Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

জীবনরসিক বিভূতিভূষণ

Icon

সঞ্জয় সরকার

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:১৩

জীবনরসিক বিভূতিভূষণ

প্রতীকী ছবি

জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করেছেন ‘পথের পাঁচালী’র মহান স্রষ্টা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। যা কিছু অবহেলিত, উপেক্ষিত সেসবরেই কথা তিনি বর্ণনা করেছেন তাঁর কথাসাহিত্যে। জীবনযাপনে অসম্ভব কৌতূহলী ও সন্তুষ্টি নিয়ে তিনি অতিবাহিত করেছেন তাঁর সময়কে। মৃত্যুর কিছুদিন আগেও বাণী রায়কে বলেছিলেন- শুনুন, আমার কথা যখন লিখবেন, লিখবেন জীবনে আমি খুশি হয়েছি। 

বাঙালি জীবনের খুঁটিনাটি ঘর-গৃহস্থালী, চেনা-অচেনা প্রকৃতির বিস্তারিত বর্ণনা, মোহনীয় স্মৃতিকাতরতা এবং চমকপ্রদ আধ্যাত্মিক জীবন বিভূতিভূষণের লেখনীর অন্যতম শক্তি। আজন্ম এক বিস্ময় বিহ্বলে ভরপুর এক মানুষ ছিলেন তিনি। শিশুর দৃষ্টিতে পৃথিবীকে দেখা আর শিশুসুলভ আচরণের চিরায়ত স্বভাব নিয়ে তিনি ছিলেন জীবন রসিক এক মানুষ। যেমন ছিলেন ঈশ্বরে বিশ্বাসী তেমনি আবার অন্ধ প্রচলিত আচার সর্বস্ব ধর্মকে তিনি মানতে পারতেন না। শিশুর মতো আত্মভোলা হলেও লেখালেখির ব্যাপারে ছিলেন দারুণ গোছানো। ব্যক্তিজীবনে দুঃখ, বেদনা তাকে দারুণভাবে আহত করেছিল। বিশেষ করে তাঁর প্রথম স্ত্রী গৌরী দেবী বিবাহের অল্প কিছুদিনের মধ্যে মারা গেলে তিনি প্রচণ্ড আহত হয়েছিলেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর দিন অঝোর ধারায় তিনি কেঁদেছিলেন। পারিবারিকভাবে ছোট ভাই নুটুবিহারির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল যেন রাম-লক্ষ্মণ। আর সে কারণে বিভূতির মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যে ভাই নুটুবিহারী আত্মহত্যা করেন। ইট কাঠের মন্দিরে ঈশ্বর বন্দি নন এই ছিল বিভূতির মত।

একবার সাহিত্যিক গজেন্দ্রনাথ মিত্রের সঙ্গে বিভূতি গেছেন পুরীতে ঘুরতে। পুরীর মন্দিরে ঢুকে বিভূতি গজেন্দ্রনাথকে বলছেন, তোমাদের দেবতা তো জাগ্রত? যা চাইবো তাই পাওয়া যাবে? গজেন্দ্রনাথ বললেন, মন দিয়ে চাইলে অবশ্যই পাওয়া যাবে। এবার বিভূতি বললেন, আজ আমার ল্যাংড়া আম খাওয়া চাই। সন্ধ্যা হলে সেবায়েত হোটেলের দরজায় কড়া নাড়লেন। দরজা খুলে দেখা গেলো মন্দির থেকে ল্যাংড়া আম এসেছে। সেবায়েতের বক্তব্য- এক ভক্ত মানত করেছিলেন, তার আশা পূর্ণ হয়েছে তাই তিনি ল্যাংড়া আম দিয়ে গেছেন ভোগ হিসেবে। শুনে বিভূতিভূষণ অবাক, তাই নাকি? এমন কখনো হয়! বিভূতিভূষণ এই কাকতালীয় ব্যাপারটি বিশ্বাস করতে পারেননি। যদিও সরল মানুষ ছিলেন কিন্তু এরপরও তিনি অন্ধ বিশ্বাসে বিশ্বাসী হননি। আর একারণে দিনলিপি ‘তৃণাঙ্কুরে’ তিনি বলেছেন- ‘আজ ও-বেলা যখন শালগ্রাম পূজা করছিলুম, তখন আমার মনে হলো, ওই ঘরের বদ্ধ ও অমুক্তির পরিবেষ্টনীর মধ্যে ভগবান নেই, তাঁকে আজ বিকেলে খুঁজব সুন্দরপুরের কিংবা নাতিডাঙার বাঁওড়ের ধারে, মাঠে, নীল আকাশের তলায় অস্তবেলায় পাখিদের কাকলীর মধ্যে’।

বিভূতি একদিন ছেলে তারাদাস (বাবলু) কে কথা দিয়েছেন, বিকেলে তাকে বেড়াতে নিয়ে যাবেন। বাবলুর বয়স তখন তিন; কিন্তু একই দিনে বিভূতির একটি সাহিত্য সভায় সভাপতিত্ব করার কথা। যারা আয়োজক তারা ইতোমধ্যে এসে গিয়েছিল বিভূতিকে অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার জন্য; কিন্তু পুত্র স্নেহে কাতর বিভূতি বললেন- সাহিত্যসভায় আরও অনেক সাহিত্যিক থাকবেন তাঁরা সভা চালিয়ে নিতে পারবেন, কিন্তু বাবলুকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য তাকে থাকতেই হবে। ব্যাস্, বিভূতি আয়োজকদের হতাশ করে বাবলুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। এসব ব্যাপারে এমন উদাসীন থাকলেও বিভূতি তাঁর লেখার ব্যাপারে কখনো উদাসীন ছিলেন না। তখন বিভূতির ‘অনুবর্তন’ উপন্যাসটি মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনীতে সাহিত্যিক গজেন্দ্রনাথ দেখছিলেন। ছাপানোর জন্য প্রুফ করে প্রস্তুত করা হচ্ছিল। গজেন্দ্রনাথ বিভূতিকে সম্বোধন করে বললেন, বড়দা দেখো তো তোমার বইয়ে দু’চারটা শব্দ পরিবর্তন করে দিয়েছি ধরতে পারো কী না। কয়েকপাতা উল্টেই বিভূতি দেখিয়ে দিলেন যে কোন কোন শব্দ তাঁর লেখা নয়। সেদিন গজেনবাবু বিস্মিত হয়েছিলেন। 

বিভূতির পারলৌকিক জীবন নিয়ে ছিল অসম্ভব রকম বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসে ভর করে লিখেছিলেন ‘দেবযান’ নামক উপন্যাস। এমনকি ১৯১৭ সালে প্রথম স্ত্রী গৌরী দেবীর মৃত্যুর পর দীর্ঘ সময় পার করে ১৯৪০ সালে এসে তিনি রমা দেবীকে বিবাহ করেন। এই বিবাহের পূর্বে তিনি প্লানচেটে বসেছিলেন। প্লানচেটে বসে বাবা মহানন্দ ও মা মৃণালিনী দেবীর মতামত তিনি নিয়েছিলেন বিবাহ সম্পর্কে। এমনই অদ্ভুত রকমের অলৌকিক বিশ্বাস ছিল বিভূতিভূষণের। নিছক গল্প করার জন্য নয় বরং আন্তরিকভাবে তিনি সেসব বিশ্বাস করতেন। প্রথম দিকে তাঁর বন্ধুস্থানীয় সকলে এসবকে গাঁজাখুরী গল্প বললেও অনেকেই বিভিন্ন সময় আধ্যাত্মিক ব্যাপারে বিভূতির শরণাপন্ন হয়েছিলেন। একবার প্রমথনাথ বিশীর ভাই মারা গেলে বিভূতির কাছে এসেছিলেন তার স্ত্রী সান্ত্বনার জন্য। বিভূতি তাকে নক্ষত্রের দাগ কেটে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন আত্মার অবস্থান। কান্নাকাটি করলে যে আত্মা কষ্ট পায় তার হিসাবও খাতায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বিভূতিভূষণ।

বিভূতি ছিলেন খাদ্যরসিক। কেউ ভালো কিছু খেতে দিলে ছেলে বাবলুর জন্য একটু হলেও পকেটে নিয়ে আসতেন। বন্ধুমহলে এই নিয়ে হাসিঠাট্টা চলতো। এমনই একটি নিমন্ত্রণ বাড়িতে বিভূতির পাত খালি দেখে বন্ধুবান্ধব আরও কিছু মিষ্টি দিতে বললেন। বিভূতি নেবেনই না। তখন বন্ধু কৃষ্ণদয়াল বসু বললেন খান, প্রয়োজন হলে বাবলুর জন্য দুটি বেঁধে দিতে বলি। বিভূতি সহাস্য পকেট থেকে সন্দেশ বের করে বললেন- ‘ইন ফ্যাক্ট, আগেই রেখে দিয়েছি’। 

ভাই অন্তপ্রাণ বিভূতি একবার সস্ত্রীক কোলাঘাটে শ্বশুরের চাকরিস্থলে বেড়াতে গেছেন। রাত্রে হঠাৎ দারুণ ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলো। নুটুবিহারী তখন ঘাটশীলায়। বিভূতি সেই রাতেই বেরিয়ে পড়লেন ঘাটশীলার উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে নুটুবিহারীও বের হয়েছেন কোলাঘাটের উদ্দেশ্যে দাদা কেমন আছে তা দেখতে। পথিমধ্যে ঝড়-বৃষ্টিতে দুই ভাইয়ের দেখা। এরপর দুজনে শান্ত হন এবং পরস্পর আবার নিজেরা ফিরে যান সেদিনের মতো। 

কতখানি বড় মনের মানুষ ছিলেন বিভূতি তার দেখা পাওয়া যায় যখন তিনি ভাগলপুরের জঙ্গলে প্রজাদের দেখাশোনা করতেন। একবার সরস্বতী পূজার দিন প্রজাদের খাওয়ানো হচ্ছিল। ধাঙড়রা বৃষ্টিতে বসে ময়লা ভেজা গামছার ওপর দই আর গুড় খাচ্ছিলো। বিভূতি দেখলেন এতো অল্পেই তারা অনেক খুশি। তাদের খুশি দেখে বিভূতির কান্না এলো। এত সামান্যে মানুষ খুশি হয়! বিভূতিভূষণ বৃষ্টিতে এসে ওদের সঙ্গে দাঁড়ালেন আর ভিজতে লাগলেন। 

মৃত্যুর পর বিভূতিভূষণের বই প্রকাশের কিছু রয়্যালিটির চেক ঘরে পাওয়া গিয়েছিল যা ব্যাংকে সময় মতো জমা করলে হাজার ত্রিশেক টাকা হতো। অথচ সেসব তামাদি হয়ে যায়। বিভূতি মানুষকে ধার দিতেন ফেরত পাবার আশা ছেড়ে দিয়ে। অতি অল্প পরিচিত লোকও বিভূতিভূষণের কাছে সহজে টাকা ধার পেত। এমনকি বাজার থেকে বেগুন কিনে যদি মনে হয় বেশি হয়েছে তবে একটা হলেও দোকানীকে বিনা হিসেবে ফেরত দিতেন তিনি। প্রকৃতিমগ্ন এক মানুষের অর্থ নিয়ে এই ছিল দারুণ মোহহীনতা। 

ইছামতীতে শরীর ভিজিয়ে আনন্দে বাড়িতে ফেরা বিভূতিভূষণ আজীবন প্রকৃতির মধ্যে বেঁচে ছিলেন। আরণ্যকের যুগলপ্রসাদ বা রাজু পাড়ে আসলে বিভূতিরই ভিন্ন নাম। আজও প্রকৃতিতে চাঁপাফুল ফুটলে সাহিত্যমোদী মানুষ বিভূতিভূষণকে দেখতে পাবেন। দেখতে পাবেন প্রথম স্ত্রী গৌরী দেবী মারা যাওয়ার পর তাকে যেভাবে চাঁপাফুলে সাজানো হয়েছিল, সেই থেকে বিভূতির পছন্দের তালিকায় চাঁপাফুল ভর করে ছিল। পথের ধারে অযত্নে বেড়ে ওঠা কুকশিমা, দুধলি, বনকলমির ঝোপ বিভূতিভূষণই আমাদের প্রথম দেখতে শিখিয়েছেন। আর জীবনের চলার গতির নতুন অর্থ বিভূতিভূষণ আমাদের সামনে তুলে ধরেন তাঁর পথের পাঁচালী উপন্যাসের মধ্য দিয়ে। বিভূতির জীবনের নাম- চরৈবেতি, চরৈবেতি।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫