখনো সন্দেহজনক আকারে চালাকি খুঁজে বেড়াই আবার কখনো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ঘুরে বেড়াই। যদি কখনো এই জাদুঘর অদৃশ্য হয়ে যায়, তাহলে হয়তো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কোনো তফাৎ দেখা যাবে না; কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমরা এক ভয়াবহ হ্রাসের অভিজ্ঞতা লাভ করবো। আমাদের দ্বারা এসব ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। এই জাদুঘরের অশেষ হল আর দরজা কি আমাদের জ্বালায়? এমন কোনো স্ফূর্তির প্রতিশ্রুতির দিয়ে যার কোনো অস্তিত্ব নেই? যদি তাই হয় তাহলে এটা এমন এক স্ফূর্তি যা ছাড়াই আমরা বেশ সুখে থাকব। কারণ সেই মুহূর্তে জাদুঘরটি আর কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকবে না, জাদুঘরটি স্বচ্ছ আর অদৃশ্য হয়ে যাবে। না, তার চেয়ে এই ভালো যে, যখন তখন আমরা সন্দেহ ও আশ্চর্যজনক হলগুলোতে ঢুকতে পারি। যদি বার্নাম মিউজিয়াম কখনো সামান্যতম সন্দেহভাজন হয়, যদি কখনো এরসঙ্গে সেয়ানা কিছু লেগে থাকে, তাহলে তা সরলভাবে এর প্রকৃতির অংশ, অনেক ঘটনার মতোই আরেকটি ঘটনা। আমরা বার্নাম মিউজিয়ামকে সন্দেহ করতে পারি; কিন্তু এখানে বার বার ফিরে আসার প্রয়োজনীয়তাকে কখনোই সন্দেহ করতে পারিনা। কারণ আমরা অস্থির, ইতিমধ্যেই আমরা সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করার জন্য অধৈর্য হয়ে পড়েছি, যা আমাদের নিয়ে যায় অন্যান্য দরজা সংবলিত কক্ষে, এবং আরও দূরবর্তী অন্ধকার কক্ষে, কল্পনাতীত আবিষ্কারে। আর এটা কি সম্ভব যে জাদুঘরের মূল রহস্য অবিকল এখানেই নিহিত যে, আমরা কখনোই তৃপ্তি পাব না? তা সত্ত্বেও হার্ডি-গার্ডি বাজতে থাকে, বাজিকরের উজ্জ্বল বল বাতাসে ভাসতে থাকে, এক কোনায় গ্রিফিন ঘুমিয়ে থাকে। বার্নাম মিউজিয়ামে স্বাগতম! আমাদের জন্য এটা যথেষ্ট, প্রায় যথেষ্ট।