Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

শামসুর রাহমান, এক কবিতা বৃক্ষ

Icon

কাজী দিদার

প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২১, ১৪:০৩

শামসুর রাহমান, এক কবিতা বৃক্ষ

শামসুর রাহমান, এক কবিতা বৃক্ষ

ত্রিশ-পরবর্তী বাংলা কবিতার আধুনিকতার ধারায় শামসুর রাহমান এক নমিত পুরুষ। কবিতার মায়াজালে যার জীবন উজ্জীবিত হয়েছিল। জীবনের মায়াজাল তাকে আটকে রাখেনি- নাগরিক জীবনের নানান অনুষঙ্গ তাই ধরা পড়েছিল রাহমানের কাব্যভাষায়। শব্দ প্রয়োগ, উপমা-উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্পের সুষম ব্যবহার, আর নতুন শব্দের ব্যবহার কবিতায় তাঁকে এনে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা। তাঁর কবিতায় ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলনের সাহসী উচ্চারণ সুস্পষ্ট। তিনি সময়কে উপেক্ষা করেননি, যা অনেক কবির ক্ষেত্রে অনুপস্থিত দেখা যায়। 

শহর ঢাকায় বেড়ে ওঠা রাহমান- নাগরিক কবি হয়ে ওঠেন পুরোপুরি, যা ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের মতো নাগরিক কবিরও হয়নি। আবার তাঁর কবিতায় অগ্রজ জীবনানন্দীয় স্বর ধরা দেয় স্পষ্টতই এভাবে- ‘জোনাকি মেয়েরা বিন্দু-বিন্দু আলোর নূপুরে ভরে দেয় মাঠ/গাঢ় রাত্তিরে বিষণ্ণ সুরে: তোমার রাজ্যে একা-একা হাঁটি, আমি সম্রাট!’ (রুপালি স্নান)। তিনি ত্রিশের পঞ্চপাণ্ডব দ্বারা প্রভাবিত হলেও শেষাবধি তাঁর নিজস্বতা তাঁকে নিয়ে গেছে সময়ের শিখরে। জীবৎকালে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা রাহমান স্বাধীনতা সংগ্রামেরও একক কবি বলা চলে। 

পঁচিশে মার্চ রাতে কবি চলে গিয়েছিলেন গ্রামে; কিন্তু যখন ফিরে আসেন- তখন শহর তছনছ হয়ে আছে। মানুষ মরছে, শিশুর কান্না, গুমোট বাতাস, দম বন্ধ অবস্থা যেন। রাতে তিনি শুয়ে থাকতেন কিন্তু পেত না এমনই ছিল সেই সময়। রাহমান বুঝে নেন- এ এক বন্দি দশা যেন। গলা টিপে শ্বাসরোধ করার চেষ্টায় রত সময়।

একদিকে মৃত্যু আরেক দিকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই- প্রতিপক্ষ কেবল হায়েনা। বাংলা কবিতার রৌদ্রালোকিত কবি লিখতে থাকেন কবিতা। ১৯৭২ সালে শামসুর রাহমানের ‘বন্দি শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ পায়। মোট ৩৮টি কবিতা ছিল এ গ্রন্থে, যার অধিকাংশ কবিতাতেই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তির পট প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি লেখেন- ‘স্বাধীনতা তুমি/উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন। (স্বাধীনতা তুমি)। আবার যখন তিনি লেখেন ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ’- তখন তাঁকে স্বৈরশাসকের ক্যান্টনমেন্টও কৈফিয়ত চেয়েছিল। কবিতার ভাষার তীক্ষ্ণতম সময় যেন আমরা এভাবেই দেখতে পাই তাঁর কবিতায়। 

২.

প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ যেমন ছিলেন রাহমানের একনিষ্ঠ অনুরাগী পাঠক আবার তেমনই ছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষুরধার সমালোচকও। হুমায়ুন আজাদ ‘মিজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা’য় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে কবিকে বলেছিলেন- “এখন আপনার নাম সারা বাংলাদেশে, বাংলাদেশের বাইরেও পরিচিত। এখন আপনি এক ধরনের ফ্যাশনও হয়ে উঠেছেন : কিশোরীরা, কিশোররা, তরুণেরা, নির্বোধ অধ্যাপকরা, দুশ্চরিত্র আমলারা, এমনকি মাংসল চিত্রতারকারাও আপনার নাম উচ্চারণ করে, আপনার কবিতার পঙক্তি আবৃত্তিও করে। অর্থাৎ অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। আজ ভোরবেলায় আপনার সঙ্গে আমি কিছু কথা বলতে চাই, সে-কথা হবে অত্যন্ত খোলামেলা, যদিও ধারণা আপনি খোলামেলা কথাকে আজ ভয় পান। আপনার ভেতরটি, আমার মনে হয়েছে, অনেক দিন ধরে নানা কারণে বন্দি হয়ে আছে, যদিও কবিতায় তা প্রকাশ পায়, কিন্তু কথায় তা সব সময় প্রকাশিত হয় না। আপনার কথা মনে হলে প্রথম আপনার একটি কাব্যগ্রন্থের কথা মনে পড়ে, সেটি আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ- প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে, এবং এর পরে মনে পড়ে রৌদ্র করোটিতে-র কথা। তারপর আপনি বহু কবিতা লিখেছেন। আপনার কবিতার সংখ্যা এখন সম্ভবত একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরেই, অন্যদের থেকে আপনি অনেক বেশি কবিতা লিখেছেন। আপনার যাত্রা শুরু হয়েছিল, আমি যতটা বুঝেছি, একজন অত্যন্ত ব্যক্তিগত, আপনারই ভাষায়, ‘শিল্পের শহীদ’রূপে; কিন্তু এখন আপনি অনেকটা রাজনীতির শিকারে পরিণত হয়েছেন। আপনার কবিতা বিকশিত হয়েছে, আপনার কবিতা আমাদের অনেকটা রূপান্তরিত করেছে, আমাদের চেতনাকে শাণিত, আধুনিক এবং ভবিষৎমুখী করেছে; এ জন্য এখন আপনি বাঙালির গৌরবেও পরিণত হয়েছেন।”

শামসুর রাহমান বাংলা কবিতার এক দিকপাল এ কথা অনস্বীকার্য কিন্তু সমকালের কবিতার পাঠকের নিকট কতটা জরুরি এ প্রশ্নটি রয়ে যায় সব সময়। যেমনটি রয়েছে আল মাহমুদকেও ঘিরে। লোকজ উপাদানে, বাঙালিয়ানায় মাহমুদ যতটা সমুজ্জ্বল কিংবা জসীমউদ্্দীন, শেষাবধি তা কোথায় গিয়ে ঠেকবে কাব্যিক বিচারে এর উত্তর তো নিবিড় কাব্যরসিকই কেবলমাত্র বলতে পারবেন। 

তবুও শামসুর রাহমান ‘নিঃসঙ্গ শেরপা’- আমাদের নিকটস্থ এক মানুষ, বাংলা কবিতার রাজ্যে এক কবিতা বৃক্ষ।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫