Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

শহীদ কাদরী

নাগরিক বাস্তবতায় প্রেমচেতনার অভিবাদন

Icon

চঞ্চল নাঈম

প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২১, ১৪:০৯

নাগরিক বাস্তবতায় প্রেমচেতনার অভিবাদন

শহীদ কাদরী। ফাইল ছবি

শহীদ কাদরী ১৪ আগস্ট ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায় জন্ম এবং ২৮ আগস্ট ২০১৬ (বয়স ৭৪) নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ১৯৪৭-পরবর্তীকালের বাংলা কবিতায় নাগরিকতা ও আধুনিকতাবোধ আর নাগরিক জীবন সম্পর্কিত, প্রণয় সম্পর্কিত একাধিক কবিতা লিখেছেন।

কাব্যযাপনে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চার। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তরাধিকার’ প্রকাশিত হয়েছিল চট্টগ্রাম বইঘর প্রকাশনী থেকে ১৯৬৭ সালে। একই প্রকাশনী থেকে একই সঙ্গে প্রকাশিত হয় শামসুর রাহমানের ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’, আল মাহমুদের ‘কালের কলস’। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের ব্যবধান একটু কম হলেও চতুর্থ কাব্যগ্রন্থটি ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ প্রকাশিত হলো প্রায় ৩০ বছর পর ২০০৯ সালে। এই বইয়ের নামের সঙ্গেই যেন আকাঙ্ক্ষা জড়িয়ে আছে, দূরত্ব-ক্রন্দন জড়িয়ে আছে। দেশের মানুষের কাছে তার প্রিয় শব্দগুলো, কবিতাগুলো পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানালেন। 

শহীদ কাদরী স্বল্পসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনেও চাকরি করেছেন। শোনা যায়, শহীদ কাদরী একবার ছাপাছাপির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। মূলত, প্রয়াত কবি আবিদ আজাদ ছিলেন ব্যবসা করার উৎসাহদাতা। আবিদ আজাদ এবং আরও কিছু কবি তার ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্তও ছিলেন। তিনি যে ব্যবসায়িক মানুষ নন, তা কিছু দিনের মধ্যেই প্রমাণ হয়ে যায়। কিছু দিনের ভেতর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। ব্যবসা না, শহীদ কাদরী সেখানে নিয়মিত আড্ডার ব্যবস্থা করতেন। তিনি আড্ডাপাগল মানুষ, সেখানে আড্ডাই প্রধান বিষয়। সমসাময়িক ও তরুণ কবিদের নিয়ে তুমুল আড্ডা চলত। আড্ডা কীভাবে জমাতে হয়, তা তিনি হাড়েহাড়ে জানতেন। এক বিষয় থেকে আরেক বিষয়ে দ্রুতই ঢুকে পড়তে পারতেন। আড্ডা জমে উঠতো কবিতা ছাড়াও সেই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটসহ নানান বিষয়-আশয়। 

সম্ভবত, আজকের কাগজের সুবর্ণরেখায় শহীদ কাদরীর দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। সেই সাক্ষাৎকারে তার ঢাকার জীবন, কবিতা জীবনযাপনসহ নানান প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করেছিলেন। কবিতায় ফেরার আকুতি প্রকাশ পেয়েছিল তার সেসব কথোপকথনে। প্রবাসজীবনে তিনি বিভিন্ন লাইব্রেরিতে যেতেন এবং নানাধরনের বই পড়তেন। একদিন এক লাইব্রেরিতে গিয়ে বই দেখছেন, হঠাৎ দেখেন শামসুর রাহমানের একটি বই ফ্যাল-ফ্যাল তাকিয়ে আছে। বইটি দেখে আবেগতাড়িত হয়েছিলেন কিছুক্ষণ। কবিতার স্মৃতিতে ফিরে এসেছিলেন। নতুন কবিতা লেখার আকাঙ্ক্ষা প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল তখন। কবিতায় অপ্রত্যাশার ক্রন্দনে চির-আকাঙ্ক্ষার বাহ্যিকতায় বছরের পর বছর বিদেশে কাটিয়েছেন; কিন্তু বিদেশে যাওয়ার আগেই লিখে গেছেন ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’। তবে শহীদ কাদরীর ভেতরে ভেতরে ক্রন্দন থেকে গেছে কবিতার জন্য, দেশের জন্য, ঢাকার আড্ডার জন্য, পথের দূরত্বে। শহীদ কাদরীর কবিতা সম্পর্কে বলতে গেলে শামসুর রাহমানের কবিতা আর আল মাহমুদের কবিতার প্রসঙ্গ এসে দাঁড়ায়।

শামসুর রাহমানের কবিতা থেকে ঢাকা শহরের নাগরিক বিবর্তন সহজেই দেখা যায়। আর আল মাহমুদ ঢাকায় থেকেও লোকজ ও গ্রামীণ জীবনবোধ তার কবিতার অনুষঙ্গ করেছেন। শহীদ কাদরীর কবিতায় প্রণয়, আনন্দ-আড্ডা, বিষাদ-বেদনা, জীবনের নিঃসঙ্গতা পীড়াযুক্ত বিষয়-আশয় বিবেচিত প্রাসঙ্গিক। বৃষ্টি কবিতার ছন্দ চলন দেখি, কবিতার ভেতর থেকে ছয়টি পঙ্ক্তি নিয়ে-

ভেসে যায় ঘুঙুরের মতো বেজে সিগারেট-টিন

ভাঙা কাচ, সন্ধ্যার পত্রিকা আর রঙিন বেলুন

মৃসণ সিল্কের স্কার্ফ, ছেঁড়া তার, খাম, নীল চিঠি

লন্ড্রির হলুদ বিল, প্রেসক্রিপশন, সাদা বাক্স ওষুধের

সৌখিন শাটের ছিন্ন বোতাম ইত্যাদি সভ্যতার

ভবিতব্যহীন নানা স্মৃতি আর রঙবেরঙের দিনগুলি

 [বৃষ্টি, উত্তরাধিকার]

শহীদ কাদরী তাঁর নিজস্ব কেমিস্ট্রি অক্ষর-বৃত্ত চালে বুঝিয়েছেন, দুটি পদে ছদ্মপরিচয় তুলে ধরেছেন। প্রথম লাইনের প্রথম পদে আট মাত্রা আর দ্বিতীয় পদে দশ মাত্রা চাল। কবিতায়-ধারাবাহিকভাবে প্রথম লাইনের মতো দ্বিতীয় ও তৃতীয় লাইনে একইভাবে চলন, দুটি পদে ভাগ করে চলে ছন্দের মৌচাক। প্রথম পদে আট আর দ্বিতীয় পদে দশ মাত্রা। 

৮+১০=১৮

৮+১০=১৮

৮+১০=১৮

এবার চতুর্থ লাইনে ছন্দের চাল অনুধাবন শুরু আরও চার মাত্রা বেড়ে ২২ মাত্রার চাল দিয়েছেন। আবার পঞ্চম লাইনে এসে ৮+১০=১৮ মাত্রা চাল। আর ষষ্ঠ লাইনে দেখি ভিন্নতার চলন, বড় পরিসরে ২২ মাত্রার চলন। নিজস্ব চলনে কবিতার বক্তব্যটিকেও স্বতন্ত্র দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। 

বৃষ্টিতে নাগরিক হৃদয় ভেসে যাচ্ছে। সভ্যতার নানা 

মাত্রিক বিভাজনে স্মৃতি আসে। 

কে দ্যাখেনি? আজীবন নন্দিত রবীন্দ্রনাথ থেকে

শুরু করে ত্রিশ ও ত্রিশোত্তর অনেকেই,

এমন কি কোনো-কোনো অনুজ পর্যন্ত। আর তোমার 

নিবিড়

নীলাকাশ, যার নিচে ভাটফুলের ঘুঙুর শুনে

একদা জীবনানন্দ বসবাসযোগ্য ভেবে

আমরণ থেকেই গেলেন বাংলাদেশের শহরতলির কোনো

স্বল্প-পাওয়া ময়লা-ধোঁয়াশা-ঢাকা বৃক্ষের মতন।

 [নিসর্গের নুন, উত্তরাধিকার]

কবিতাটি প্রয়াত কবি রফিক আজাদকে উৎসর্গ করা। প্রচণ্ড ইঙ্গিতমূলক সচেতন দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তার চোখে ধরা পড়েছেন আজীবন বটবৃক্ষের মতো এখনো বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ। এমনকি ত্রিশোত্তর জীবনানন্দকেও ছাড় দেননি। কবিতার শেষ পঙ্ক্তিতে নিসর্গের ধোঁয়াশায় নুন ঢেলে দিয়েছেন। তিনি হয়তো কোনো নতুন কবিই আর খুঁজে না পাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে বোঝাতে চেয়েছেন এরাও আর তেমন কি? যেভাবে আজীবন রয়েছে দাঁড়িয়ে।

ভয় নেই

আমি এমন ব্যবস্থা করব যাতে সেনাবাহিনী

গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে

মার্চপাস্ট করে চলে যাবে

এবং স্যালুট করবে

কেবল তোমাকে প্রিয়তমা।

[তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা, তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা]

নাগরিক বাস্তবতায় প্রেমচেতনার ভিন্ন ধরনের উদাহরণ এই কবিতা। সংগ্রাম-অন্তর্দ্বন্দ্ব বিরহ আর্তচিৎকার কবিতাটির বিষয়। স্বল্পসংখ্যক কবি কবিতা লিখে নিজেকে সবার নিকট পরিচিত করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম কবি শহীদ কাদরী।

একটি কবিতায় কবি উচ্চারণ করেন- 

ফুসফুসের ভিতরে যদি পোকা মাকড় গুঞ্জন করে ওঠে 

না, প্রেম তখন আর শুশ্রূষাও নয়; সর্বদা, সর্বত্র

পরাস্ত সে; মৃত প্রেমিকের ঠাণ্ডা হাত ধরে

সে বড়ো বিহ্বল, হাঁটু ভেঙে-পড়া কাতর মানুষ।

মাথার খুলির মধ্যে যখন গভীর গূঢ় বেদনার

চোরাস্রোত হীরকের ধারালো ছটার মতো

বয়ে যায়, বড় তাৎপর্যহীন হয়ে ওঠে আমাদের

ঊরুর উত্থান, উদ্যত শিল্পের লাফ, স্তনের গঠন।

 [প্রেম, কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই]

জীবনের দ্বন্দ্বের দূরত্বে প্রকাশিত কম্পমান বিহ্বল। বাস্তবের অসহায়তার ইঙ্গিতে সংঘাত-সমস্যা, জটিলতা ধারালো হয়েছে। এখানে বেদনা জড়ানো প্রতিমায় অভিজ্ঞতা পরিপক্ব আবেগ মিশ্রিত। জীবনের পরিব্যপ্ত পারিপার্শ্বিক সামাজিক ঘটনা সরলভাবে দেখা যায়। যৌনতার মৌন প্রকাশ উঠে আসে সাধারণ বর্ণনার সম্মোহনে।

শহীদ কাদরী বাংলাদেশের কবিতায় আধুনিক মনন-চেতনা ও জীবনবোধের অভিজ্ঞতা ধারালো করেছেন। শহীদ কাদরী বাংলা কাব্যে স্বতন্ত্র কণ্ঠে নিজের স্বকীয়তায় আলোচিত।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫