
প্রতীকী ছবি
লালমিয়া প্যারালাইসড হয়ে বছর চারেক ধরে বিছানায় পড়ে আছে। হাতের জমা টাকা, বউয়ের গয়না, বাড়ি গাছ বিক্রি করে চিকিৎসা চলেছে। অবশেষে বাকি রইল একখ- ধানের জমি। এবছর জমিটাও বন্ধক রেখে টাকা আনলো আলেয়া বিবি। এখন থাকার মধ্যে শুধু ঘরটাই আছে।
লালমিয়া যখন বিছানায় পড়লো ছেলে মিজান তখন একাদশ শ্রেণির ছাত্র, আর মেয়ে ময়না চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। মিজান কলেজের সাহায্য নিয়ে কোনোমতে ইন্টার পাশ করলো। ছাত্র হিসেবে সে খুব একটা ভালো ছিলো না। তবে মানুষ হিসেবে বেশ ভালো। আর ময়না ছাত্রী হিসেবে বেশ ভালো হলেও গুমোট স্বভাবের মেয়ে। পারিবারিক টানাটানির জন্য ইন্টার পাশের পর মিজান পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে শহরে পাড়ি জমালো। শুরুতে কন্সট্রাকশন সাইটে কাজ করতে লাগল মিজান। মাস শেষে বেতন থেকে নিজের জন্য সামান্য কিছু টাকা হাতে রেখে বাকি টাকা বাড়ি পাঠাতো। তা দিয়ে বাড়ির খরচ, বোনের পড়াশোনা, বাবার নামমাত্র চিকিৎসা চলতো। এতো কষ্টের কাজ কতোটুকু বয়সের মিজানের জন্য ভারী বোঝা হয়ে দাঁড়াল। মিজান প্রায়ই অসুস্থ হতে লাগলো, আজ জ্বর তো কাল গায় ব্যথা, কখনো পা পিছলে পড়ে যেত, কখনো হাতে হাতুড়ির বাড়ি লাগতো। তাছাড়া ঠিক মতো খাওয়া নেই, গোসল নেই ঘুম নেই সে জন্য জন্ডিস তো আছেই। মাকে ফোন করে সে প্রায়ই খুব কাঁদে। আর তাই কাজের পাশাপাশি চাকরির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যায়।
প্রথমে একটা বিল্ডিংয়ের সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি পায় মিজান। মাকে ফোন করে জানায় সে একটা চাকরি পেয়েছে, যদিও এখানে টাকা কম খাইয়ে দাইয়ে সাত হাজার টাকা বেতন তবে শান্তির চাকরি। মা সাথে সাথেই সম্মতি দিয়ে দেয়। নিজেও গ্রামে এবাড়ি ও বাড়িতে কাজ করতে লাগলো। মিজান খুব হীনমন্যতায় ভুগতো। সে নিজের শান্তির জন্য কষ্টের কাজ ছেড়ে দিয়েছে, মাকে অন্যের বাসায় কাজ করতে হয়, বাবার চিকিৎসায় বুঝি ঘাটতি হবে, ময়নার পড়ার ক্ষতি হয় কিনা- ইত্যাদি আবার যখন ভাবে বেশি উপার্জন করতে গিয়ে নিজে অসুস্থ হয়ে পড়লে জীবন তখন আরো দূর্বিষহ হয়ে উঠবে। মিজানের নতুন চাকরির মাস দুয়েকের মাথায় মায়ের ফোন আসে বাবা আর নেই। মিজান ধপ করে মাটিকে বসে পড়ে, দিনের ঝলমলে আলোর মধ্যে তার মনে হচ্ছে চারদিকে যেন অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, তার কানের মধ্যে যেন ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে আর বাবা বলছে- ‘খোকন তোর খরচ কমিয়ে দিলাম, এবার শান্তির চাকরি কর তুই, এখন আর মাস শেষে তোর টাকায় টানাটানি পড়বে না।’
বাবা চলে গেলেন, মাস সাতেক হলো মিজান গার্ডের চাকরিটা করছে। মাঝে মাঝেই একটু-আধটু চাকরির জন্য পড়াশোনা করে, দু-একটা পরীক্ষা দেয়। বাড়িওয়ালা বেতনও পাঁচশো বাড়িয়েছে। মিজান বাড়িতে আগেও সাড়ে চার হাজার পাঠাতো, এখনো তা-ই পাঠায়। বাবার ওষুধের খরচ তো নাই। তাই মা আর অন্যের বাড়ি কাজ করে না। এখন গ্রামের বাড়িতে মা আর ময়নার ভালোই দিন চলে যায়। বাড়িওয়ালা খাবার দাবারের প্রতি খুব একটা যত্নশীল না তাই মিজানের মাঝে মাঝেই বাইরে খেতে হয়, তাছাড়া টুকটাক খরচ, দুই একটা বই কেনা এসব মিলিয়ে মিজান আগে পঁচিশ শো নিজের জন্য রাখতো, এখনো তাই রাখে আর যে পাঁচশো বেড়েছে তা জমিয়ে রাখে বন্ধকী জমিটা ছাড়ানোর জন্য। হঠাৎ একদিন চিঠি এলো খুশির বন্যা নিয়ে, একটা সরকারি অফিসে মিজানের ক্লার্ক পদে চাকরি হয়েছে। মিজান ভাবলো এবার তার দিন ফিরে এসেছে। আরো বছর ছয়েক কেটে গেলো, মিজান বেতনের টাকায় প্রথমেই বন্ধকী জমি ছাড়িয়েছে, বাড়িতে ঘর তুলেছে, পুকুরে ছোট করে একটা ঘাট বাঁধিয়েছে। একটা গরু কিনেছে, গরুটা একটা বাছুর দিয়েছে। তবে নিজের জন্য কিছুই করার সুযোগ পাননি মিজান। ওই তো একটা ক্লার্কের চাকরি কতইবা বেতন। তখনও মিজান বস্তির ঘরের মেসে গাদাগাদি করে থাকতো। তবুও দায়িত্ব থেকে একচুল নড়েনি। ময়না এখন ভার্সিটিতে পড়ে, মা আর ময়নার এখন আর কোনো কষ্ট নেই। বেশ ভালো আছে ওরা, শুধু বাবাই এ সুখের ভাগ পেলেন না। বাবার কথা মিজানের খুব মনে পড়ে।
দেখতে দেখতে অনেক সময় কেটে গেছে, এবার মা মনের মতো দেখে মিজানের জন্য বউ আনলেন। মেয়েও ইন্টার পাশ, গায়ের রং দুধে আলতা, হাঁটু সমান চুল, মায়ের ভাষায় লক্ষ্মীমন্ত বউ। দশ পনেরোদিন ছুটি কাটিয়ে মিজান নতুন বউ রেখে চাকরিস্থলে ফিরলো। বউয়ের জন্য মন কেমন করে কাজের ফাঁকে সে একটু আধটু কথা বলে, রাত জেগে কথা বলে। তবে বউয়ের এখনো নিজের কোনো ফোন নেই। বিয়েতে তো বেশ খরচ হলো, কিছু ধার দেনাও হলো, তাই মিজান ভাবলো মায়ের ফোন তো আছেই। তবে মায়ের ফোন তো ময়নার অধীনে, স্বাভাবিক ভাবেই এ নিয়ে প্রথম প্রথম না হলেও মাস তিনেকের মধ্যে ননদ ভাবি টুকটাক লেগে যেত। মাও মাঝে মাঝে খোঁটা দিতে লাগলেন- ‘বউ আসাতে ফোন তো দেখি বেড়ে গেছে, সারাদিন রাত ফুসুর ফুসুর।’
কলমিবানু এ নিয়ে স্বামীকে বিচার দিতেন প্রায়ই। মাস চারেক পরে মিজান আবার বাড়ি এলো, এবার হাতে খুব একটা টাকা নেই তবুও মা বোনের জন্য টুকটাক জিনিসপত্র আর বউয়ের জন্য এগারোশো টাকায় একটা ছোট ফোন নিয়ে এলো। এবার চার পাঁচ দিন ছিলো কিন্তু এরমধ্যে সে তিন বারই বোন আর বউয়ের ঝগড়া দেখলো। যদিও বোনের এখানে দোষটা বেশিই ছিলো তবে মিজান কিছু বলতো না, কি বলবে আবার কি দোষ হবে, মা কি ভাববে- বোন কি ভাববে। তবে তার খারাপ লেগেছে যে মা-বোনের দুর্ব্যবহারে কোনো প্রতিবাদ করে না। মিজান ফের চলে এলো শহরে, এরপর মায়ের ফোনে নালিশ, বউয়ের ফোনে নালিশ। এরপর শোনা গেলো বউ রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গেছে। মিজান আবার বাড়ি ফিরলো, তবে বউ রাগ করে চলে গেছে সে জন্য নয়, স্থানীয় স্কুলে একজন লাইব্রেরীয়ান দরকার সেখানে ময়নার চাকরির জন্য। মিজান চাকরিটার ব্যবস্থা করেও ফেললো। মিজান তখন ভাবলো, ময়নার চাকরি হয়েছে, মাও আল্লাহর রহমতে বেশ ভালো আছেন, তাহলে বউকে এবার নিজের কাছে নিয়ে যাবেন। নিজেরও তো একটা জীবন! আর কতদিন বস্তির খুপড়ি ঘরে কাটবে, মেসের খাবার খেয়ে, সারাদিন কাজ করে কার ইচ্ছে করে নিজের কাপড়টা নিজের ধুতে! তাছাড়া সারাদিন ঝগড়া নালিশও তো ভালো লাগে না। মিজান মাকে বুঝিয়ে বউকে নিয়ে শহর গেলো।
প্রথম দিন এক বন্ধুর বাসায় উঠলেন। তারপর এগলি-ওগলি খুঁজতে লাগল বাসা। অল্প বাজেটে নিরাপদ বাসা। যত যাইহোক বউ তো তার সুন্দরী। সে নিয়ে মিজান মনে মনে ভীষণ খুশি। তাই তার নিরাপত্তাও তো তাকে দিতে হবে। বাসা খোঁজার ফাঁকে ফাঁকে ফুটপাত থেকে হাঁড়ি পাতিল, মগ, ছাঁকনী যা চোখে পড়ছে কিনে নিচ্ছে দুজনে। আর চোখ জ্বলজ্বল করছে নতুন সংসার পাতার আনন্দে, এ আনন্দ প্রথম আলিঙ্গনের চেয়ে কিছু কম নয়। চার-পাঁচ দিন খুঁজে একটা বাসা পেল তিনতলা বিল্ডিংয়ের ছাদে একটা রুম। সাথে একটা মোটামুটি সাইজের বাথরুম আর একটা সরু রান্নাঘর, টোনাটুনির প্রথম সংসারের জন্য একদম ঠিকঠাক বাসা। মোটামুটি বেশ ভালোই চলছিলো দুজনের সংসার। মিজান অফিস যাবার সময় হাতে থাকা খুচরা পয়সা দিয়ে যেতো কলমিবানুকে, সে ওগুলো জমিয়ে জমিয়ে টুকটাক কিনতো। মাঝে মাঝেই দু’জন বেরিয়ে পড়ত রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ফুচকা খেতে। কলমিবানুর চাহিদা খুবই সামান্য ছিল, রাস্তার পাশের ফুচকায় সে এতো খুশি হতো যেন এর চেয়ে ভালো খাবার সে কখনো খায়নি। মিজান ফেরার পথে মাঝে মাঝে কাচের চুড়ি, টিপ নিয়ে আসতো, কলমি তাতে ভীষণ খুশি হতো। মিজান এরমধ্যেই মা বোনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যেতো ভালো রাখার। মাঝে মাঝেই পকেট ফাঁকা হয়ে যেতো তার, হতাশ হয়ে পড়তো সে। অনেক সময় এমনও হয়েছে ঘরে চাল নেই। কলমিবানু মাঝে মাঝে রেগে যেতো তবে খুব দ্রুতই সে আবার ভুলেও যেতো। কলমিবানু নিচের ভাড়াটিয়াদের দুটো বাচ্চাকে পড়াতে লাগলো। অন্তত তার শখ পূরণের টাকা তো আসবে, তাছাড়া সারাদিন একা বসে থাকার চেয়ে সময় কাটানোর এটা ভালো উপায়। মিজান খুব চেষ্টা করে যাচ্ছিলো দুদিক সামলানোর। এরমধ্যে ঘটে গেলো আরেক দূর্ঘটনা কলমিবানু সিড়ি থেকে পড়ে কোমরে বেশ আঘাত পেয়েছে। সে মাসে মিজানের এদিকে খরচ একটু বেশি হয়ে গেছে। বাড়িতে হাজার দেড়েক টাকা কম পাঠানো হয়েছে। তবে মনে হলো মা একটু মনক্ষুন্ন হয়েছে, তবে কিছু বলেনি। আর মিজানের মনে জোর ছিল বোনও তো কিছু উপার্জন করছে হয়তো ও সামলে নেবে, তাছাড়া মা তো আছেনই। আর প্রতিমাসে যা পাঠায় সব টাকা তো এখন আর লাগেও না জমি থেকে সারা বছরের চাল তো আসেই। তাতেও শেষ রক্ষা হলো না মাস শেষে কলমির ওষুধের টাকা কম পড়েছে। বন্ধুর থেকে ধার নিয়ে তা সামাল দিলো মিজান।
সময় বয়ে চলছে, মা ময়না বেড়াতে আসে শহরে, মিজান বউ নিয়ে বাড়িতে যায়। ময়নার বিয়ের প্রস্তাব এলো, বিয়ের দিনও ঠিকও হলো। কলমিরও বেশ ভারিক্কী এসেছে। বিয়ের আয়োজন চলছে, মা তার জমানো টাকায় ময়নার জন্য তিন ভরির গয়না গড়লেন। মিজানের হাতে জমানো ষাট হাজার টাকা ছিলো, মায়ের হাতে সে সবটা তুলে দিলো। মা এবার যেন শত জনমের রাগ উপরে দিলেন মিজানের উপর- ‘বউ নিয়ে শহরে থাহো, পাকা দালান ফুটাও, একটা মাত্র বোইনের বিয়াত তুমি খরচ করবার পারো না। সব কই যায় বুঝি? এতো টাহা ইনকাম করো। আর তোমার বউ তো লাল-নীল বাত্তি দেইখা পুরা আকাশ হাতে পাইছে। তোমারে তো আঁচলে বাইন্ধা রাখছে।’
মিজান শুধু বললো- ‘মা করি তো একটা ক্লার্কের চাকরি, কোনোদিন জিগাইছো কত টাকা বেতন পাই, কি দিয়া সংসার চালাই, কি খাই?’
-‘বাহ্ বাহ্ পোলার মুখে এ্যাহন কতাও ফুটছে।’
-‘মা তুমি মারো কাটো, কিন্তু আমি আর কই পামু টাকা অযথা আমার কেন কতা শুনাও। আর মা গয়না তো তুমি গড়াইছোই, গরু গোয়ালে আছে, ক্ষেতের পোলাও চাল, মা এরপরে কি সত্তর হাজার টাকায় হবে না? মা আমি দেহি আর হাজার বিশ টাকা কোথাও পাই কিনা। দোহাই তোমার তুমি রাগ কইরো না।’
-‘হ আমি রাগ করুম ক্যান, এইডা তো আমার কপাল। একটা বোইনের বিয়ায় ভাই কোনো গয়না দিতো না। পিন্দাইস তোর বউরে গয়না পিন্দাইস, বোইন তো আপদ।
বিদায় দিলে খুশি হস্।’
শাশুড়ীর এসব কথা শুনে কলমি রাগে ফেটে পড়ছে। স্বামীকে কথা শোনাতে লাগলো- ‘এখন পর্যন্ত একটা নাকফুল আর তিন আনার চেইন ছাড়া কিছু দিতে পারো নাই। তাও সেই বিয়ায় দিছো, আর তোমার মা বোন দিয়ে আমাকে কথা শোনাও।’
এসব বলতে বলতে কলমি বাপের বাড়ি চলে গেলো। ঘরে ঢুকে প্যান্ট পরে মিজানও বেরিয়ে এলো। তিনদিন পর বাড়ি ফিরলো মিজান, ফেরার পথে কলমিকে নিয়ে ফিরেছে সে। এক ভরির দুটো চেইন বের করলো পকেট থেকে, একটা বোনের হাতে- আরেকটা বউয়ের হাতে তুলে দিলো। দুজনেই ভীষণ খুশি, চোখ চকচক করছে দুজনার। তবে সেই অল্প চাহিদার কলমির চোখে খানিক হিংসাও ছিলো, হয়তো বলছো, ‘তখন দিলো সত্তর হাজার এখন আবার চেইন আর টাকা, তাতে আমার ভাগে তো সেই হাত কাছা নিই।’ এরপর মায়ের হাতে একলাখ টাকার একটা বান্ডিল দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আশ্চর্য কেউ জানতেও চাইলোনা কোত্থেকে এসেছে এসব।
গিয়ে বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। ‘বাবা তুমি খুশি তো আজ, আমি সব দায়িত্ব আজ পূর্ণ করলাম?’ মিজানের মনে হলো ওপার থেকে উত্তর আসছে- ‘না, তুই ঘুষখোর, একটা ক্লার্কের কাছে এতো টাকা কোত্থেকে এলো? উত্তর দিতে পারিস তুই? কোন ফাইলে নয় ছয় করেছিস বল?’
মিজান বলতে লাগলো- ‘বাবা আমি পারবো না তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে কিন্তু দেখো টাকা সবাইকে খুশি করে দেয়, সে হোক বউ, মা কিংবা কোনো পরমাত্মীয়।’